নীলচে লালগির্দির খোঁজে

মাধবকুণ্ড ইকোপার্কের পরীকুণ্ডে পাথরের ওপর একটি স্ত্রী নীলচে লালগির্দিছবি: লেখক

দার্জিলিংয়ের রক গার্ডেনে ২০১৬ সালের এক বৃষ্টিস্নাত সকালে লাল লেজের নীলচে-ধূসর পাখিটিকে প্রথম দেখি। বিশাল এক শিলাখণ্ডের ওপর বসেছিল পুরুষ পাখিটি। মানুষের উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যেও সে নির্বিকারভাবে একদৃষ্টে আকাশপানে চেয়ে ছিল। আর মাঝেমধ্যে পাথরের ফাঁকে নেমে কীটপতঙ্গ খুঁজে খাচ্ছিল। ঠিক দুই বছর পর ওকে আবারও দেখলাম ভুটানের জিগমে দরজি জাতীয় উদ্যান এবং থিম্পুর রিভারসাইড হোটেলের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ওয়াং চু নদীর তীরে শিলাখণ্ডের ওপর বসে থাকতে।

তবে বিদেশের মাটিতে দেখলেও এক যুগ ধরে দেশের বিভিন্ন ঝরনা ও পাথুরে ছড়ায় বারবার খুঁজেও ওর দেখা পাইনি। দুই বছর আগে মৌলভীবাজারের বড়লেখার মাধবকুণ্ড ইকোপার্কের ঝরনায় ওর এক জাতভাইকে দেখলেও ওকে পাইনি। কিন্তু এ বছরের ২৮ নভেম্বর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এবার ওর খোঁজ পাওয়ার দু-তিন দিন পরই বার্ডিংবিডি ট্যুর গ্রুপের সঙ্গে মাধবকুণ্ডÐরওনা হয়ে গেলাম। কিন্তু রাস্তা খারাপ হওয়ায় বড়লেখা পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেল। বাস থেকে কাঁঠালটুলিতে নেমে হাত-মুখ ধুয়ে দ্রুত নাশতা সেরে সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগে আধা ঘণ্টার মধ্যে মাধবকুণ্ড ঝরনার কাছে পৌঁছে গেলাম। 

কিন্তু ইতিমধ্যেই সেখানে ঢাকার দুটি গ্রুপকে দেখলাম। আমরা আসার আগেই ওরা নীলচে-ধূসর পাখিটির ছবি তুলে ফেলেছে। ওদের ভাষ্য অনুযায়ী, পাখিটি ঝরনার পাশের পাথুরে ছড়ায় ছিল। ওখান থেকে ঝরনার কাছে এলে ওর জাতভাই সাদাটুপি লালগির্দি ছোট্ট পাখিটিকে তাড়িয়ে দেয়। এরপর পাখিটি পরীকুণ্ডের দিকে চলে যায়। এ কথা শোনার পর আমাদের টিমের দু-তিনজন পরীকুণ্ডের দিকে চলে গেলেন। ১০ মিনিটের মধ্যে ওদের ফোন পেয়ে পরীকুণ্ডের দিকে ধাবিত হলাম। এখানকার ছড়ার পাথরগুলো শেওলাময় ও পিচ্ছিল। তাই অতিসাবধানে যেতে হলো। যদিও পাখিটি মানুষকে তেমন একটা ভয় পায় না। কিন্তু তারপরও সাবধানে সামনের দিকে এগোলাম। 

ছড়ার যে পাশে আমরা পজিশন নিলাম, পাখিটি তার বিপরীত পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কাজেই দ্রুত একটি ক্লিক করে সাক্ষী ছবি নিয়ে নিলাম। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ও আমাদের সামনের বড় শেওলা ধরা পাথরটিতে এসে বসল। আর যায় কোথায়, ক্যামেরায় ক্লিকের বন্যা বয়ে গেল। এরপর প্রায় আধঘণ্টা ধরে থেমে থেমে ক্যামেরার শাটারের আওয়াজ হতে থাকল। দীর্ঘ এক যুগের প্রতীক্ষা শেষ হলো। 

এক যুগ খোঁজার পর মাধবকুণ্ডে পাওয়া নীলচে-ধূসর পাখিটি আর কেউ নয়, এ দেশের এক বিরল পরিযায়ী ঝরনার পাখি নীলচে লালগির্দি। ইংরেজি নাম প্লামবিয়াস ওয়াটার-রেডস্টাট। মাসসিকেপিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Phoenicurus fuliginosus। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এবং চীনে এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। 

নীলচে লালগির্দি ছোট আকারের পাখি। দেহের দৈর্ঘ্য মাত্র ১২ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ১৭ দশমিক ৫ গ্রাম। স্ত্রী ও পুরুষে পার্থক্য রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের লেজ লালচে-তামাটে। লেজের উপরি-ঢাকনি ও পায়ু ছাড়া দেহের ওপর ও নিচের অংশ কালচে নীলচে-ধূসর। প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রীর দেহের ওপরটা কালচে-ধূসর বাদামি ও নিচটা ফিকে ধূসর। ডানায় দুই সারি সাদা ফুটকি, কোমর ও পায়ু সাদা এবং কালচে লেজের দুই পাশ সাদা। দেহতল নীলচে-সাদা আঁশের মতো দাগে আবৃত। স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে চোখ বাদামি। চঞ্চু, পা ও পায়ের পাতা কালচে-বাদামি এবং পায়ের তলা সাদা। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির লেজের গড়ন মায়ের মতো। দেহের ওপরটা গাঢ় কালচে-বাদামির ওপর ঘিয়ে-হলুদের ঘন ছোপ ও নিচের দিকের গলা-বুকজুড়ে কালচে আঁশের মতো ছোপে ভরা।

শীতে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি বনের ঝরনা, খরস্রোতা পাথুরে নদী ও শেওলাঢাকা স্যাঁতসেঁতে পাথুরে ছড়ার কাছে একাকী বা জোড়ায় দেখা যায়। দিবাচর ও ভূচারী পাখিগুলো ভোর ও সন্ধ্যায় বেশি সক্রিয়। ছড়ানো লেজ ও ডানা বারবার নাচায়। পাথুরে জলধারার পাশে বা অল্প পানিতে হেঁটে বা পানি ঘেঁষে উড়ে বেড়ায় এবং বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ শিকার করে খায়। অনেক সময় ছোট ফলও খেতে পারে। 

এপ্রিল থেকে আগস্ট প্রজননকাল। এ সময় আবাস এলাকার জলার ধারে পাথরের খাঁজে, ফাটলে বা গাছের কোটরে শেওলা, ঘাস, গাছের মূল, চুল ও পশম দিয়ে বাটির মতো ছোট কিন্তু গভীর বাসা বানায়। ডিম পাড়ে তিন থেকে ছয়টি; ফিকে সবুজাভ-সাদা ডিমগুলোয় লালচে-বাদামি ছিট-ছোপ থাকে। স্ত্রী একাই ডিমে তা দেয়। ডিম ফোটে ১৪ থেকে ১৫ দিনে। স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে ছানাদের খাওয়ায় ও যত্নœকরে। আয়ুষ্কাল প্রায় চার বছর। 


আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়