নদী রক্ষা কমিশনের মতো একের পর প্রতিষ্ঠান গড়েছে সরকার, কিন্তু নদী রক্ষা করতে পারছে না

‘দখলের গ্রাসে শুটকি নদীর ২৬ কিলোমিটার: ৫০ বছরের নদী লুট ঠেকাতে নাগরিক আহ্বান’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা। জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা, ৩০ সেপ্টেম্বর
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

দেশে গণতন্ত্র না থাকলে নদী দখলদারেরা খুবই নিরাপদ বোধ করে। তা ছাড়া নদী রক্ষা কমিশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট, যৌথ নদী কমিশন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সরকার একের পর প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। তারপরও দেশের নদীগুলো বাঁচাতে পারছে না সরকার।

রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে আজ শনিবার সকালে এক আলোচনায় এসব কথা বলেন দেশের নদী রক্ষায় সক্রিয় থাকা বিশিষ্টজনেরা। ‘দখলের গ্রাসে শুটকি নদীর ২৬ কিলোমিটার, ৫০ বছরের নদী লুট ঠেকাতে নাগরিক আহ্বান’ শীর্ষক এই আলোচনার আয়োজন করে হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন, নোঙর, নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ও ইনিশিয়েটিভ ফর পিস নামের সংগঠনগুলো।

অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, নদী দখলদারেরা খুবই নিরাপদ বোধ করে, যদি দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার না থাকে। দেশে যদি স্বৈরতন্ত্র থাকে, যথেচ্ছচার থাকে, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার যত কম থাকে, নদী দখলদার, নদী খুনকারীদের তত বেশি সুবিধা হয়।

নদী রক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, নদী দখলমুক্ত করার জন্য রাষ্ট্র দরকার। নদী রক্ষা করার জন্য যখন যাচ্ছেন, তখন রাষ্ট্রকে পাওয়া যায় না। কিন্তু নদী রক্ষার জন্য যদি আন্দোলনে যান, তখন কিন্তু রাষ্ট্র আসে। তখন রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী আসে, মাস্তান বাহিনী আসে। বহু জায়গায় যারা নদী নিয়ে আন্দোলন করছে, তাদের নানা রকম হুমকির মধ্যে থাকতে হয়। বিভিন্ন মামলায় ফাঁসানো হয়। একটা সময় নদী নিয়ে আন্দোলনকারীদের বন্দুকযুদ্ধের হুমকিও দেওয়া হয়েছে।

আনু মুহাম্মদ মনে করেন, শুটকি নদীর মতো অন্যান্য নদী দখল হতেই থাকবে, যদি বর্তমান উন্নয়নের ধরন অব্যাহত থাকে।

সরকারের নদী বাঁচানোর ইচ্ছা নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যে দেশ নদী বাঁচাতে চায় না, সে দেশে একটার পর একটা শুটকি নদীর উদাহরণ তৈরি হবে। আপনি একের পর এক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। এমনকি একটা নদী রক্ষা কমিশনও করে রেখেছেন। তারপরও নদীগুলো বাঁচাতে পারছেন না। আপনার বাঁচানোর আসলে ইচ্ছা নেই।’

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, শুটকি নদী জেলা প্রশাসক ইজারা দিয়েও থাকলেও সেটা অবৈধ। কারণ, নদী ইজারা দেওয়ার এখতিয়ার জেলা প্রশাসকের নেই। তিনি বলেন, দেশে সামগ্রিক নদী প্রশাসনের চিত্র খুব ঘোলাটে। তারা বসে বসে থেকে দেখবে নদীগুলো দখল হচ্ছে। তারপর নদী দখলদারদের উচ্ছেদ করার জন্য হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেয়। নদী দখলদারদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়া বদলানো দরকার বলেও মনে করেন তিনি।

নদী রাষ্ট্রের সম্পদ, তা ব্যক্তির হওয়ার সুযোগ নেই বলে উল্লেখ করেন নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার। দেশে নদীস্বার্থ পরিপন্থী কোনো আইন নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না। যাঁরা চেয়ারে বসে আছেন বা নদী রক্ষার দায়িত্বে আছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও মামলা হওয়া উচিত। তাহলে জবাবদিহি নিশ্চিত হবে। সবাই এক হয়ে পদক্ষেপ নিলে শুটকি নদী রক্ষা করা সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।
শুটকি নদী ৫০ বছর ধরে যে দখল করে রেখেছে, তা দুর্ভাগ্য ছাড়া কিছুই না বলে মন্তব্য করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক প্রধান নির্বাহী শিপা হাফিজা। তাঁর অভিযোগ, নদীটি দখলের পেছনে জড়িত প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ভূমি মন্ত্রণালয়, নদী রক্ষা কমিশন—সবাই জড়িত। তা না হলে নদীটি এত দিন দখলে থাকতে পারত না।

নদী রক্ষা কমিশনের কার্যক্রমের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, এই কমিশন নদী রক্ষায় কোনো মামলা করে না।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, নোঙর বাংলাদেশ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান সুমন শামস প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ শফিকুর রহমান।

এই অনুষ্ঠানে দেওয়া নথিতে বলা হয়েছে, হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ নদী শুটকি। নদীটির উজানে খোয়াই এবং ভাটিতে যমুনার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৫০ সালে জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হলে নদী ও ভূমির মালিকানা রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়। কিন্তু বানিয়াচংয়ের জমিদার পরিবার শুটকি নদী নিজের দখলে নিতে ১৯৬০ সালে ইয়াহিয়া ফিশারিজ প্রাইভেট কোম্পানি গঠন করে। কিন্তু পাকিস্তান আমলে তা নিতে তারা ব্যর্থ হয়। ১৯৭২ সালে শুটকি নদীকে তারা বিল দেখিয়ে তা দখলের জন্য এই কোম্পানির পক্ষে মামলা করেন দেওয়ান ইয়াহিয়া রাজা। ১৯৭৩ সালে আদালত ওই ব্যক্তির পক্ষে রায় দেন। ১৯৯২ সালে আরেক রায়ে সরকার এই নদীর মালিকানা ফিরে পায়। বংশানুক্রমিকভাবে এখন এই নদীর মালিকানা দাবি করেন দেওয়ান আহমেদ রাজা।

গত বছরের জুলাইয়ে এই নদীকে বদ্ধ জলাশয় দেখিয়ে এই জমিদার পরিবারের কাছে ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এই নদীতে মানুষ মাছ ধরতে গেলে তথাকথিত মালিক বন্দুক হাতে তেড়ে আসেন। নদীর বিভিন্ন স্থানে সিমেন্টের ব্লক দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বাঁধ। এই শুটকি নদী রক্ষার দাবিতে আজকের এই নাগরিক আহ্বানের আয়োজন করা হয়।