জ্বালানির ভুল ব্যবহার মূল্য বাড়াতে পারে: সিপিডি

সিপিডি আয়োজিত ‘খসড়া সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন। সিপিডি কার্যালয় ধানমন্ডি, ২২ ডিসেম্বর
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সমন্বিত মহাপরিকল্পনার খসড়া তৈরি করেছে সরকার। এটি নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। বরং কয়লা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে (এলএনজি) নির্ভরতা দেখা যাচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির প্রতিযোগিতামূলক দাম নির্ধারিত হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু জ্বালানির ভুল ব্যবহার মূল্য বাড়াতে পারে।

মহাপরিকল্পনার খসড়া বিশ্লেষণ করে তৈরি করা গবেষণা প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে সিপিডি। আজ বৃহস্পতিবার সংস্থাটির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, আইন সংশোধন করায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নখদন্তহীন হয়ে পড়েছে। জরুরি প্রয়োজনের অজুহাতে মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার হস্তক্ষেপ করবে। আইন আবার সংশোধন করে বিইআরসির হাতে মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।

মহাপরিকল্পনা তৈরির ক্ষেত্রে কাঠামো, জ্বালানিনিরাপত্তা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জ্বালানি রূপান্তর, বিনিয়োগ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে সিপিডি। কিন্তু সরকারের তৈরি করা বর্তমান খসড়ায় আর্থিক বিষয়টি ওইভাবে রাখা হয়নি। জ্বালানির মূল্য নিয়েও এতে বিশদ আলোচনা হয়নি।

সিপিডি বলছে, ভর্তুকির বিষয়টিও মহাপরিকল্পনার খসড়ায় নেই। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি প্রত্যাহারের বিষয়টি সমর্থন করা যায় না। বরং দক্ষ জ্বালানির ব্যবহার বাড়িয়ে এটি করা যেতে পারে। উচ্চ জ্বালানি ব্যয়ের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দ্রুত অবসায়ন করা দরকার। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষ আইন দ্রুত অবসায়ন করা দরকার। এতে প্রতিযোগিতা নষ্ট হচ্ছে। সরকার কম দামে বিদ্যুৎ পাওয়ার সুযোগ হারাচ্ছে।

অনুষ্ঠানে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, চরম মূল্যস্ফীতির মধ্যেও জ্বালানির দাম বাড়িয়ে বোঝা চাপানো হচ্ছে। অথচ জ্বালানি খাতে সুশাসন নিশ্চিত করে অনেক সাশ্রয় করা সম্ভব। জ্বালানি খাতে দেশের ভেতর ও বাইরের অনেকের স্বার্থ রয়েছে। তাদের স্বার্থে নয়, জনগণ ও দেশের স্বার্থ বিবেচনা করেই মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। সহনীয় দামে সবার জন্য জ্বালানি নিশ্চিত করতে হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার আগামী জুনের মধ্যে ডিজেলচালিত সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের কথা বলেছে। কয়লা থেকেও সরে আসার কথা বলেছে। একই সঙ্গে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াবে। জ্বালানি খাতে সরকারের ঘোষিত বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে ভর্তুকি কমানো সম্ভব। এতে তিন বছরে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করা যাবে। এর জন্য একই পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। তবে এ বিনিয়োগ আসবে বেসরকারি খাত থেকে এবং যার অধিকাংশই বিদেশি বিনিয়োগ। আর সরকার চাইলে সাশ্রয় থেকেও বিনিয়োগ করতে পারবে। আর এসব বিনিয়োগ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পাওয়া যাবে।

এতে আরও বলা হয়, মহাপরিকল্পনার খসড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাসকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও তা অনেকটাই এলএনজিনির্ভর। আমদানি বাড়াতে অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যার জন্য বিপুল বিনিয়োগ লাগবে। জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের অতিরিক্ত সক্ষমতা এখন প্রায় ৬০ শতাংশ। মহাপরিকল্পনার খসড়া অনুসারে ২০৩০ সালে এটি কমে দাঁড়াবে ৩০ শতাংশে। এটি করতে পারলে ক্যাপাসিটি চার্জ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। অতিরিক্ত সক্ষমতা আরও কমানো দরকার।

সিপিডি বলছে, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে বলে ধরা হয়েছে মহাপরিকল্পনায়। এ হিসাবে ওই সময় মাথাপিছু আয় হতে হবে অন্তত সাড়ে ১২ হাজার ডলার। এমন উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য রাজনৈতিক হতে পারে। এ থেকে সরকারের সরে আসা দরকার। আসলে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে মহাপরিকল্পনা করা উচিত নয়, মধ্যমেয়াদি লক্ষ্য থাকা দরকার। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে বিদ্যুৎ চাহিদা হিসাব করার বিষয়টিও উচ্চাভিলাষী। ২০৫০ সালে ৯০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা হিসাব করা হয়েছে। এই লক্ষ্যের ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদন করা সম্ভব হবে না। বরং বাস্তবিক হিসাব করলে চাহিদা আরও কমবে।

নিবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তাঁর নেতৃত্বে গবেষণায় সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন হেলেন মাশিয়াত, শাইয়ান সাদিক ও মৌমিতা এ মল্লিক। এক প্রশ্নের জবাবে খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সমন্বিত মহাপরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার উপেক্ষিত হয়নি, অবহেলিত হয়েছে। এলএনজি খাতকে উৎসাহী করেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে কয়লা ব্যবহারকেও উৎসাহী করা হয়েছে।

সিপিডির প্রতিবেদন বলছে, এখন স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি জ্বালানিসংকট চলছে, এর মধ্যেই মহাপরিকল্পনা তৈরির কাজ হচ্ছে। হাইড্রোকার্বনের মতো নতুন জ্বালানি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। যদিও এটা এখনো পরীক্ষিত নয় এবং ব্যয়বহুল। দেশীয় কয়লা উত্তোলন না করার পুরোনো অবস্থান থেকে সরে আসার বিষয়টিও সন্দেহজনক।

কয়লাকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। এটা থেকে সরকারের সরে আসা উচিত। আগের চেয়ে এবারের খসড়া উন্নততর হয়েছে। তবে এর চেয়ে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, জাপান, শ্রীলঙ্কা অনেক অগ্রসর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।

দক্ষিণাঞ্চলে এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ অঞ্চল (হাব) তৈরি করা হচ্ছে। এটি না করে সেখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি অঞ্চল করা যেতে পারে বলে প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি। তারা বলছে, ভবিষ্যতে কয়লা থেকে সবচেয়ে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে মহাপরিকল্পনায়। তবে এর চেয়েও কম খরচে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এ ছাড়া দক্ষ জ্বালানির ব্যবহারের ক্ষেত্রে খাতভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা দরকার। পরিবেশগত সমীক্ষার বিষয়টি এবার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে এটিতে বাধ্য করতে হবে এবং নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে।

আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবারের মহাপরিকল্পনা বিশেষায়িত ও ইতিবাচক হয়েছে বলে জানিয়েছে সিপিডি। তবে সংস্থাটি বলছে, জিডিপিকেন্দ্রিক জ্বালানি চাহিদার হিসাব থেকে সরে আসা দরকার। দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস উত্তোলনে গুরুত্ব দেওয়া হলেও তা থেকে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো নিয়ে সন্দেহপোষণ করা হয়েছে মহাপরিকল্পনায়। সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে আরও গুরুত্ব দিতে হবে।