লিট ফেস্টে নোবেলজয়ী গুরনাহসহ খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের সম্মিলন

বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় শুরু হয়েছে ঢাকা লিট ফেস্টের দশম আসর। চার দিনের এ আয়োজন চলবে ৮ জানুয়ারি রোববার পর্যন্ত
ছবি: সৈয়দ জাকির হোসেন

কুয়াশাঢাকা শীতের সকালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছিল আজ দেশ–বিদেশের খ্যাতনামা সাহিত্যিক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, গবেষক, নির্মাতা, প্রকাশকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের সৃজনশীল গুণী ও গুণগ্রাহীদের সমাগমে। যাত্রা শুরু হলো ‘দশম ঢাকা লিট ফেস্টের’। চার দিনের এ আয়োজন চলবে ৮ জানুয়ারি রোববার পর্যন্ত।

বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় নোবেলজয়ী সাহিত্যিক তাঞ্জানিয়ার আবদুলরাজাক গুরনাহ, ভারতের সাহিত্যিক অমিতাভ ঘোষ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূ্রুল হুদা ফিতা কেটে আনুষ্ঠানিকভাবে লিট ফেস্টের উদ্বোধন করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন লিট ফেস্টের তিন পরিচালক সাদাফ সায্, কাজী আনিস আহমেদ ও আহসান আকবর।

এর আগে সকাল দশটায় বর্ধমান হাউসের সামনের মঞ্চে বৌদ্ধ আধ্যাত্মিক সংগীত পরিবেশনা দিয়ে ফেস্টের কার্যক্রমের সূচনা হয়েছিল। আয়োজকেরা জানান, চার দিনের এবারের আসরে ১৭৫টির বেশি অধিবেশনে পাঁচ মহাদেশের পাঁচ শতাধিক বক্তা, সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী ও চিন্তাবিদ অংশ নিচ্ছেন। এবারই প্রথম লিট ফেস্টে প্রবেশের জন্য ২০০ ও ৫০০ টাকার টিকিট চালু করা হয়েছে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয় মণিপুরি নৃত্য পরিবেশনা দিয়ে। রাধাকৃষ্ণের প্রণয়ের ওপর ভিত্তি করে এবং রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে কয়েকটি একক ও সম্মিলিত নৃত্য পরিবেশন করেন শিল্পীরা। এরপর ছিল উদ্বোধনী আলোচনা পর্ব।

উদ্বোধনী বক্তব্যে ২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারজয়ী তাঞ্জানিয়ার ঔপন্যাসিক আবদুলরাজাক গুরনাহ বলেন, ঢাকায় তিনি এই প্রথমবারের মতো এলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে পরিবেশিত মণিপুরি নৃত্য তাঁর কাছে খুব আকর্ষণীয় লেগেছে। বিশেষ করে শিল্পীদের বর্ণাঢ্য পোশাক ও অলংকার ছিল চমৎকার। তিনি বলেন, ‘আশা করি উৎসবের দিনগুলোতে এমন অনেক আকর্ষণীয় কিছু দেখব, যা আগে দেখিনি।’

অমিতাভ ঘোষ তাঁকে আমন্ত্রণের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পারিবারিক যোগসূত্র রয়েছে। তাঁর মায়ের বাড়ি ফরিদপুরের গোপালগঞ্জে এবং বাবার বাড়ি ছিল বিক্রমপুরে। তাঁর ঠাকুরমা (দাদি) সব সময় ফরিদপুরের আঞ্চলিক বাংলায় কথা বলতেন। তিনি সব সময় বাংলাদেশ নিয়ে ভাবেন এবং বাংলা ভাষা তাঁর জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। তাঁর লেখায় বারবার বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।

লিট ফেস্টের উদ্বোধনী পর্বে ছিল মণিপুরি নৃত্য পরিবেশনা, যা দেখে মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক তাঞ্জানিয়ার আবদুলরাজাক গুরনাহ। আজ বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমিতে
ছবি: সৈয়দ জাকির হোসেন

অমিতাভ ঘোষ এ প্রসঙ্গে বলেন, তিনি ইতালিতে অভিবাসীদের ক্যাম্পে গিয়েছিলেন। সেখানে অনেক বাঙালি ও পাকিস্তানির দেখা পেয়েছেন, যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেছেন। তাঁদের কষ্টকর জীবনের গল্পগুলো খুব মর্মস্পর্শী।

সাম্প্রতিক বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে অমিতাভ ঘোষ বলেন, বাংলাদেশ এখন আঞ্চলিক নেতৃত্ব, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে। জিডিপির উন্নতি হয়েছে, সামাজিক নানা সূচকে অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। এসব বাংলাদেশের অগ্রগতির পরিচয় তুলে ধরেছে। তিনি বাংলায় ‘সবাইকে ধন্যবাদ’ বলে তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।

সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এ উৎসবের সঙ্গে আগেও নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। এখন সংযোগ কিছুটা কমেছে। তবে ভবিষ্যতে লিট ফেস্টের সঙ্গে আবার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তৈরি হবে বলে আশা প্রকাশ করে উৎসবের সাফল্য কামনা করেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ উৎসব সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে দ্যুতি ছড়াবে।

এর আগে স্বাগত ভাষণে ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক সাদাফ সায্ বলেন, ‘হে ফেস্টিভ্যাল’ নামে ২০১১ সালে এই উৎসবের সূচনা হয়ে ছিল। ২০১৫ সালে এর নামকরণ করা হয় ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’। করোনা মহামারির কারণে গত তিন বছর এ উৎসব হয়নি। এবার নতুন আঙ্গিকে অনেক বৈচিত্র্যময় আয়োজন করা হয়েছে। এতে সাহিত্য আলোচনার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা, শিল্পী ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, সংগীত, নৃত্য ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, শিশু ও তরুণদের জন্য আড্ডাসহ অনেক আকর্ষণীয় বিষয় যুক্ত হয়েছে এবারের উৎসবে।

ঢাকা লিট ফেস্টের উদ্বোধনী পর্বে বক্তব্য দিচ্ছেন সাহিত্যে নোবেলজয়ী তাঞ্জানিয়ার ঔপন্যাসিক আবদুলরাজাক গুরনাহ। আজ বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমিতে
ছবি: তানভীর আহম্মদ

সাদাফ সায্ বলেন, ‘করোনা মহামারি আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে আমরা আবার পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হব। পরস্পরের অভিজ্ঞতা ও ভাব বিনিময় করব। এ অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের সমস্যা মোকাবিলায় সহায়ক হবে।’

লিট ফেস্টের পরিচালক আহসান আকবর বলেন, ‘উৎসবের দিনগুলোতে আমরা পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময় করে অনেক কিছুই শিখতে পারব। বিজ্ঞান, যোগাযোগ, প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে। তা থেকে ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে আমরা দিকনির্দেশনা পেতে পারি।’

ঢাকা লিট ফেস্টের অপর পরিচালক কাজী আনিস আহমেদ বক্তব্যের শুরুতেই করোনাকালে যাঁরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাঁদের স্মরণ করেন। তিনি বলেন, লেখকেরা নিভৃতে কাজ করেন। বিজ্ঞানীরাও তাই। তাঁদের কাজ যখন জনসমক্ষে আসে, তখন সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষ জানতে পারেন। উপকৃত হন। এখানে এই সৃজনশীল, চিন্তাশীল মানুষেরা তাঁদের ভাবনা ও সৃষ্টির বিষয়ে অনেক কিছুই তুলে ধরবেন, যা আমাদের আলোকিত করবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অপরাজিতা মুস্তাফা।

বিচ্ছিন্নতা একটি ভয়ংকর রাজনৈতিক শব্দ

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে দুপুর সাড়ে ১২টায় শুরু হয় লিট ফেস্টের প্রথম অধিবেশন ‘টর্ন অ্যাপার্ট’। আয়ারল্যান্ডের লেখক ও প্রকাশক বারবারা এপলার ছিলেন সঞ্চালকের ভূমিকায়। শুরুতেই তিনি বলেন, ‘টর্ন অ্যাপার্ট বা বিচ্ছিন্নতাকে তাঁর কাছে সব সময় সত্যকে হারিয়ে ফেলা বলে মনে হয়।’

আলোচনায় অংশ নেন সোমালিয়ান লেখক নূরুদ্দিন ফারাহ। তিনি সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন ভারতের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর ১৪টি উপন্যাস ও বেশ কিছু কিছু নাটক, ছোটগল্পগ্রন্থ রয়েছে।

তিনি বলেন, টর্ন অ্যাপার্ট শব্দটি খুব ভয়াবহ রাজনৈতিক শব্দ। নিজের শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানে নিজের অস্তিত্বের কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়া। তিনি এই বিচ্ছেদকে জন্মের সময় মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে তুলনা করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভারত–বিভক্তির সময় বিপুলসংখ্যক মানুষ তাঁদের ঠিকানা পরিবর্তন করে দেশান্তরি হয়েছিলেন। তাঁদের সম্পদ এবং জীবনমানের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উপমহাদেশের সাহিত্য, ইতিহাস ও শিল্পে বিভিন্নভাবে এই দেশভাগের বিষয়টি উঠে এসেছে। ইউরোপেও ঊনবিংশ শতকে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। উপমহাদেশ ভাগ থেকে শুরু করে আফ্রিকা কিংবা ইউরোপ ভাগ পৃথিবীর মানুষের কাছে যে দাগ ফেলেছে, তা মানুষের স্মৃতিতে কিংবা আচরণে এখনো বয়ে চলছে।

বিষয়টি নিয়ে আরেক আলোচক ছিলেন ভারতের লেখক গীতাঞ্জলি শ্রী। তাঁর টুম্ব অব স্যান্ড উপন্যাসটি গত বছর বুকার পুরস্কার জিতে নেয়। ভারতের উত্তর প্রদেশের এই লেখক এখন দিল্লিতে থেকেই লেখালেখি করেন। তিনি বলেন, তাঁর বয়স যখন ৮ কি ৯ বছর, তখন ভারত ভাগের বিষয়টি সম্পর্কে একটি বইতে জানতে পারেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এক কঠিন সময়ে বসবাস করছি। আমাদের মানসিকতার মধ্যেই বিচ্ছিন্নতার বোধ রয়েছে, রয়েছে মানবতার অভাব।’

এই অধিবেশনের তৃতীয় আলোচক ছিলেন শ্রীলঙ্কার লেখক শিহান করুনাতিলকা। শ্রীলঙ্কায় জন্ম হলেও তিনি পড়ালেখা করেছেন নিউজিল্যান্ডে। গত বছর দ্য সেভেন মুনস অব মালি আলমেইদার জন্য পেয়েছেন বুকার পুরস্কার। তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের পর নৈরাজ্যের কারণে যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছিল, তা কখনোই শেষ হয়ে যায়নি।’

আরও অধিবেশন

উৎসবের প্রথম দিনে ছিল, মুক্তিযুদ্ধের ৫০: সুবর্ণজয়ন্তীর ইতিহাসের দর্পণে বাংলাদেশ, আউট অব প্রিন্ট, টি এস এলিয়টস ওয়েস্ট ল্যান্ড, দ্য মেডিক্যান্ট প্রিন্স, ফ্রম ডন টু ডার্কনেস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ: স্বপ্নের আগামী, বাবুইবেলা, দ্য স্ট্রিট ইজ নট আ হোম, দ্য গ্রেট পদ্মা: দ্য মেকিং অব আ বুক, বড় চিন্তা ছোটগল্প, জীবনের গল্প গল্পের জীবন, সিস্টার্স ইন রেজিস্ট্যান্স, অ্যাট ফিফটি: আ লিটারারি জার্নি, ইন মেমোরিয়াম: স্যার ফজলে হাসান আবেদ, হোপ ফর ফেট, ভার্চ্যুয়াল সময়ে কবিতা, বাংলা থ্রিলার: পাতায় ও পর্দায়, বাংলা কবিতার বিশ্বায়ন বিষয়ে আলোচনা।

এ ছাড়া ছিল জেমকন সাহিত্য পুরস্কার প্রদান, চলচিত্র প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।