২০২৩ সাল আরও কঠিন হতে পারে

খাদ্যের পর্যাপ্ত মজুত রাখা, কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানো, জঙ্গিদের বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়াসহ বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সচিবদের। 

  • খাদ্যশস্যের সরকারি মজুত যাতে ১৫ লাখ টনের নিচে না নামে।

  • বিভিন্ন সংস্থার পতিত প্রায় আড়াই লাখ একর জমিতে উৎপাদনের নির্দেশ।

  • জ্বালানি, স্যার ও খাদ্যপণ্যে আমদানির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। 

  • ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র অবহিত করার নির্দেশ।

সচিবসভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল তাঁর কার্যালয়ে
পিআইডি

কোভিড-১৯ পরিস্থিতির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ কয়েকটি কারণে বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে, তা সহজেই কাটছে না। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাসের ভিত্তিতে সরকার মনে করছে, সামনের বছর ২০২৩ সাল আরও ‘কঠিন’ হতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে এখন থেকেই খাদ্যের পর্যাপ্ত মজুত রাখা, কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানো, নিত্যপণ্যে সরবরাহ ঠিক রাখা, ওএমএসসহ এ জাতীয় কার্যক্রমগুলো স্বাভাবিক রাখা, ব্যয় সংকোচন করাসহ সচিবদের একগুচ্ছ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জঙ্গিদের বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়াসহ আরও কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত সচিবসভার বৈঠকে এসব নিয়ে আলোচনার পর নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় সচিবসভার বৈঠক। এতে প্রায় সব সচিব উপস্থিত ছিলেন। দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় পর অনুষ্ঠিত হলো ওই বৈঠক। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থেকে বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা দেন।

সর্বশেষ গত বছরের ১৮ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল সচিবসভা। প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বৈঠককে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা হয়। এর মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনের বছরখানেক আগে অনুষ্ঠিত এই সভায় বাড়তি গুরুত্ব হিসেবে দেখা হচ্ছে। অবশ্য নির্বাচন সামনে রেখে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।

বাসস জানায়, সচিবসভায় সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দুর্ভিক্ষ আমাদের দেশকে কখনোই যেন ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে, সে জন্য এখন থেকেই আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এটি আমার কথা নয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বলা হচ্ছে যে বিশ্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা এখনই যে বিপদে পড়েছি, তা কিন্তু নয়। কিন্তু আমার কথাটা হচ্ছে আমার আগাম ব্যবস্থাটা নিতে হবে, যেন ভবিষ্যতে দেশ কোনো বিপদে না পড়ে বা দেশের মানুষ না পড়ে। আমাদের সেই সতর্কতাটা একান্তভাবে দরকার এবং সেই সতর্কবার্তাটাই কিন্তু আমরা দিচ্ছি।’

বৈঠকে ১৭ জন সচিব বক্তব্য দেন। এর মধ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মাহবুব হোসেন জ্বালানি পরিস্থিতির তথ্য তুলে ধরেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সচিব প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব যেসব নির্দেশনা ও বিষয়বস্তুর কথা বলেছেন, মূলত এগুলো নিয়েই আলোচনা হয়েছে।

খাদ্যে নিরাপত্তায় বিশেষ জোর

সচিবসভার বৈঠকে খাদ্যনিরাপত্তাসহ অন্তত ১২টি বিষয়ের ওপর বেশি আলোচনা হয়েছে। আলোচনা শেষে এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। বৈঠকের মূল বিষয় ছিল খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে কী করা যায়, তা নিয়ে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে সরকারিভাবে খাদ্যশস্য মজুত ছিল ১৬ লাখ ৯ হাজার ৫ টন। এর মধ্যে চাল ১৩ লাখ ২৩ হাজার ৭২৫ টন, গম ২ লাখ ৮২ হাজার ৫৯৪ টন এবং ধান মজুত আছে ৪ হাজার ১৩৩ টন (ধানকে চালের আকারে মোট মজুতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে)।

সচিবসভার সিদ্ধান্ত জানাতে সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, খাদ্যশস্যের মজুত পরিস্থিতি স্বস্তিকর অবস্থায় আছে। তবে সচিবসভায় আলোচনা হয়েছে, প্রয়োজনে বিদেশ থেকেও খাদ্যশস্য আমদানি করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই যাতে খাদ্যশস্যের মজুত ১৫ লাখ টনের নিচে না নামে, সে বিষয়ে সচিবদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বৈঠকে চাল ও আটা খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস), বিশেষ ওএমএস, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, ভিজিএফ ইত্যাদি কর্মসূচি যেন নিয়মিতভাবে পরিচালনা করা যায়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সচিবদের প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে অনেক মানুষ সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্যদ্রব্য পেতে পারেন। সরকার মনে করে, এসবের মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্যদ্রব্য দেওয়া গেলে বাজারে চাপ কমবে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে করণীয়

জানা গেছে, বৈঠকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবেরা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম তুলে ধরে বক্তব্য দেন। এ সময় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাসের কথা উল্লেখ করে সভায় বলা হয়, ২০২৩ সাল একটু কঠিন সময় যাবে। কারণ, ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। ডলারে দর বেড়ে গেছে। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য এটি একটু অসুবিধা হবে। আবার কোভিড পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারের আগেই রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বেধে যাওয়া এবং চীনা পণ্যের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার ফলে বিশ্ববাজারে পণ্যের সরবরাহও কমে গেছে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এসব বিষয়ে করণীয় নিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, ব্যয় ব্যবস্থাপনায় আর্থিক বিধি কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। খরচে সাশ্রয়ী হতে হবে। অগ্রাধিকার দিতে হবে বেশি প্রয়োজনীয় বিষয়কে, বিশেষ করে বিদেশে থেকে জ্বালানি, স্যার ও খাদ্যপণ্য আমদানি।

আর কম প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানির ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করতে হবে। যেমন আপেল, আঙুর বা দামি পোশাক ইত্যাদি আনার ক্ষেত্রে যেন ব্যয় সংকোচন করা হয়। এ ছাড়া অফিস-আদালতেও যেসব কাজ বেশি জরুরি নয়, সেগুলো বন্ধ রাখার জন্য সচিবদের নির্দেশ দেওয়া হয় বৈঠক থেকে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, প্রকল্প করার সময় সম্ভাব্যতা যাচাই এবং প্রাক্কলিত ব্যয় যেন ঠিকমতো ধরা হয়। আর দক্ষ জনবল দিয়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। বর্তমান সময়ের কথা বিবেচনা করে অগ্রাধিকার ঠিক করে প্রকল্প হাতে নিতে হবে। এর আগে প্রকল্পগুলোকে যে ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে, তা অনুসরণ করে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে সচিবদের বলা হয়েছে। বিশেষ করে বিদেশি সাহায্য বা ঋণে চলা যেসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। কারণ, এগুলোর বাস্তবায়ন বেশি হলে বৈদেশিক মুদ্রা বেশি আসবে।

তবে উন্নয়ন বাজেট কাটছাঁট করা হয়নি বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি বলেন, যে সংকোচন করা হয়েছে, সেটি রাজস্ব খরচ, যার মাধ্যমে পরিচালন ব্যয় করা হয়।

এ ছাড়া প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সচিবদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

বৈঠকে নিত্যপণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং বাজারদর নিয়ন্ত্রণ রাখতে বাণিজ্যসচিবসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জমির ই–রেজিস্ট্রেশনের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বৈঠকে।

পতিত জমিতে উৎপাদনে গুরুত্ব

কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়ে কিছুদিন ধরেই সরকারপ্রধান গুরুত্বারোপ করে আসছিলেন। একসঙ্গে সচিবদের পেয়ে আবারও এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। সরকার মনে করে, এই সংকটের সময় সবচেয়ে বড় সমাধান হতে পারে নিজস্ব পণ্য উৎপাদন।

এ ক্ষেত্রে কৃষিপণ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গত তিন-চার বছরে কৃষিজাত ও গবাদিপশুর ক্ষেত্রে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এগুলোকে উৎপাদনের সময় কাজে লাগাতে হবে। আর শুধু জনসাধারণের পতিত জমি নয়, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার যে পরিমাণ পতিত জমি আছে, সেগুলোতে যেন ওই সব জাত উৎপাদনে নিয়ে আসা হয়।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সংস্থার পতিত জমির পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ একর। এটি কাজে লাগাতে পারলে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ বিষয়ে সব সংস্থাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে কীভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায়, সে বিষয়েও বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সচিবদের।

জঙ্গি বিষয়ে সতর্ক হওয়ার নির্দেশ

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সচিবসভার বৈঠক থেকে। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন জঙ্গি সংগঠন চিহ্নিত হয়েছে। কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে। বাকি কিছুসংখ্যক পালিয়ে গেছে।

তাদের ধরা এবং জনগণকে সতর্ক করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জঙ্গিরা যাতে কারও কাছে আশ্রয় নিতে না পারে এবং কোনো আর্থিক সহায়তা নিতে না পারে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভায় আলোচনা করে কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

কয়েকটি ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র অবহিত করার নির্দেশ

এদিকে ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক নিয়ে ‘যেসব কথাবার্তা’ উঠছে, সে বিষয়ে প্রকৃত চিত্র জানাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং অর্থ বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।

ইসলামী ব্যাংক প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘ওভার অল, আরও কয়েকটা ব্যাংকের কথা..., এটি শোনার পর আমি ইন্টারনেটে গিয়ে দেখলাম কয়েকটা ব্যাংকের ব্যাপারে বাইরে থেকে ইউটিউবে বিভিন্ন রকম বক্তৃতা দিচ্ছেন। তবু এটিকে অবহেলা করা হয়নি। বলা হয়েছে, এগুলোকে দেখে চিত্রটি আমাদের জানাও।’

অর্থনৈতিক ও ব্যাংক খাতের সংকট নিয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এটি নিয়ে বৈঠকে অনির্ধারিতভাবে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং অর্থ বিভাগকে নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, চারদিকে এত কথাবার্তা উঠছে, আসল চিত্রটি কী, সেটি শিগগির দেখে অবহিত করবেন।