পড়ে আছে ১৬ কোটি টাকার হল

৫ হাজার ৫৮১ বর্গমিটার আয়তনের পাঁচতলা হলটিতে আসন রয়েছে ৩১২টি।

উদ্বোধনের এক বছর হতে চললেও চালু হয়নি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আবাসিক বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল। গতকাল দুপুরেছবি: প্রথম আলো

হলের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে প্রায় দেড় বছর আগে। ঘটা করে উদ্বোধন করা হয় তা–ও এক বছর হলো। লাখ টাকার আসবাবও কেনা হয়েছে। তবু চালু করা হচ্ছে না চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য নির্মিত বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল। কোন বিভাগের শিক্ষার্থীরা এ হলে থাকবেন, সেটিও এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে হাজারো শিক্ষার্থীকে।

১৬ কোটি ২৯ লাখ টাকার এই হলের কাজ ২০১৬ সালের মার্চ মাসে শুরু, শেষ হয় ২০২১ সালের আগস্টে। এরপর ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে হলের উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হলের নীতিমালা চূড়ান্ত করতে না পারায় এটি চালু করা যাচ্ছে না।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ৫ হাজার ৫৮১ বর্গমিটার আয়তনের পাঁচতলা হলটিতে আসন রয়েছে ৩১২টি। দুটি ব্লকে রয়েছে রান্নাঘর, শৌচাগার, ক্যানটিন ও ডাইনিং। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য আরও রয়েছে টিভিকক্ষ, গ্রন্থাগার, বিউটি পারলার, ব্যাডমিন্টন খেলার মাঠ, জিমনেশিয়াম ও সুইমিং পুলের সুবিধা। উদ্বোধনের পর দুই মেয়াদে প্রায় ৪০ লাখ টাকার চেয়ার-টেবিল, সোফাসহ নানা আসবাব কেনা হয়েছে।

গতকাল রোববার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, একজন প্রহরী হলের পাহারায় রয়েছেন। পড়ে থাকায় আসবাবের ওপর ধুলা জমে গেছে। সুইমিংপুলে জন্মেছে শেওলা। ব্যাডমিন্টন খেলার মাঠও ভরে গেছে আগাছায়।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে ১০ হাজার ৪৬ জন ছাত্রীর জন্য হল চালু রয়েছে ৫টি। এ ৫ হলে আসন রয়েছে ২ হাজার ৩০৯টি। এসব আসনে সব মিলিয়ে ছাত্রী থাকেন অন্তত ৪ হাজার। বাকি ৬ হাজার ছাত্রী আবাসন সুবিধার বাইরে আছেন। এ ছাত্রীদের বেশির ভাগই ক্যাম্পাসের আশপাশে ও শহরে মেস এবং কটেজে থাকেন। তাঁদের গুনতে হয় বাড়তি খরচ।

বিভিন্ন বিভাগের পাঁচ ছাত্রী প্রথম আলোকে বলেন, কোটি টাকা খরচ করে হল নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ শিক্ষার্থীরা থাকার সুযোগ পাচ্ছে না। হল চালু করতে কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা নেই। তাই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

হল চালু না করার বিষয়ে জানতে গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য শিরীণ আখতারের কার্যালয়ে গেলে তিনি কথা বলেননি। পরে হলের প্রাধ্যক্ষ প্রকাশ দাশ গুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, হলের অবকাঠামো প্রস্তুত। আসবাবও কেনা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের থাকার সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনো জনবল নিয়োগ ও নীতিমালা চূড়ান্ত করতে পারেনি। এ কারণে হলটি চালু হচ্ছে না। আর ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান বলেন, এ বছরই হল চালুর বিষয়ে চেষ্টা থাকবে।

নীতিমালা তৈরি নিয়ে বিরোধ

বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক প্রাধ্যক্ষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত হল নির্মাণের আগেই নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়। কোন বিভাগের শিক্ষার্থীরা হলে থাকবেন, হলের সার্বিক কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হবে—এ বিষয়গুলো নীতিমালায় উঠে আসে। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের নীতিমালা তৈরি করার জন্য গত বছরের শুরুতে ১৬ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক হলেন সহ-উপাচার্য বেনু কুমার দে। আর সদস্যসচিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান।

কমিটির দুই সদস্য নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমে ক্যাম্পাসের পাহাড়ি ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছাত্রীদের জন্য আসন বরাদ্দ দেওয়ার কথা ভেবেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে কমিটির সদস্যদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। ফলে কমিটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। পরে চলতি মাসের মাঝামাঝিতে নীতিমালার একটি খসড়া তৈরি করা হয়। এতে হলের ৬০ শতাংশ আসন পাহাড়ি ছাত্রীদের জন্য বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাকি ৪০ শতাংশ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা মেধার ভিত্তিতে পাবেন।

জানতে চাইলে কমিটির প্রধান বেনু কুমার দে প্রথম আলোকে বলেন, নীতিমালার খসড়া উপাচার্যের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এরপর সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। শেষ পর্যন্ত কারা থাকবেন, সেটি সিন্ডিকেটেই চূড়ান্ত হবে।

কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাব ও গাফিলতির কারণে হল চালু হচ্ছে না বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক জাকির হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হল এক দিনে তৈরি হয়নি। কয়েক বছর সময় নিয়ে নির্মাণকাজ হয়েছে। এ সময়ের মধ্যেই নীতিমালা চূড়ান্ত করতে পারত। জনবল নিয়োগের উদ্যোগ নিতে পারত। তখন এসব উদ্যোগ না নিয়ে এখন কোনো অজুহাতই গ্রহণযোগ্য হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেই শিক্ষার্থীরা আবাসন সংকটে ধুঁকছেন, ১৬ কোটি টাকার হল কোনো কাজে আসছে না।