সংবিধান বিতর্ক ১৯৭২: একটি অবশ্যপাঠ্য বই

সংবিধান বিতর্ক ১৯৭২ আসিফ নজরুল প্রথমা প্রকাশন

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গণপরিষদে দু-তিনজন বাদে প্রায় সব সদস্যই ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। তবে তাঁরা একসুরে, একভাষায় কথা বলেছেন এমন নয়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও স্বতন্ত্র সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তো বটেই, সরকারদলীয় বেশ কয়েকজন সদস্য গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন, ক্ষেত্রবিশেষে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। এমনকি ৩৪ সদস্যের খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ছয় সদস্য নোট অব ডিসেন্ট বা ভিন্নমত দিয়েছেন।

গণপরিষদের বিতর্কের বিষয়টি নিজস্ব পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়নসহ উঠে এসেছে লেখক, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুলের সদ্য প্রকাশিত সংবিধান বিতর্ক ১৯৭২: গণপরিষদের রাষ্ট্রভাবনা বইয়ে।

মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশের গণপরিষদ, যা মাত্র আট মাসের মধ্যে জাতিকে একটি গণমুখী সংবিধান উপহার দিয়েছে; ভারতে সংবিধান তৈরি করতে লেগেছিল আড়াই বছর, পাকিস্তানে ৯ বছর। আদি সংবিধানে বিবর্তনমূলক বা মানবাধিকার হরণকারী কোনো বিধান ছিল না; বরং এ সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করেছিল; ছিল বিচার বিভাগ থেকে শাসন বিভাগ আলাদা করা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী সংসদ গঠনের প্রত্যয়।

সংবিধানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রাদর্শ হিসেবে চার মূলনীতি ঘোষিত হয় যথাক্রমে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। মূলনীতির সঙ্গে সহমত পোষণ করেও গণপরিষদে যেসব বিষয়ে প্রাণবন্ত বিতর্ক হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মানুষের মৌলিক চাহিদা তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকা, সমাজতন্ত্র বা অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে গৃহীত কর্মসূচিগুলো যথেষ্ট কি না, প্রধানমন্ত্রীর হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেশকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে নিয়ে যাবে কি না, বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার নামে দেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর জাতিসত্তাকে অগ্রাহ্য করা ইত্যাদি।

সংবিধান বিতর্কে আমরা দেখতে পাই, সেই সময়ের জনপ্রতিনিধিরা দলের হয়ে নির্বাচিত হলেও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ৭০ অনুচ্ছেদের বিরোধিতা করতে গিয়ে অনেকে বলেছেন, দলীয় নির্দেশ অমান্য করার জন্য সদস্যপদ চলে যেতে পারে না। গণপরিষদের বিতর্ক দেখলে সংবিধানপ্রণেতাদের প্রজ্ঞা ও অধ্যবসায় ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ধর্মনিরপেক্ষতার স্বরূপ নিয়েও বিতর্ক হয়েছে, কেউ কেউ এই ধারণার সরাসরি বিরোধিতা না করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। বিতর্কে এসেছে, সংসদ সদস্যের অধিকার খর্বকারী ৭০ অনুচ্ছেদ, বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ এবং নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টিও।

১৯৭২ সালের সংবিধান নিয়ে রাজনৈতিক মহলে পরস্পরবিরোধী মত ছিল এবং এখনো আছে। কারও মতে এটি ছিল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান, আবার কেউ কেউ মনে করেন, পরবর্তীকালে বাংলাদেশ যে কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ঝুঁকেছে; তার বীজ মূল সংবিধানেই উপ্ত ছিল। অত্যন্ত বেদনার দিক হলো, আমাদের সংবিধান রচয়িতারা সংবিধান রচনাকালে যেসব অঙ্গীকার করেছিলেন; পরবর্তীকালে তার কমই বাস্তবায়িত হয়েছে।

পাকিস্তান আমলে ২৪ বছরের একনায়কাধীন শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে সংবিধানপ্রণেতারা সংসদীয় ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। কিন্তু তিন বছর না যেতেই তাঁরা সেই ব্যবস্থা বদলে একদলীয় রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থায় ফিরে গেলেন; নিবর্তনমূলক বিভিন্ন আইন চালু করলেন, পরবর্তী সামরিক-বেসামরিক শাসকেরাও সে ধারা বজায় রেখেছেন এবং নতুন করে কালো আইন জারি করেছেন। আসিফ নজরুল যথার্থই বলেছেন, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতবার সংবিধান সংশোধিত হয়েছে; তার মধ্যে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাকি সব কটিই হয়েছে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে। বৃহত্তর জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

ভারতসহ প্রায় সব দেশের গণপরিষদের বিতর্ক নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি তাত্ত্বিক আলোচনা হয়। গণপরিষদে আইনপ্রণেতারা কী বলেছেন, কোন উদ্দেশ্যে বলেছেন, তা নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলে। কিন্তু বাংলাদেশে সে রকম আলোচনা দেখা যায় না।

সে ক্ষেত্রে আসিফ নজরুল রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো, শাসনপদ্ধতি, গণতন্ত্র, সংসদ সদস্যদের অধিকার খর্ব করা ইত্যাদি বিষয়ে গণপরিষদে যেসব বিতর্ক হয়েছে, তার নির্যাস তুলে ধরে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। আসিফের বই থেকে আমরা জানতে পারি, নির্বাচনী সংকট ও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে এখন যেসব সংকট তৈরি হয়েছে, ৫০ বছর আগে আমাদের সংবিধানপ্রণেতারা সেসব নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

আসিফ নজরুল তাঁর এই বইয়ের সংযোজনীতে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ছয় সদস্যের ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্ট তুলে দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ন্যাপের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আওয়ামী লীগের আছাদুজ্জামান খান, এ কে এম মুবাররক হোসেন আকন্দ, আবদুল মুন্তাকীম চৌধুরী, হাফেজ হাফীজুর রহমান ও ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল।

এসব জনপ্রতিনিধির অন্তত পাঁচজন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সঙ্গে দ্বিমত করেছেন, যা আজকের দিনে কল্পনাও করা যায় না। রাষ্ট্রকাঠামোর বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা যে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন, পরবর্তীকালে তা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

আসিফ নজরুলের সংবিধান বিতর্ক ১৯৭২: গণপরিষদের রাষ্ট্রভাবনা বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। মূল্য ৫০০ টাকা। আইনের শিক্ষক তো বটেই, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে যাঁরা চিন্তাভাবনা করেন, তাঁদের জন্যও এই বই অবশ্যপাঠ্য।