উপাত্ত সুরক্ষা আইন পাসের সময় খসড়া পাল্টে যাওয়ার আশঙ্কা গণমাধ্যমকর্মীদের

প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২২ নিয়ে আজ আইসিটি ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় মতবিনিময় সভাছবি: সংগৃহীত।

প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২২–এর সর্বশেষ খসড়ায় বেশ কিছু পরিবর্তন এনে বিতর্কিত অনেক ধারাই বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে গণমাধ্যমকর্মীদের আশঙ্কা, ভেটিং বা আইন পাসের সময় বিতর্কিত বিষয়গুলো রাখা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উদাহরণ টেনে তাঁরা বলেছেন, আইনটির অপপ্রয়োগের কারণে তা বিতর্কিত হয়েছে।

আজ বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে আইসিটি ভবনে প্রস্তাবিত ‘উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২২’ নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আইসিটি বিভাগের মতবিনিময় সভায় এ আশঙ্কার কথা উঠে আসে।

মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, একটি দেশের উন্নয়নের জন্য এ ধরনের আইন (উপাত্ত সুরক্ষা আইন) দরকার। কিন্তু আইনের প্রয়োগিক দিক হচ্ছে বিপজ্জনক।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮–এর প্রসঙ্গ টেনে মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, গণমাধ্যমকর্মীরা আইনটির বিপক্ষে না। তবে কিছু ধারার বিপক্ষে। কিছু ধারা সংশোধনের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। সে সময়ও আলোচনার টেবিলে আইনের অপপ্রয়োগ হবে না বলে সবাই আশ্বাস দেন। কিন্তু কারও কথা রাখা হয়নি। অপপ্রয়োগ শুরু হলে কাউকে পাওয়া যাবে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের পর থেকে বাংলাদেশ প্রেস ফ্রিডম সূচকে নিচেই নামছে।

উপাত্ত সুরক্ষা আইন নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক হবে, ভেটিং হবে। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে কী হবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে এই সাংবাদিক নেতা প্রথম খসড়া থেকে চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত সব খসড়ার কপি সংগ্রহে রাখার পরামর্শ দেন সাংবাদিকদের। যাতে আইন চূড়ান্ত হলে কী কী রাখা হয়েছে, তা মিলিয়ে দেখা যায়।

এডিটরস গিল্ড বাংলাদেশের সভাপতি মোজাম্মেল হক বাবু বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জনগণের জন্য যে ফাঁদগুলো আছে, তা এই প্রস্তাবিত আইনেও আছে। এ আইনের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। সাধারণ জনগণকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আইনটি হতে হবে। মানুষকে সুরক্ষা দেওয়াই যদি উদ্দেশ্য হয়, তবে তা সরকারের ভেতরে থেকে করা যাবে না। কারণ, সরকারের সঙ্গেই বিরোধ তৈরি হয়। এ নিয়ে স্বাধীন কমিশন হতে হবে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দরকার আছে, কিন্তু সাংবাদিকেরা এ আইনের ভুক্তভোগী হচ্ছেন জানিয়ে মোজাম্মেল হক বাবু বলেন, সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, সাংবাদিকদের এ আইনের আওতায় আনা হবে না। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে তা করা হয়নি। উপাত্ত সুরক্ষা আইনেও তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বাদ দিয়ে আইনটি পাস করা হতে পারে বলে আশঙ্কা তাঁর।

তবে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা দিতে ও দেশের ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্যই এ আইন করা হচ্ছে বলে জানান আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ। তিনি বলেন, দেশের অনেক সংস্থাই তাদের তথ্য বিদেশের বিভিন্ন ক্লাউডে রাখছে। আইনটি করা হচ্ছে এ জন্যই যে আইন হওয়ার পরে কেউ যেন তথ্য দেশের বাইরে না রাখে বা সম্মতি ছাড়া রাখতে না পারে। ব্যক্তির গোপনীয়তা ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা যাতে কেউ বিঘ্নিত করতে না পারে সে উদ্দেশ্যে এ আইন। পাশাপাশি এটাও উদ্দেশ্য, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য যেন সঠিকভাবে ব্যবস্থপনা করা যায়।

প্রতিমন্ত্রী জানান, আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকের আগে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। সামনে বিভিন্ন বহুজাতিক ব্যাংক, প্রতিষ্ঠান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও মতবিনিময় হবে। এরপর আইনটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে।

প্রস্তাবিত আইনের ৬৬ ধারায় বলা আছে, আইনের উদ্দেশ্যে পূরণের জন্য বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে সরকার মহাপরিচালককে যেকোনো নির্দেশ প্রদান করতে পারবে। মতবিনিময় সভায় এই ধারার উদ্দেশ্য নিয়েও আলোচনা করা হয়।

এ বিষয়ে সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব ও আইসিটি বিভাগের আইনি পরামর্শক মো. শহীদুল হক বলেন, সব মানুষ সৎ হবে বা ভালো চিন্তা করবে তা না। তবে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ বলেন, সরকার নির্দেশ দিলে তা এমনিতেই মহাপরিচালক মানতে বাধ্য। এটা সংবিধান দ্বারা সংরক্ষিত। এ ধারা না দিলে যদি ক্ষতি না হয় তবে অতিরিক্ত একটা ধারা যুক্ত করার দরকার আছে কি না, সেই বিষয়টি ভাবার দরকার আছে।

সভার শুরুতে খসড়াটি নিয়ে একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের পরিচালক তারেক এম বরকতউল্লাহ। তিনি জানান, ২১টি জায়গা থেকে মতামত এসেছে। সবার মতামতই আমলে নেওয়া হয়েছে। আজকের সভার পরও যে মতামত আসবে, সেগুলোর ভিত্তিতে সংশোধিত খসড়া ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। এর ওপর ১০ দিনের মধ্যে লিখিতভাবে মতামত দেওয়া হলে তা গ্রহণ করা হবে।

তারেক এম বরকতউল্লাহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যোগ্যতা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আছে এমন ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার উপাত্ত সুরক্ষা এজেন্সি গঠন করবে জানিয়ে বলেন, আইনটি নিয়ন্ত্রণমূলক কিছু হবে না। এ ছাড়া বৈশ্বিক ব্যবসার ক্ষেত্রে যাতে কোনো বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেটাও বিবেচনাও নেওয়া হচ্ছে। ক্রস বর্ডার ডেটা স্থানান্তরের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন (জিডিপিআর) বিস্তারিত দেখা হয়েছে। তাদের নিয়মনীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় প্রযোজ্য নয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জাতি সংস্থার (আসিয়ান) ক্রস বর্ডার প্রাইভেসি রুলস বিবেচনায় নিচ্ছে সরকার। তবে তা চূড়ান্ত হয়নি, বিশ্লেষণ চলছে বলেও জানান তিনি।

সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা আইসিটি বিভাগের বিজিডি ই-গভর্নমেন্ট কম্পিউটার ইনসিডেন্স রেসপন্স টিম (সার্ট) উপাত্ত সুরক্ষা এজেন্সিতে টেকনিক্যাল উইং হিসেবে কাজ করবে।

মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য দেন আইসিটি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব এন এম জিয়াউল আলম, অতিরিক্ত সচিব রণজিৎ কুমার, টেকনোলজি মিডিয়া গিল্ড বাংলাদেশের (টিএমজিবি) সভাপতি মো. কাউছার উদ্দিন, কম্পিউটার বিচিত্রা সম্পাদক ভূঁইয়া মোহাম্মদ লেলিন প্রমুখ।