চিকিৎসায় অবহেলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ

চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীর মৃত্যু বা অন্য কোনো ধরনের ক্ষতির অভিযোগ আমাদের দেশে নতুন নয়। সম্প্রতি ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নবজাতক ও প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনাটি নিয়ে ব্যাপক শোরগোল তৈরি হয়। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই বুধবার রাতে রাজধানীর শ্যামলীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে আরও একজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। রোগীর স্বজনেরা অভিযোগ করেছেন, চিকিৎসকের অবহেলার কারণেই এ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা নিয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার উদাহরণ খুব কম।

চিকিৎসায় অবহেলা বলতে যা বোঝায়

একজন চিকিৎসকের কাছে যখন একজন মানুষ (রোগী) চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন, তখন লিখিত থাকুক বা না থাকুক উভয়ের মধ্যে একটি অলিখিত সুনির্দিষ্ট চুক্তির সৃষ্টি হয়। সেখানে অর্থের বিনিময়ে বা বিনিময় ছাড়াই সেবা প্রদানের বিষয়টি মুখ্য হয়ে ওঠে। এই চুক্তি বলবৎ থাকা অবস্থায় চিকিৎসকের অবহেলার কারণে যদি কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাহলে এ বিষয়ে তাঁর আইনি প্রতিকার লাভের সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়। আইনি পরিভাষায় ‘মেডিকেল নেগলিজেন্স’ বা চিকিৎসায় অবহেলা বলতে মূলত চিকিৎসক ও রোগীর চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত অন্য ব্যক্তিদের অবহেলাকেই বোঝায়।

চিকিৎসায় অবহেলা শুধুই ‘অপারেশন’ বা অস্ত্রোপচারসংশ্লিষ্ট নয়, এর বাইরেও রোগীকে সঠিকভাবে পরীক্ষা না করা, রোগীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, ফি নিয়ে দর-কষাকষি, ভুল ওষুধ দেওয়া, মৃত রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি রাখা, রোগীর ওপর জোর খাটানো, রোগীকে চিকিৎসা না দিয়ে অন্যত্র প্রেরণ করা, আইনি জটিলতার কথা ভেবে চিকিৎসা না দিয়ে রোগীকে ফেলে রাখা, হাসপাতালের শয্যা খালি না থাকার অজুহাতে চিকিৎসা না দেওয়া, স্বাস্থ্যগত বিষয়ে ভুল রিপোর্ট দেওয়া—এগুলোও চিকিৎসা অবহেলার অন্তর্ভুক্ত। চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণসহ অনেক বিষয়ে ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেজিস্ট্রেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’-এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

চিকিৎসায় অবহেলার আইনি প্রতিকার

চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে বিশ্বের অনেক দেশে টর্ট আইনে মামলা করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে টর্ট আইনে বিচারের জন্য আদালতব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতে অভিযুক্ত চিকিৎসকের শাস্তি চেয়ে বা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে হয়। চিকিৎসায় অবহেলার বিষয়ে আমাদের দেশে কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। এ কারণে কোন কোন কাজগুলো চিকিৎসায় অবহেলা হিসেবে গণ্য হবে এবং অবহেলার প্রমাণ পেলে কখন দেওয়ানি বা কখন ফৌজদারি মামলা করা যাবে, কী পরিমাণ শাস্তি বা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, সেসব বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। এ কারণে এসব মামলার ক্ষেত্রে অন্য আইনগুলোতে থাকা অবহেলা ও ক্ষতিপূরণসংক্রান্ত বিধান এবং আদালতের নজিরের ওপর নির্ভর করতে হয়।

১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩০৪এ ধারামতে, কোনো ব্যক্তি বেপরোয়াভাবে বা অবহেলাজনিত কোনো কাজের মাধ্যমে কারও মৃত্যু ঘটালে এবং সেই অপরাধ শাস্তিযোগ্য নরহত্যা না হলে, তবে সেই ব্যক্তি অবহেলাকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন। এ জন্য তাঁকে পাঁচ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদে সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। এই ধারা অনুসারে অপরাধ হয়েছে কি না, তা প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় তিনটি উপাদানের ওপর নির্ভর করতে হবে। সেগুলো হলো, অবহেলার কারণে ব্যক্তিটি মৃত্যুবরণ করেছিল, অবহেলার কারণেই মৃত্যুটি সংগঠিত হয়েছিল এবং অবহেলাটি দায়মুক্তির নরহত্যা হিসেবে বিবেচিত নয়। এ ধারা অনুসারে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ উঠলে আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ অভিযুক্ত চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করতে পারবেন। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতগুলো এসব ক্ষেত্রে একজন চিকিৎসককে রুটিনমাফিক গ্রেপ্তারে নিরুৎসাহিত করেছেন।

চিকিৎসা অবহেলার কারণে ক্ষতিপূরণ চেয়ে ভুক্তভোগী মামলা করতে পারবেন। অধস্তন আদালত ছাড়াও সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুসারে চিকিৎসায় অবহেলার কারণে হাইকোর্টে রিট করা যাবে। এসব মামলায় ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কিছু নজির রয়েছে। তবে রোগীর ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। তাই চিকিৎসা অবহেলা ও এর ফলে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের বিষয়টি আদালতের বিবেচনাপূর্ণ এখতিয়ারের ওপর নির্ভর করে।

প্রমানন্দ কাটার বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া মামলায় একজন স্কুটারচালক সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন এবং একজন পথিক ওই চালককে কাছের একটি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু চিকিৎসক ওই স্কুটিচালককে হাসপাতালে ভর্তি না করে অন্য একটি হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার পরামর্শ দেন। এ হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালটির দূরত্ব ছিল প্রায় ২০ কিলোমিটার। এ মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত দেন, খুব গুরুতর আহত কোনো রোগী যদি হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য আবেদন করেন, তাহলে দায়িত্বরত চিকিৎসক ওই রোগীকে চিকিৎসা দিতে কোনো রকম বিলম্ব করতে পারবেন না। এমনকি পুলিশি উপস্থিতির জন্য বা কোনোপ্রকার আইনি জটিলতার জন্যও রোগীকে চিকিৎসা না দিয়ে ফেলে রাখতে পারবেন না। মামলাটির সিদ্ধান্ত খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হওয়ায় বাংলাদেশের উচ্চ আদালতও একই রকম নির্দেশনা দিয়েছেন।

চিকিৎসকের ‘দায়মুক্তি’

চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর প্রতি অবহেলা করবেন না, এটাই স্বাভাবিক। নিজের বুদ্ধিমত্তা ও পেশাগত দক্ষতা প্রয়োগ করেই তাঁরা সাধারণত চিকিৎসাসেবা প্রদান করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করার পরও কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তার জন্য চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীকে দায়ী করার সুযোগ নেই। অভিযোগকারীর বক্তব্য শুনে একই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক যদি চিকিৎসায় অবহেলা হয়নি—এমন মতামত দেন, তাহলে সে মামলা থেকে অভিযুক্ত চিকিৎসক সহজেই অব্যাহতি পেয়ে যাবেন। জ্যাকব ম্যাথিউস বনাম পাঞ্জাব মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, ‘অনেক সময় চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয় অনৈতিকভাবে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সমাজের স্বার্থে আইনের এ অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। চিকিৎসকদের মিথ্যা মামলার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।...’ তাই চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অবহেলার সুস্পষ্ট অভিযোগ না থাকলে অযথা মামলা করে হয়রানি করা থেকে সবার সতর্ক থাকা উচিত। চিকিৎসায় অবহেলার বিষয়টি যেমন কারও কাম্য নয়, তেমনি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যাতে ভয়ভীতি ছাড়া স্বাধীনভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন, তেমন পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

বাহাউদ্দিন আল ইমরান আইনজীবী