ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক নাম ব্যবহার করলে কমবে ওষুধের দাম

ওষুধের জেনেরিক নাম ব্যবহার নিয়ে নীতিবিষয়ক সংলাপের আয়োজন করে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন, ২৫মেছবি: প্রথম আলো

সীমিত আকারে হলেও ব্যবস্থাপত্রে (প্রেসক্রিপশন) ওষুধের জেনেরিক নাম (ওষুধের মূল উপাদানের নাম) ব্যবহার শুরু করা দরকার। ফলে ব্যবস্থাপত্রে চিকিৎসকদের নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওষুধের নাম লেখার হার কমতে পারে। ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও ওষুধ বাজারজাতকরণের জন্য ‘আগ্রাসি নীতির’ মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় থেকে সরে আসতে পারে এবং ওষুধের দাম কমতে পারে।

ওষুধের জেনেরিক নাম ব্যবহার নিয়ে আজ শনিবার এক নীতি সংলাপে এসব কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট এ সংলাপের আয়োজন করে। ‘ক্যান দ্য ইউজ অব জেনেরিক নেমস ইন প্রেসক্রিপশন্স এফেক্টিভলি কন্ট্রোল অ্যাগ্রেসিভ ড্রাগ মার্কেটিং ইন বাংলাদেশ?’ ( চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক বা রাসায়নিক নাম ব্যবহার বাংলাদেশে ওষুধের আগ্রাসি বাজারজাতকরণ কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কি?) শিরোনামের এই সংলাপে স্বাস্থ্যবিষয়ক সরকারি কর্মকর্তা, চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, জনস্বাস্থ্য–বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন।

সংলাপে জেনেরিক নাম ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে একই ওষুধ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একই মান বজায় রেখে উৎপাদন করছে কি না, তা জানতে বায়োএকুইভ্যালেন্স (ওষুধ আবিস্কারের সময় মূল উপাদান ছিল যতটুকু) পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা, যত্রতত্র ওষুধের দোকান চালু নিয়ন্ত্রণ করা, ঠিক ওষুধ দেওয়া হচ্ছে কি না, তা বুঝতে দক্ষ ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ দেওয়া এবং যেখান-সেখান থেকে নিজেদের ইচ্ছেমতো ওষুধ কিনে খাওয়া থেকে বিরত থাকতে রোগীদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি জেনেরিক নাম ব্যবহার করা হলে দোকানে বসে থাকা অদক্ষ কেমিস্ট বা দোকানদারদের মাধ্যমে মানহীন ওষুধ রোগীর হাতে চলে যায় কি না, সেটা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করা হয়।

সংলাপে জানানো হয়, ১৯৮২ সালে ওষুধনীতি কার্যকর হয়। দেশ এখন ওষুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মাত্র ১-২ শতাংশ ওষুধ আমদানি করতে হয়। ১৫০টি দেশে এখন বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হয়। ৩২২টি নিবন্ধিত অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ উৎপাদন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া নিবন্ধিত ২০৬টি আয়ুর্বেদিক ও ২৮৭টি ইউনানি ওষুধ উৎপাদন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশে ওষুধের বাজার ৪০ হাজার কোটি টাকার। বায়োএকুইভ্যালেন্স পরীক্ষায় খরচ বেশি হয় বলে এ পরীক্ষা ছাড়াই দেশের ভেতর ওষুধ বিক্রি করা হয়।

সংলাপে প্যানেল আলোচকের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, স্বাস্থ্য খাতে ওষুধ নিয়ে যত আলোচনা হয়, রোগ প্রতিরোধ নিয়ে তত আলোচনা হয় না। ওষুধ খাতে নিয়ন্ত্রণ আনা গেলে স্বাস্থ্য খাতে দৃশ্যমান উন্নয়ন সম্ভব। সরকার জেনেরিক নামে অন্তত ২৮০টি ওষুধ বিনা মূল্যে রোগীদের সরবরাহ করার দায়িত্ব নিক। এতে সরকারের ব্যয় হতে পারে পাঁচ-ছয় হাজার কোটি টাকা। এটা করা হলে ওষুধ কিনতে গিয়ে রোগীকে যে বিপুল ব্যয় করতে হয়, তা থেকে অন্তত ১০-১২ হাজার কোটি টাকার বোঝা রোগীর ঘাড় থেকে নেমে যাবে।

নিবন্ধিত চিকিৎসকদের ওষুধের জেনেরিক নাম লিখতে বাধ্য করা গেলে ওষুধ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওষুধ বিক্রির আগ্রাসি ব্যবস্থাও বন্ধ হবে বলে মনে করেন সায়েদুর রহমান। তিনি আরও বলেন, দেশে দুই লাখের বেশি ওষুধের দোকান (ফার্মেসি) আছে। এতসংখ্যক ওষুধের দোকান থাকার মানে হলো সরকারের সেসব নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা নেই।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ওষুধ এমন একটি পণ্য, যাতে শতভাগ মান নিশ্চিত করতে না পারলে রোগী স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে। গ্রামে নজরদারি দুর্বল। তাই সেখানে মানহীন ওষুধ বিক্রি বেশি হয়।

মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মুনীরউদ্দিন আহমদ বলেন, চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রে জেনেরিক ও বড় অক্ষরে ওষুধের নাম লিখতে ২০১৭ সালে সরকারকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। সেটি কার্যকর হয়নি। অথচ জেনেরিক নাম না লেখার বিকল্প নেই।

চিকিৎসকদের কাছে প্রচার বাবদ ওষুধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে মোট ওষুধ বিক্রির ১০ শতাংশ ব্যয় করতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ দেশ থেকে ওষুধ রপ্তানির সময় বায়োএকুইভ্যালেন্স পরীক্ষা করেই পাঠাতে বাধ্য হয় ওষুধ প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ দেশের ভেতরে আমরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো বায়োএকুইভ্যালেন্স পরীক্ষা ছাড়াই ওষুধ ব্যবহার করছি।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক আহমেদুল কবির বলেন, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ও বেসরকারি দুটো সেবা খাতকে সমন্বয় করে নিয়মের মধ্যে আনতে না পারলে রোগীর পকেট থেকে অতিরিক্ত ব্যয় কমানো যাবে না। পুরো স্বাস্থ্যপ্রক্রিয়ায় সংস্কার আনতে হবে। চিকিৎসকদের নৈতিকতা থাকতে হবে। রোগীদেরও সচেতন হতে হবে।

সংলাপটি সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, দেশে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) ও দুটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে জেনেরিক নামে ওষুধ দেন। যেমন প্যারাসিটামল হচ্ছে জেনেরিক নাম। ট্যাবলেট, সিরাপসহ দেশে বিভিন্ন ওষুধ প্রতিষ্ঠানের (ব্র্যান্ডের) অন্তত ৫৪৩ ধরনের প্যারাসিটল আছে। যেসব হাসপাতালের ফার্মেসিতে নিজস্ব দক্ষ ফার্মাসিস্ট আছেন, তাঁরা জেনেরিক নাম শুরু করতে পারেন। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে শুরু হতে পারে। প্রয়োজনে জেনেরিক নামের সঙ্গে ব্র্যান্ডের নাম ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে ওষুধ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওষুধ প্রচারের জন্য চিকিৎসক বা অন্য কারও ওপর নির্ভর করতে হবে না এবং ওষুধেরও দাম কমবে।

মুক্ত আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ও বর্তমানে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ক্যানসার হাসপাতালের প্রকল্প সমন্বয়কারী অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ তালুকদার, জনস্বাস্থ্য–বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল, ফার্মাসিস্ট তানভীর আশরাফ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান শিখা গাঙ্গুলী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সাবেক প্রধান অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ফাতেমা আশরাফসহ অনেকে।