রনবীর কার্টুন নিয়ে বই: টোকাইয়ের চোখে সমাজের ছবি

এই বালককে সবাই চেনেন। পরনে চেক লুঙ্গি, উদাম গা, ন্যাড়া মাথা। কখনো সে শুয়ে থাকে রাজধানীর ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে। কখনো সারি করে রাখা পাইপের ভেতরে। পা ছড়িয়ে বসে থাকে ডাস্টবিন বা পার্কের বেঞ্চের পাশে। মাঝেমধ্যে সে থাকে খোশমেজাজে। কখনো উদাসীন।

কাঁধে থাকে একটি বস্তা। এটিই তার সম্বল। একবার এক পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসা করছে ‘বস্তা ভর্তি কইরা কী টোকাইছিস?’ তার নির্বিকার উত্তর ‘এই…সবতের বস্তাপচা কথাওয়ালা কাগজ। মানে খবরটবরওয়ালা কাগজ আরকি…।’ এই হলো টোকাই।

টোকাইকে নানাজনে নানা ধরনের প্রশ্ন করে। টোকাই তার মতো করে উত্তর দেয়। সেই উত্তরে কখনো থাকে সমাজের অসংগতির ওপর তীব্র কশাঘাত, ওপরতলার মানুষের স্বার্থপরতার প্রতি বিদ্রূপ। রাজনীতি ও রাজনীতিকদের প্রতি কটাক্ষ।

এই টোকাই সবারই খুব চেনা। ইমেরিটাস অধ্যাপক, সমকালের অন্যতম বহুমাত্রিক সৃজনী প্রতিভা, শিল্পী রফিকুন নবীর এই অবিস্মরণীয় কার্টুন চরিত্রটি দেশের সুবিধাবঞ্চিত ছিন্নমূল শিশুদের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের পরিচিতিসূচক ‘টোকাই’ নামটিও বাংলা ভাষার একটি শব্দ হিসেবে বাংলা একাডেমির অভিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফলে ‘রনবী’ নামে আঁকা তাঁর এই কার্টুন চরিত্রটি আমাদের ভাষা ও ভাবনায় পেয়েছে চিরস্থায়িত্ব। গত ছয় দশকে আঁকা তাঁর টোকাই ও বিভিন্ন কার্টুন নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে রনবীর কার্টুন (১৯৬৯-২০২৩): টোকাই ও অন্যান্য নামের চার খণ্ডের বই।

প্রায় আট হাজার কার্টুন রয়েছে এই বইয়ে। এতে আছে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত টোকাই, দৈনিক বাংলা, দৈনিক জনকণ্ঠসহ বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিদিনের কার্টুন, বিশেষ সংখ্যার কার্টুন, বিচিত্র বিষয়ের কার্টুন, সাপ্তাহিক বিচিত্রা সাপ্তাহিক ২০০০–সহ বিভিন্ন সাময়িকীতে কার্টুন নিয়ে করা প্রচ্ছদ প্রভৃতি। সাদা-কালোর পাশাপাশি রঙিন কার্টুনও রয়েছে অনেক।

সমাজ, রাজনীতি, বিশ্বপরিস্থিতি, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, পরিবেশ, নাগরিক সমস্যা, উৎসব-আনন্দ মিলিয়ে বহু বিষয় নিয়ে কার্টুন করেছেন শিল্পী রফিকুন নবী। অঙ্কনের নান্দনিকতা ও বক্তব্যের সরসতার পাশাপাশি গত ছয় দশকের রাজনীতি ও সমাজজীবনের ইতিহাসও ধারণ করে আছে এই কার্টুনগুলো। আর এসব কার্টুন আঁকার প্রেক্ষাপট নিজের জীবন ও শিল্পসাধনা নিয়ে একটি বেশ বড় ভূমিকাও লিখেছেন শিল্পী নিজের সম্পাদিত এই বইয়ে।

কার্টুন করতেন ছাত্রজীবন থেকেই। তবে টোকাই আঁকা শুরু করেছিলেন অধুনা বিলুপ্ত সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায়, ১৯৭৮ সালের এপ্রিলের কোনো এক সংখ্যায়। শিল্পী রফিকুন নবী প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম টোকাইটি তাঁর সংগ্রহে নেই। শহরের ফুটপাতে তক্তার বেঞ্চে বসে শিশুটি ইটের পর ইট সাজাচ্ছে। শহুরে নাগরিক তাকে জিজ্ঞাসা করছে, ‌‘কী করিস?’ টোকাই বলছে, ‘বড় সাহেব বড় সাহেব খেলতাছি।’

রফিকুন নবী বললেন, ‘সব কটি কার্টুন সংগ্রহে নেই। এই কার্টুনগুলোর সঙ্গে ছয় দশকের বহু মানুষের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কার্টুনগুলো তাদের ভালো লেগেছিল। সেখান থেকে বাছাই করে বই আকারে কার্টুনগুলো প্রকাশ করা হলো। অনুরাগীরা এগুলো নতুন করে দেখার পাশাপাশি ফেলে আসা দিনের স্মৃতিও মনে করতে পারবেন। অনেক কিছু মনে পড়বে।’ তিনি বললেন, ‘পরিকল্পনা আছে একটি ওয়েবসাইট করে সব কার্টুন আর অন্য মাধ্যমের শিল্পকর্মগুলো সেখানে দিয়ে দেব। তাতে আমার কার্টুনের অনুরাগী দর্শক বা যাঁরা গবেষণা করতে চান, তাঁদের সুবিধা হবে।’

আজ ২৮ নভেম্বর শিল্পীর ৮০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর অমর সৃষ্টি ‘টোকাই’ আর অন্যান্য প্রায় আট হাজার কার্টুনসহ বিভিন্ন সময় শিল্পীর আঁকা রাজনৈতিক পোস্টার, ফেস্টুন, বইয়ের প্রচ্ছদ, অলংকরণ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে শুরু হচ্ছে বিশেষ প্রদর্শনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মাকসুদ কামাল বেলা তিনটায় প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন।

বইটির প্রকাশক গ্যালারি চিত্রকের নির্বাহী প্রকাশক শিল্পী মুনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বললেন, বই হিসেবে চিত্রকের এটি প্রথম প্রকাশনা। ৪ খণ্ডে সাড়ে ৮ বাই ১২ ইঞ্চি মাপের প্রতিটি বইয়ে ১৫২টি পৃষ্ঠা রয়েছে। অফসেট কাগজে ছাপা। শক্ত ও সুদৃশ্য বক্সে রয়েছে চারটি বইয়ের সেট। আগ্রহীদের ব্যক্তিগত সংগ্রহকেও সমৃদ্ধ করবে।

রনবীর কার্টুন নিয়ে চার খণ্ডের এই বইয়ের চতুর্থ খণ্ডের শেষ প্রান্তে ‘বিবিধ’ শাখায় একটি কার্টুন আছে। সড়ক ঝাড়ু দিচ্ছে এক ছিন্ন বেশভূষার লোক। শহুরে ভদ্রজন প্রশ্ন করছেন ‘কি ঝাড়ু দিচ্ছো?’ উত্তর হলো ‘রাজনীতিতে বলা গত বছরের মিছা কথাগুলারে…।’ সেই দৃশ্য দেখে হয়তো অনেকেরই মনে হবে, অনেক কিছুই আসলে ঝাড়ু দিয়ে সরিয়ে ফেলা দরকার। এমন করে তিনি বলতে পেরেছিলেন বলেই রনবী ভালোবাসার জায়গা করে নিতে পেরেছেন মানুষের মনে।