বিশ্ববাজার থেকে কোন দেশ কত দামে চাল–গম কিনছে, সেই তথ্য এখন আর কারও পক্ষে লুকানো সম্ভব নয়। ইন্টারনেটের যুগে প্রতি মুহূর্তে খাদ্যপণ্যের দাম জানা যায়। এর মধ্যেও সরকার রাশিয়ার কাছ থেকে প্রতি টনে ৫০ ডলার বেশি দিয়ে ৫ লাখ টন গম কেনার চুক্তি করেছে।
শুধু গমের ক্ষেত্রেই যে এমনটা হয়েছে তা নয়, চাল কেনার ক্ষেত্রেও ভিয়েতনামের একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থার কাছ থেকে অন্য রপ্তানিকারক দেশের তুলনায় প্রতি টনে ৫৬ ডলার বেশি দাম দিয়ে ২ লাখ ৩০ হাজার টন চাল কেনার অভিযোগ উঠেছে।
বেশি দামে চাল-গম কেনার এ অভিযোগ অবশ্য নতুন নয়। এর আগে ২০১৭ সালে কামরুল ইসলাম খাদ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম থেকে বেশি দামে চাল এবং রাশিয়া থেকে বেশি দামে গম আমদানির অভিযোগ উঠেছিল। ২০১৫ সালের জুনে ব্রাজিল থেকে নিম্নমানের গম আমদানির অভিযোগও ওঠে। পরে ওই গমের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
এদিকে গত আগস্টে বিশ্বের তিনটি দেশের সঙ্গে চাল কেনা নিয়ে আলোচনা শুরু করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ভিয়েতনামের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি দাম হাঁকায়। তারা প্রতি টন সেদ্ধ চাল ৫২১ ডলারে, আতপ চাল ৪৯৪ ডলারে দিচ্ছে। তা–ও আতপ চাল ভিয়েতনাম নিজে সরবরাহ করবে, সেদ্ধ চাল থাইল্যান্ড থেকে এনে দেবে। আর ভারত থেকে চাল কেনা হচ্ছে প্রতি টন ৪৪৩ দশমিক ৫ ডলার দরে। মিয়ানমারের সঙ্গে ৪৬৫ ডলার করে চাল কেনার ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছে। শিগগিরই ওই চাল আনার জন্য চুক্তি হতে যাচ্ছে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
অন্য দেশ ও সংস্থাগুলোর চেয়ে বেশি দামে চাল-গম কেনা নিয়ে জানতে চাইলে খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের জরুরি ভিত্তিতে চাল-গম কেনা দরকার। বিশ্ববাজারে দাম আবারও কখন বেড়ে যায় তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই আমরা আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাজার পরিস্থিতির একটি পূর্বাভাসকে মাথায় রেখে ওই চাল-গম কেনায় রাজি হয়েছি। পরীক্ষিত ও নিশ্চিতভাবে চাল সরবরাহ করবে, এমন দেশ ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা খাদ্য কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়ের সুযোগ নেই।’
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভিয়েতনামের রাষ্ট্রীয় সংস্থা ভিনা ফুড–২ বাংলাদেশকে ওই বাড়তি দামে চাল সরবরাহ করবে। ওই রাষ্ট্রীয় কোম্পানির বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে শাহনেওয়াজ ট্রেডিং নামের একটি প্রতিষ্ঠান। আর রাশিয়ার গম আমদানির ক্ষেত্রে রাশিয়ার পক্ষে ন্যাশনাল ইলেকট্রনিকস নামের একটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান সমঝোতাকারী হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। সংস্থাটি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম সরবরাহের ব্যবসা করে থাকে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে চলতি বছর বেসরকারি খাতের মাধ্যমে ১০ লাখ টন চাল কেনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে গম কেনার ক্ষেত্রে কোনো সরকারি অনুমোদনের দরকার হয় না। আর সরকার নিজে ১০ লাখ টন চাল ও গম চারটি দেশের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তির মাধ্যমে কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সম্ভাব্য সংকটের আশঙ্কায় সরকার থেকে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পর্যাপ্ত মজুত গড়ে তুলতে তা করা হচ্ছে বলে সরকার থেকে বলা হয়েছে। তবে সরকার থেকে এ–ও বলা হচ্ছে যে বাজারে চালের দাম কমতে শুরু করেছে।
রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে বিশ্ববাজারে গম রপ্তানি শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে গমের দাম কমতে শুরু করেছে। আর দেশে চাল আমদানি শুরু হওয়ায় দাম কমছে বলে পর্যবেক্ষকেরা বলছেন। আগামী অক্টোবরে আমন ধান ওঠা শুরু করবে। তাতে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে চালের দাম আরও কমতে পারে বলে আশা করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এই পরিস্থিতির মধ্যেও কেন সরকার বেশি দামে চাল–গম কিনছে, এই প্রশ্ন গতকাল খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনেও উঠেছিল।
খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অনুমিত দরের চেয়ে সাত ডলার কমে গম কেনা হচ্ছে।’
সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চাল-গমের দাম ওঠানামা করে। গত সপ্তাহের চেয়ে এই সপ্তাহে তিন ডলার কম দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ কেনার জন্য যখন দর-কষাকষি করে, তখন দাম বেশি ছিল।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে খাদ্য রপ্তানি নিয়ে সমঝোতার পর বিশ্ববাজারে গমের দাম কমতে শুরু করেছে। বেসরকারি খাত অপেক্ষায় আছে দাম আরও কমলে তারা ঋণপত্র খুলবে। রাশিয়ায় উৎপাদন বাড়বে বলে পূর্বাভাস রয়েছে।
বিশ্বের অন্যতম বড় চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে চালের দাম কমতে শুরু করেছে। ভারত এ বছর গত বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি চাল বিশ্ববাজারে রপ্তানি করতে যাচ্ছে বলে বিশ্বব্যাংকের চালের বাজারবিষয়ক গত আগস্টের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামও বিশ্ববাজারে চালের সরবরাহ বাড়াচ্ছে। আমনও নভেম্বর মাসে কাটা শুরু হয়ে যাবে। এ সময়ে বেশি দামে চাল–গম কেনা প্রশ্ন তৈরি করে।