আইপিএস নিয়ে অবস্থান
ভূরাজনীতিতে কারও পক্ষ নয়, মনোযোগ অর্থনীতিতে
বাংলাদেশ ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় দৃষ্টিভঙ্গির খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এতে প্রতিরক্ষা ও সামরিক উপাদানগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য নিরাপত্তা যে পূর্বশর্ত, সে বিষয়ে জোর দিয়ে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কৌশলের (আইপিএস) বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানপত্র চূড়ান্ত করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে এই অঞ্চলকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় কোনো পক্ষের দিকে ঝুঁকে না পড়ার বিষয়টিও এতে স্পষ্ট করা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক (ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দৃষ্টিভঙ্গি) নামের এই খসড়ায় এ অঞ্চলের ভৌগোলিক গুরুত্বকে অগ্রাধিকার দিয়ে অন্যান্য দেশ ও জোটের ভাবনাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশ কাজ করবে এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা রক্ষায় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত থাকবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চূড়ান্ত অনুমোদনের পর আগামী মাসে এটি প্রকাশ করা হতে পারে।
ঢাকায় সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের অংশ। ফলে আইপিএসের আলোচনা থেকে এড়িয়ে চলার সুযোগ নেই বাংলাদেশের। তবে এই অঞ্চলকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ আইপিএসকে কীভাবে দেখে এবং এ থেকে কী অর্জন করতে চায়, সে বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করতে গত মাসের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ইন্দো–প্যাসিফিক আউটলুকের খসড়া চূড়ান্ত করে। এতে আইপিএসকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রেক্ষাপটে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। প্রতিরক্ষা ও সামরিক উপাদানগুলো একেবারেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেছেন, সরকার মার্চের মধ্যে আইপিএস নিয়ে নিজেদের অবস্থান চূড়ান্ত করবে।
দৃষ্টিভঙ্গির মূল উপাদানগুলো
‘ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় দৃষ্টিভঙ্গি’র খসড়ার প্রথম অংশ বা মুখবন্ধে একটি অবাধ, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভারত-মহাসাগরীয় অঞ্চলের রূপকল্পে বাংলাদেশের সমর্থনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশ কাজ করবে এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা রক্ষায় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত থাকার কথাও বলা হয়েছে। এতে অন্তর্ভুক্তিমূলক বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং এটি যেন নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের জোট না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থেকেছে বাংলাদেশ।
দ্বিতীয় অংশে আছে পথনির্দেশনা। এতে সংবিধানের চারটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়, সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদ, জাতিসংঘ সনদ ও জাতিসংঘের সামুদ্রিক আইনবিষয়ক সনদের ওপর আস্থা এবং আঞ্চলিক অংশীদারত্ব বৃদ্ধি।
শুধু আইপিএস নয়, বিভিন্ন জোটের সঙ্গে সম্পর্কের নিরিখে সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশকে সমন্বিত অবস্থান নিতে হবে। অস্থায়ী ভিত্তিতে কোনো অবস্থান ঠিক করলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
খসড়ার শেষ ভাগ বা লক্ষ্য অর্জন অংশে ১৫টি বিষয়ের উল্লেখ আছে। এগুলো হচ্ছে সংযুক্তি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আঞ্চলিক অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা বৃদ্ধি, সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত, শান্তিরক্ষা এবং শান্তি বিনির্মাণ, সংঘবদ্ধ আন্তর্দেশীয় অপরাধ দমন, শান্তির সংস্কৃতি অর্জন, প্রযুক্তি বিনিময় এবং উদ্ভাবন, সমুদ্রসম্পদ রক্ষা, খাদ্যনিরাপত্তা ও দুর্যোগ প্রশমন, স্বাস্থ্যনিরাপত্তা, সাইবার সিকিউরিটি ইত্যাদি।
অবস্থানপত্র চূড়ান্ত করার নেপথ্যে
ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৭ সালে তার কৌশলগত উদ্যোগ আইপিএস (ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি) ঘোষণা করে। এটি এই অঞ্চলে চীনের বিকাশকে প্রতিহত করার প্রয়াস বলে মনে করা হয়। ২০১৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আইপিএসের প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার কথা বলে আসছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি এবং সম্প্রতি কানাডা তাদের কৌশল বা স্ট্র্যাটেজি ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে এ অঞ্চলে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আসিয়ানসহ সবাই তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে।
ফ্রান্স, জার্মানি ও ইইউর কৌশলপত্রে আন্তর্জাতিক আইন মেনে অর্থনৈতিক সহযোগিতায় বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। ফ্রান্স স্পষ্ট করেই বলেছে, এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি বৃদ্ধি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির প্রতিযোগিতাকে ঘিরে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্যারিস সফরের সময় তাঁর সঙ্গে বৈঠকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁও আইপিএস নিয়ে আলোচনা করেছেন। ওই বৈঠকের পর প্রচারিত যৌথ ঘোষণায় আইপিএস নিয়ে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের অভিন্ন অবস্থানের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়। যেখানে দুই দেশ সবার সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রেখে অবাধ, মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ এবং অংশগ্রহণমূলক ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছে। ওই ঘোষণায় ফ্রান্স ও ইইউর আইপিএসকে বিবেচনায় নিয়ে দুই দেশ আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার পাশাপাশি সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও সুনীল অর্থনীতিতে সহযোগিতা বাড়াতে সম্মত হয়।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, আইপিএস নিয়ে আসিয়ান যে দৃষ্টিভঙ্গি (আউটলুক) ঘোষণা করেছে, বাংলাদেশও একই পথে হেঁটেছে। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সহযোগিতা সংস্থা আসিয়ানের দৃষ্টিভঙ্গিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বৈরিতায় নিরাপদ দূরত্বে থেকে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন দেশ ও জোটের অবস্থানপত্র পর্যালোচনার পর আসিয়ানের অবস্থানপত্রকে বাংলাদেশের ভাবনার সঙ্গে যথেষ্ট সংগতিপূর্ণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, শুধু আইপিএস নয়, বিভিন্ন জোটের সঙ্গে সম্পর্কের নিরিখে সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশের সমন্বিত অবস্থান নিতে হবে। অস্থায়ী ভিত্তিতে কোনো অবস্থান ঠিক করলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তাঁর মতে, বাংলাদেশ যদি মনে করে অর্থনীতিতে অগ্রাধিকার দেবে, তবে সব ধরনের জোট বা উদ্যোগে যুক্ততা থাকাই সমীচীন। কাজেই দেশের স্বার্থে মৌলিক আদর্শের নীতিতে চীনের উদ্যোগ বিআরআই (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ), সাংহাই সহযোগিতা পরিষদ, আরসিইপি (এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর বাণিজ্য চুক্তি) এবং আইপিএসের ক্ষেত্রে অবস্থান ঠিক করা উচিত।