শীতে পাহাড়ি পিঠার স্বাদ

সান্নে পিঠাছবি: সুপ্রিয় চাকমা

কুয়াশা বুকে গেঁথে/ থুরঙের(ঝুড়ি) চাপে-ভারে/ অবংগ্রী (বয়স্ক মানুষ) ওই যায়/ দেখে না দুই চোখে /স্পষ্ট আকারে/ তবু হাঁকে রাস্তায়:/ রে ফ্রি সা মু রে ফ্রি সা মু/ চিরুনি পিঠা নিবি চিরুনি পিঠা কেউ... /

শীতের সকালে রাঙামাটির পাহাড়ি পথে কবি হাফিজ রশিদ খানের এই কবিতা মনে পড়ে গেল। রেফ্রিসামু মারমা পিঠা। রাঙামাটিতে মারমাদের সংখ্যা কম হওয়ায় তেমন চোখে পড়ে না এই পিঠা। অবশ্য অন্য সব পাহাড়ি পিঠা হাতের নাগালেই। এই শীতে এখন পিঠার ফুল ফুটছে যেন চারদিকে।

রাঙামাটি শহরের কাটাপাড়া এলাকায় জানজুনি কুলিং কর্নারে পিঠা খেতে ভিড় করেছেন লোকজন। কেউ চাইছেন সান্নে পিঠা, কেউ বড়া পিঠা আর কেউ গরম গরম কলা পিঠা। সময় তখন সকাল সাড়ে সাতটা হবে। এলাকার অনেকেই সকালের নাশতা সারেন এই দোকানে।

পূর্ণিমা চাকমা পাঁচ বছর ধরে এখানে দোকান করছেন। শীত এলে বিন্নি চাল ও জুমের নানা ধরনের চালের পিঠার কদর বাড়ে। পিঠা তৈরির উপকরণ বলতে চালের গুঁড়া, নারকেল আর গুড়। তবে কোনো পিঠা তেলে আর কোনো পিঠা হয় ভাপে।

জানতে চাইলে পূর্ণিমা বলেন, শীতে প্রতিদিন তাঁর ৯০০ টাকার মতো পিঠা বিক্রি হয়। তবে হাটবারে পিঠা বিক্রি অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি হয়।

চাকমাদের যেমন নানা ধরনের পিঠা রয়েছে, তেমনি মারমাদেরও পিঠার সম্ভার নেহাত কম নয়। ছেছমা, কদামু, কেইন্দামু, রেপ্রিমু, ছিলামু, ফাকামু, গুংমু নামের নানা ধরনের পিঠা তৈরি করেন মারমা সম্প্রদায়ের লোকজন। এর মধ্যে বেশি জনপ্রিয় ছেছমা পিঠা। কলাপাতায় মোড়ানো বিন্নি চালের এই পিঠার স্বাদ অপূর্ব।

তবে চাকমা সম্প্রদায়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় পিঠার নাম সান্নে। আর রাঙামাটি চাকমা অধ্যুষিত হওয়ায় সান্নে পিঠার কদরও এখানে বেশি। চাকমাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে এই পিঠা থাকা বাধ্যতামূলক। রাঙামাটি শহরের নানা এলাকায় বিভিন্ন চা-দোকানে এখন এই পিঠার দেখা মেলে। এ ছাড়া শহরে হাটের দিনে বিভিন্ন গ্রাম থেকে এই পিঠা বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন পাহাড়ি নারীরা। সান্নে পিঠার পাশাপাশি বড়া পিঠা, কলা পিঠা, বিনি হোগা ও বিনি পিঠা তৈরি করেন চাকমারা। শীত এলেই এসব পিঠার কদর বহুগুণ বাড়ে।

বড়া পিঠা
ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

শহরের বনরূপা বাজারের ভ্রাম্যমাণ পিঠা বিক্রেতা দীপিকা চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ১৫ থেকে ২০ জন নারী শহর ও বিভিন্ন উপজেলায় হাটের দিনে পাহাড়ি পিঠা বিক্রি করি। এক কেজি চাল গুঁড়ি করে ২০ থেকে ২৫টি পিঠা তৈরি করি। বিভিন্ন খরচ বাদ দিয়ে প্রতি কেজি চাল থেকে ২০–২৫ টাকা লাভ থাকে। প্রতি হাটের দিনে তিন থেকে চার হাজার টাকার পাহাড়ি পিঠা বিক্রি করা যায়।’

বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শত বছর আগে পাহাড়ে বসবাসরত মানুষদের কাছে বিস্কুট বা বেকারির তৈরি খাবার সহজলভ্য ছিল না। তাই নিজেরাই সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য পিঠা তৈরি করতেন। বিয়ের সম্বন্ধ দেখতে যাওয়ার সময় কিংবা কোনো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অতিথিদের জন্য তৈরি করা হতো পিঠা। এ ছাড়া সামাজিক রীতি অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির উদ্দেশেও পিঠা উৎসর্গ করা হয়।

যেভাবে তৈরি হয় পাহাড়ি পিঠা

নতুন ধানের চাল থেকেই বেশির ভাগ পিঠা তৈরি হয়। সান্নে পিঠা তৈরির জন্য তিন থেকে চার ঘণ্টা চাল পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর ঢেঁকি কিংবা মেশিনে গুঁড়ি বানানো হয়। চালের গুঁড়িগুলো গরম পানি দিয়ে মাখতে হয়। সেখানে দিতে হয় গুড়, নারকেল ও চিনি। এরপর হাতের তালুতে আকার দিয়ে ভাপে তৈরি করা হয় এই পিঠা। নোয়াখালী অঞ্চলের ছাইন্না পিঠার সঙ্গে এই পিঠার অনেক মিল রয়েছে বলে জানান পিঠার কারিগরেরা।

এ ছাড়া বিন্নি চাল গুঁড়ি করে চিনি, কলা ও নারকেল দিয়ে তেলে ভেজে তৈরি করা হয় বড়া পিঠা। আর নতুন ধানের চালের গুঁড়ি, কলা ও নারকেল মিশিয়ে কলাপাতা মুড়িয়ে ভাপে তৈরি হয় কলা পিঠা।

রাঙামাটি শহরের কাটাপাড়া এলাকার শান্তনা চাকমা পাহাড়ি পিঠার কারিগর হিসেবে পরিচিত। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি কয়েক বছর ধরে পাহাড়ি পিঠা তৈরি করছি। আগে বেশ লাভ হতো, এখন পিঠা তৈরির উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভ তেমন থাকে না। অর্ডার পেলে আমি ৩৫০ থেকে ৪০০টি পিঠা তৈরি করি। শীত মৌসুমে পাহাড়ি পিঠার বেশি অর্ডার থাকে। প্রতিটি পিঠা থেকে তিন–চার টাকা লাভ থাকে। তবে তৈরি করতে বেশ কষ্ট ও সময় প্রয়োজন হয়।’

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক মংসানু চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাহাড়ি পিঠা একসময় শুধু সামাজিক অনুষ্ঠানের অনুষঙ্গ ছিল। এখন বাণিজ্যিকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। জনপ্রিয়তাও বহুগুণ বেড়েছে। আমরা ছোটবেলা থেকে পাহাড়ি পিঠা খেয়ে আসছি। এটি পাহাড়ের অন্যতম প্রধান ঐতিহ্যবাহী খাবার।’