ডেঙ্গুতে বাড়ছে মৃত্যুহার

অজ্ঞাত কারণে ডেঙ্গুর মৃত্যু পর্যালোচনা বন্ধ। পর্যালোচনায় কারণ জানা গেলে কিছু মৃত্যু ঠেকানো যেত।

দেশে প্রতিবছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, মৃত্যুহারও বেড়ে চলেছে। মৃত্যুর এই উচ্চ হার বিশ্বের আর কোথাও নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হচ্ছে।

অভিযোগ উঠেছে, সমস্যা মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। দেশব্যাপী জোরদার প্রতিরোধ কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।

২০০০ সালে দেশে প্রথম বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এরপর থেকে প্রতিবছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ছিল। ব্যতিক্রম ছিল ২০২০ সাল। এ বছর করোনা মহামারি দেখা দেয়। দেশে ডেঙ্গু রোগী ছিল কম, সরকারি হিসাবে ডেঙ্গুতে কোনো মৃত্যু ছিল না। তখন জনস্বাস্থ্যবিদদের একটি অংশ এই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, একই সময়ে দুটি ভাইরাস সমান সক্রিয় থাকতে পারে না। করোনার জীবাণুর তীব্রতায় ডেঙ্গু ভাইরাস অনেকটা ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। করোনা মহামারি শেষ না হতেই ২০২১ সাল থেকে আবার ডেঙ্গু বাড়তে থাকে।

ডেঙ্গুবিশেষজ্ঞ ও ডেঙ্গু চিকিৎসার জাতীয় নির্দেশিকার প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক কাজী তারিকুল ইসলাম গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার দশমিক ৫। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ব্রাজিলে। ব্রাজিলেও মৃত্যুহার এত না।’

গত বছরের মাঝামাঝি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মৃত্যু পর্যালোচনার একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই পর্যালোচনা শেষ করেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, কোনো বিশ্লেষণও তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

সরকারি তথ্য কী বলে

করোনা মহামারি শুরুর পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ৪২৮। এর মধ্যে মারা যান ১০৫ জন। মৃতের হার ছিল শূন্য দশমিক ৩৭।

পরের বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। এর মধ্যে মারা যান ২৮১ জন। এ বছর আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়ে যায়। একই সঙ্গে বাড়ে মৃত্যুহার। ২০২২ সালে মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক ৪৫।

২০২৩ সালে ডেঙ্গুর সব রেকর্ড ভেঙে যায়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৩ লাখ ২১ হাজার ২৭ জন। এর মধ্যে মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন। মৃত্যুহার বেড়ে হয় শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ।

গত বছরের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে জনস্বাস্থ্যবিদ, কীটতত্ত্ববিদ ও সরকারি কর্মকর্তারা এ বছরের শুরু থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলে আসছেন যে এ বছরও ডেঙ্গু বড় আকারে দেখা দেবে। জানুয়ারি থেকে ৫ মে পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ২৮৮ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ২৭ জন। মৃত্যুহার ১ দশমিক ১৮। এর অর্থ ১০০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তাঁদের মধ্যে ১ জন মারা যাচ্ছেন।

বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার দশমিক ৫। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ব্রাজিলে। ব্রাজিলেও মৃত্যুহার এত না।
ডেঙ্গুবিশেষজ্ঞ ও ডেঙ্গু চিকিৎসার জাতীয় নির্দেশিকার প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক কাজী তারিকুল ইসলাম

পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, ডেঙ্গুতে যত বেশি মানুষ আক্রান্ত হবেন, মৃত্যুও তত বাড়বে। তবে মৃত্যু বেশি হওয়ার আরও কিছু কারণ আছে।

২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা শহরের বহু মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। সব সরকারি হিসাবে আসেনি। একবার আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তি দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে জটিলতা বেশি হয়। ঢাকা শহরে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়া রোগী অনেক বেড়ে গেছে।

অধ্যাপক কাজী তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘দ্বিতীয়বার আক্রান্ত ব্যক্তির ইমিউনিটি কমপ্লেক্স রিঅ্যাকশন দেখা দেয়। এসব রোগীর প্লাজমা লিকেজ বেশি হয়। রোগী শকে চলে যান। মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার এটাই অন্যতম কারণ।’

কারণ আরও আছে। জ্বর হওয়ার পরও অনেকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। হাসপাতালে রোগী আসছে অনেক দেরিতে, অথবা পরিস্থিতি অনেক জটিল হওয়ার পর।

তবে কী কারণে ডেঙ্গু রোগী বেশি মারা যাচ্ছেন, তার সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। ‘ডেথ রিভিউ’ বা ‘মৃত্যু পর্যালোচনা’ করা হলে বিষয়টি পরিষ্কার করা সম্ভব হতো। গত বছরের মাঝামাঝি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মৃত্যু পর্যালোচনার একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই পর্যালোচনা শেষ করেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, কোনো বিশ্লেষণও তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) শেখ দাউদ আদনান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা খুব শিগগির মৃত্যু পর্যালোচনার ফলাফল প্রকাশ করব।’

গত বছর ডেঙ্গুতে ঢাকা শহরে মারা গিয়েছিলেন ৯৮০ জন। ঢাকা শহরের বাইরে মারা গিয়েছিলেন ৭২৫ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, মৃত্যু পর্যালোচনার জন্য শুধু ঢাকা শহরের হাসপাতাল থেকে ৯৪ জন রোগীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। ঢাকার বাইরের রোগীর কোনো তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি। পর্যালোচনায় ঢাকা শহরের বাইরের রোগীর তথ্যও থাকা দরকার বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।

জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শুনছি যে ঢাকায় আক্রান্তদের মধ্যে অনেকে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছেন। তাঁদের মৃত্যু বেশি হবে। কিন্তু ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি অন্য। সেখানে অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীর স্বল্পতা থাকে। এ ছাড়া ঢাকার রোগী আনার সময় অনেক সমস্যা হয়। ঠিক কোন কারণে মৃত্যু হচ্ছে, তা স্পষ্ট হতো মৃত্যু পর্যালোচনা হলে। পর্যালোচনা থেকে আমরা জানতে পারতাম রোগী আগে আক্রান্ত হয়েছিলেন কি না, রোগী হাসপাতালে বিলম্বে এসেছেন কি না, বা রোগীর কোন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ফ্লুইড ব্যবস্থাপনা ঠিক ছিল কি না। দুর্ভাগ্য, আমরা তা জানতে পারছি না। এসব জানা গেলে প্রচারণায়, রোগী ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এনে কিছু রোগীর প্রাণ রক্ষা করা যেত।

আমরা খুব শিগগির মৃত্যু পর্যালোচনার ফলাফল প্রকাশ করব।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) শেখ দাউদ আদনান