বাগান থেকে ভোটের মাঠে, ‘চা কন্যা’র আরেক লড়াই

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের চান্দপুর চা–বাগানের শ্রমিক খায়রুন আক্তার অন্যায়ের প্রতিবাদে সব সময় সোচ্চারছবি: সংগৃহীত

খায়রুন আক্তার হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের চান্দপুর চা–বাগানের শ্রমিক। দৈনিক ন্যূনতম ১৭০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন। তবে চা–শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বরাবরই সোচ্চার তিনি। স্থানীয় লোকজনের কাছে খায়রুন ‘চা কন্যা’, ‘অগ্নিকন্যা’, ‘স্লোগান কন্যা’সহ বিভিন্ন নামে পরিচিত। চা–বাগানে ছোট থেকে বড়—সবাই তাঁকে ‘দিদি’ বলে ডাকেন।

সবার দিদি খায়রুন এবার চুনারুঘাট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন। চা–বাগানের সদস্যরা রীতিমতো সভা ডেকে তাঁকে প্রার্থী করেছেন। মনোনয়ন ফরম কেনা, প্রচারণা—কত কাজ, কত খরচ। কিন্তু টাকা আসবে কোত্থেকে? এবারও এগিয়ে এসেছেন স্থানীয় চা–শ্রমিকেরা। ১০ টাকা করে চাঁদা তুলে, নানাজনের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে সেই খরচের ধাক্কা সামলানো হয়েছে, হচ্ছে।

খায়রুন এবার চুনারুঘাট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন। চা–বাগানের সদস্যরা রীতিমতো সভা ডেকে তাঁকে প্রার্থী করেছেন। মনোনয়ন ফরম কেনা, প্রচারণা— কত কাজ, কত খরচ। কিন্তু টাকা আসবে কোত্থেকে? এবারও এগিয়ে এসেছেন স্থানীয় চা–শ্রমিকেরা। ১০ টাকা করে গণচাঁদা তুলে, নানাজনের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে সেই খরচের ধাক্কা সামলানো হয়েছে, হচ্ছে।

আগামী ৫ জুন চুনারুঘাট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ। খায়রুন আক্তার এবারই প্রথম ভোটে লড়ছেন। তাঁর প্রতীক কলস। জানালেন, নারী চা–শ্রমিক হিসেবে এর আগে কেউ মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদের জন্য লড়েছেন, তা তাঁর জানা নেই।

গত সোমবার বিকেলে মুঠোফোনে কথা হয় খায়রুনের সঙ্গে। বললেন, চান্দপুর চা–বাগানের পাশে মা মল্লিকা খাতুনকে নিয়ে থাকেন তিনি। মা হাঁস–মুরগি বিক্রি করে ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন নির্বাচনের জন্য। স্থানীয় একটি এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। আর মানুষের চাঁদা–সহায়তা তো আছেই। এভাবেই নির্বাচনে খরচ করছেন তিনি।

নির্বাচন সুষ্ঠু হলে জয় পাবেন—এমন আশাবাদ শোনা গেল খায়রুনের কণ্ঠে। তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমি জিতব, সে বিশ্বাস আমার আছে। চা–বাগানের মানুষ আমার পাশে আছে। চা–বাগানের ভোটারদের শতভাগ ভোটই আমি পাব। চা–শ্রমিক মা, ভাই, বোনদের দেওয়া ১০ টাকা করে সহায়তা দিয়েই মাঠে নেমেছি। নমিনেশন ফরম কেনার জন্য ৭৫ হাজার টাকা লেগেছে। এই পরিমাণ টাকা তো কখনো একসঙ্গে গুনেও দেখিনি। চা–বাগানের ভাই–বোনেরা বলেছেন—আমরা তো আছি।’

ভোটে জিতি আর হারি—মানুষের জন্য কাজ করে যাব। বিপদের সময় মানুষের পাশে কেউ না থাকলেও আমি থাকব। আমার আন্দোলন থামবে না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবই। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় যখন একেকজন বলেন, ‘দিদি ভালো আছেন’, এটাই আমার জীবনের বড় পাওয়া।
খায়রুন আক্তার, চা–শ্রমিক এবং চুনারুঘাট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী

চুনারুঘাটের চা–বাগানগুলোয় ভোটারের সংখ্যা ৪৩ হাজারের বেশি। এসব ভোট খায়রুনের ভরসা। খায়রুন বললেন, বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক তলব বা মজুরি দেওয়ার দিন মজুরি থেকে কেটে ১০ টাকা করে শ্রমিকেরা তাঁকে দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা তুলেছেন। চুনারুঘাটের ১৭টি চা–বাগানের বাইরে অন্য এলাকার পরিচিতরাও এগিয়ে এসেছেন। পোস্টার ছাপানো থেকে প্রচার—সবই শুভাকাঙ্ক্ষীরা করছেন।

খায়রুন তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এই ১০ টাকা আমার জীবনে অনেক বড় পাওয়া। এই ১০ টাকায় রয়েছে চা শ্রমিক মা–ভাই–বোনদের অক্লান্ত পরিশ্রম। জড়িয়ে আছে সম্মান, বিশ্বাস, ভালোবাসা, আর অনেক দিনের স্বপ্ন। এই নির্বাচনে আমি অংশগ্রহণ করা মানে আমার প্রতিটা চা শ্রমিক মা–ভাই–বোন অংশগ্রহণ করেছেন। ধন্যবাদ আমার চা বাগানের চা শ্রমিক মা–ভাই–বোনদের আমাকে ১০ টাকা করে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।’

ফেসবুক পোস্টে নিজের নির্বাচনী পোস্টারের ছবি জুড়ে দিয়েছেন খায়রুন। পোস্টারের নিচে নেখা আছে, ‘প্রচারে চুনারুঘাট উপজেলার সর্বস্তরের জনগণ।’

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে খায়রুন আক্তারের নির্বাচনী পোস্টার
ছবি: সংগৃহীত

এবারের নির্বাচনে চা–শ্রমিকের সন্তান উজ্জ্বল কুমার দাস ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করছেন। তিনি তাঁর ফেসবুকে খায়রুনের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন। এ ছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন ব্যক্তি ফেসবুকে ও সরাসরি খায়রুনের হয়ে প্রচারে নেমেছেন।

খায়রুন বললেন, ‘২০১২ সালে বাবার ক্যানসার ধরা পড়ে। গরু–ছাগল বিক্রি করে চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু বাবাকে বাঁচানো যায়নি। বাবার অসুখের জন্য এসএসসির টেস্ট পরীক্ষাটা আর দেওয়া হয়নি। চা–শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগ দিতে হয়। দুই বোন, এক ভাই, মা—সংসারে এতগুলা মানুষ। কাজে যোগ দিয়ে বুঝলাম, আমি সেভাবে কাজ করতে পারছি না। ফলে মজুরিও পেতাম না সেভাবে। কত দিন যে আমরা না খেয়ে কাটিয়েছি তখন। এখন যে মজুরি পাই, তা দিয়েও এক বেলা খাওয়ার পর অন্য বেলা খাবার জোটে না।’

২০২২ সালে ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে চা–শ্রমিকদের রাজপথের আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে পরিচিত মুখ খায়রুন। মিছিলের সামনে থেকে তিনি স্লোগান ধরেন। তাতে অন্য শ্রমিকেরা কণ্ঠ মেলান। ২০২২ সালের ২৩ নভেম্বর রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের চা–বাগানের শ্রমিকেরা কেন পেছনে পড়ে আছে’ শীর্ষক এক সংলাপে খায়রুন চা–শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবির কথা তুলে ধরেন।

২০২২ সালে ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে চা–শ্রমিকদের রাজপথের আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে পরিচিত এক মুখ খায়রুন। মিছিলের সামনে থেকে তিনি স্লোগান ধরেন। তাতে অন্য শ্রমিকেরা কণ্ঠ মেলান। ২০২২ সালের ২৩ নভেম্বর রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের চা–বাগানের শ্রমিকেরা কেন পেছনে পড়ে আছে’ শীর্ষক এক সংলাপে খায়রুন চা–শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবির কথা তুলে ধরেন।

খায়রুন বলেন, ‘বিভিন্ন বিষয়ে আন্দোলন করি, তাই বাগানমালিকেরা আমাকে খুব একটা পছন্দ করেন না।’

বাংলাদেশ চা কন্যা নারী সমিতির সভাপতি খায়রুন। জানালেন, তিনি কোনো চা–শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন। তবে আন্দোলনে সব সময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন।

চা–বাগানের নারী শ্রমিকদের আলাদা কিছু সমস্যা আছে বলে উল্লেখ করে খায়রুন বলেন, সারা দিন বাগানে চা–পাতা তোলাসহ অন্যান্য কাজ করতে হয় নারীদের। তবে বাগানে শৌচাগার নেই। নারীরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাগানের নারী শ্রমিকেরা মাতৃত্বকালীন ছুটি পাচ্ছেন চার মাস, অথচ সরকারি কর্মজীবী নারীরা পাচ্ছেন ছয় মাস। এটা অবশ্যই অন্যায়।

খায়রুন আরও বলেন, ‘বাগানে কোনো চিকিৎসক, নার্স, এমনকি অ্যাম্বুলেন্স থাকে না। বাগানের নারী কর্মীদের বিনা মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়ার জন্যও বিভিন্ন সময় দাবি তোলা হয়েছে। প্রতি কেজি পাতা তোলার জন্য ৪ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা করে দেওয়ার দাবি তোলা হয়েছে। ঘরে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন সময় কথা বলেছি।’

সফলতাও মিলেছে কিছু কিছু। খায়রুন জানান, দাবির মুখে বাগানে দুজন নার্স নিয়োগ পেয়েছেন। কাজ চালানোর মতো একটি অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া গেছে। আর দীর্ঘ আন্দোলনের ফলেই ১২০ টাকার জায়গায় এখন ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা হয়েছে, যদিও দাবি ছিল ৩০০ টাকার।

কেন নির্বাচন করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে খায়রুন বলেন, ‘উপজেলা পর্যায়ে চা–বাগানের কোনো প্রতিনিধি নেই। চা–শ্রমিকেরা উপজেলায় কাজের জন্য গিয়ে কোথায়, কার কাছে যাবেন, তা নিয়ে দ্বিধায় পড়েন। তাঁদের সাহায্য করার কেউ থাকে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ে মনে হয়েছে, সুযোগ হলে নির্বাচন করব।’

দৃঢ় কণ্ঠে খায়রুন বলেন, ‘ভোটে জিতি আর হারি—মানুষের জন্য কাজ করে যাব। বিপদের সময় মানুষের পাশে কেউ না থাকলেও আমি থাকব। আমার আন্দোলন থামবে না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবই। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় যখন একেকজন বলেন, “দিদি ভালো আছেন”, এটাই আমার জীবনের বড় পাওয়া।’