‘ব্রেস্টফিডিং’ এবং এক আইনজীবী–মায়ের আইনি লড়াই

শিশু উমাইর বিন সাদী ও তার মা ইশরাত হাসান।
ছবি: সংগৃহীত

আজকে মা দিবস। মা এবং সন্তানের সম্পর্কের মতো গভীর ও নিঃস্বার্থ বিষয় খুব কম আছে। সন্তান যখন শিশু অবস্থায় থাকে, তার জন্য মাকে কত কিছুই না করতে হয়! সে সময় মায়ের জন্য একটি নিয়মিত ও আবশ্যক কাজ হলো সন্তানকে ‘ব্রেস্টফিডিং’ বা বুকের দুধ খাওয়ানো। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো সব অফিস বা জনসমাগমস্থলে ব্রেস্টফিডিংয়ের ব্যবস্থা নেই। সম্প্রতি (২ এপ্রিল ২০২৩) বিভিন্ন জনসমাগমস্থলে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে ব্রেস্টফিডিং কক্ষ স্থাপন করার একটি নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এই ‘প্রশংসনীয়’ রায়ের পেছনে রয়েছে এক আইনজীবী–মায়ের বেশ কয়েক বছরের আইনি লড়াই।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর স্বামী এবং ৯ মাস বয়সী শিশুসন্তানকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় তাঁদের বিমানের ফ্লাইট কয়েক ঘণ্টা বিলম্বিত হয়। এর মধ্যে শিশু উমাইর ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে এবং বুকের দুধ খেতে চায়। সেখানেই বিপত্তি দেখা দেয়। কারণ, কক্সবাজার বিমানবন্দরে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর কোনো ব্যবস্থা বা পরিবেশ, কোনোটাই ছিল না। মা হিসেবে এটা ইশরাতের জন্য যেমন বিব্রতকর, তেমনি একটি অসহনীয় ঘটনা ছিল। তিনি বুঝতে পারেন তাঁর মতো আরও অসংখ্য মাকে প্রতিদিন একই রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। ঢাকায় ফিরে তিনি কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নেন। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে আইনি নোটিশ পাঠান। কিন্তু তারা সেগুলোর কোনো জবাব দেয়নি।

কক্সবাজার যাওয়ার পথে বিমানে মা ইশরাত হাসানের কোলে উমাইর বিন সাদী
ছবি: সংগৃহীত

কোনো উপায়ান্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতে রিট করবেন বলে মনস্থির করেন ইশরাত। কিন্তু হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ তাঁর এই রিট আবেদন গ্রহণ করেননি। কিছুটা হতাশ হলেও থেমে যাননি তিনি। ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর তৃতীয়বারের চেষ্টায় অন্য একটি বেঞ্চ তাঁর রিটটি গ্রহণ করেন। এই রিটে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিশ্চিত করে জনসমাগমস্থলে মা ও শিশুদের জন্য ব্রেস্টফিডিং কক্ষ স্থাপনে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চান তিনি। এই রিটে শুধু ইশরাত নিজে নন, পাশাপাশি তাঁর শিশুসন্তান উমাইর বিন সাদীকেও পিটিশনার করা হয়। এরপর শুরু হয় তাঁর আইনি লড়াই।

জনস্বার্থে করা এই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২৭ অক্টোবর বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খোন্দকার মো. দিলীরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। এতে কর্মস্থল, বিমানবন্দর, বাসস্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশন, বিপণিবিতানের মতো জনসমাগমস্থলে এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত, পরিচালিত ও ব্যবস্থাপনায় বিধিবদ্ধ, স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্রেস্টফিডিং ও বেবি কেয়ার কর্নার স্থাপনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চান আদালত। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্যসচিব, সমাজকল্যাণসচিব, বিমান ও পর্যটনসচিবসহ ১৭ জনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের দ্বৈত বেঞ্চ সারা দেশের কলকারখানা ও মিলগুলোতে দুই মাসের মধ্যে ব্রেস্টফিডিং কক্ষ স্থাপনের নির্দেশ দেন। এই নির্দেশনার পর বিমানবন্দর, রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে ব্রেস্টফিডিং কক্ষ করা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো আদালতকে জানিয়েছিল।

এরপর তিন বছরের বেশি সময় ধরে রিটটি অমীমাংসিত অবস্থায় ছিল। অবশেষে চলতি বছরের ২ এপ্রিল চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী এবং বিচারপতি কাজী এবাদত হোসাইনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ রায় দেন। রায়ে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল, বিমানবন্দর, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন ও শপিং মলের মতো জনসমাগমস্থলে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে ব্রেস্টফিডিং কক্ষ স্থাপন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

ইশরাত তাঁর কয়েক বছরের আইনি লড়াই নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যেমন একজন আইনজীবী, তেমনি একজন মা। মা হিসেবে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আইনি লড়াইয়ের সূত্রপাত হয়েছিল। এ কারণে এটা ছিল আমার জন্য আবেগেরও একটা বিষয়। দীর্ঘ কয়েক বছরের আইনি লড়াইয়ের ফলে আদালত একটি ইতিবাচক রায় দিয়েছেন। এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থানে ব্রেস্টফিডিং কক্ষ করা হয়েছে। আশা করি সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আদালতের রায় সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করবে।’