বইয়ের মোড়ক উন্মোচন
‘মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস’ এক অমূল্য দলিল
পাঁচ দশক ধরেই মুক্তিযুদ্ধের বহুস্তরের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা, গবেষণা চলছে। সবচেয়ে কম আলোচিত মুক্তিযুদ্ধকালীন চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা।
পাকিস্তানি সেনাদের হামলার প্রথম দিকেই ২ এপ্রিল রাতে রাজধানীর জিনজিরা এলাকায় নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। মিটফোর্ড হাসপাতাল দখল করে সেখানে ঘাঁটি গেড়েছিল তারা।
জিনজিরায় গণহত্যায় প্রাণ হারানোর সঙ্গে যোগ হয় শত শত মানুষের গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনাও, যাঁদের হাসপাতালে নিয়ে সেবা দেওয়ার সুযোগ ছিল না। তখন এগিয়ে এসেছিলেন পল্লিচিকিৎসক, কম্পাউন্ডার বা খুব সাধারণ মানুষ। এমন অসংখ্য সহমর্মিতার গল্পই মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা।
পাঁচ দশক ধরেই মুক্তিযুদ্ধের বহুস্তরের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা, গবেষণা চলছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কম আলোচিত একটি প্রসঙ্গ মুক্তিযুদ্ধকালীন চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা। কিন্তু ১৯৭১ সালে প্রবাসী সরকারের সময় গঠন করা প্রথম অধিদপ্তরটি ছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বইটি রচনার সময় ইতিহাস লেখার সঠিক পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। গবেষণাকাজটি হয়েছে নিরপেক্ষ। সাহিত্যের মানেও অসাধারণ। ফলে এটি শুধু বই নয়, মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস একটি প্রামাণিক দলিল।মতিউর রহমান, প্রথম আলো সম্পাদক
চিকিৎসক টি হোসেন নিয়েছিলেন মহাপরিচালকের দায়িত্ব। চিকিৎসক, নার্স কেউ ভারতের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়েছেন, কেউ চলে গেছেন প্রত্যন্ত গ্রামে ছদ্মবেশে সেবা করতে। কখনো রাতের অন্ধকারে কোনো রকম সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই তাঁদের একের পর এক অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। আবার বছরজুড়ে ছিল নির্যাতিত নারীদের গর্ভমোচনের মতো মর্মান্তিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
ইতিহাসের সেই সব অজানা তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে প্রথমবারের মতো। কখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজের পুরোনো কাগজ থেকে পাওয়া গেছে মূল্যবান তথ্য। কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড রুম থেকে প্রথমবারের মতো উঠে এসেছে কোনো তথ্য। দুষ্প্রাপ্য এমন সব নথি–তথ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান এবং ওয়াটারএইড দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক চিকিৎসক খায়রুল ইসলাম। যৌথভাবে দুজনের গত পাঁচ বছরের গবেষণাকাজই প্রকাশিত হয়েছে বই আকারে। মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস বইটির মোড়ক উন্মোচিত হলো গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শিল্পকলার এক্সপেরিমেন্টাল হলে।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসাসেনা সাদেকুর রহমান, চিকিৎসাসেনা অধ্যাপক মতিওর রহমান, চিকিৎসাসেনা হালিদা হানুম আকতার, কাজী মিসবাহুন নাহার, চিকিৎসাসেনা পদ্মা রহমানের মতো বিশিষ্টজনেরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় চিকিৎসাসেবায় সরাসরি যাঁদের অবদান ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে শাহাদুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে হলে অতীতের দিকে ফিরে তাকাতেই হবে। গবেষণার নিরপেক্ষতা বজায় রেখে যেমন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তেমনি এর বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বইটি লেখা হয়েছে ১১টি অধ্যায়ে। এর মধ্যে স্থান পেয়েছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা, শরণার্থীশিবিরের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যপুষ্টির যুদ্ধ, সেক্টরভিত্তিক মেডিকেলের ইতিহাস এবং চিকিৎসাযুদ্ধের সাংগঠনিক পর্বের মতো ইতিহাসগুলো।
অনুষ্ঠানের সম্মানিত অতিথি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ হাসপাতালের অন্যতম সংগঠক চিকিৎসাসেনা বীর মুক্তিযোদ্ধা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় চিকিৎসাসেবা নিয়ে এই প্রথম কোনো পূর্ণাঙ্গ বই প্রকাশিত হলো।
১৯৭১ সালে সরকারের নিয়োগ্রপ্রাপ্ত চিকিৎসক কাজী মিসবাহুন নাহার অনুষ্ঠানে তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। কীভাবে তাঁরা সীমিত সম্পদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন, সে কথা বলেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অভিনয়শিল্পী চিকিৎসক কাজী তামান্না বলেন, ‘যে আবেগের জন্ম হয়েছিল দেশভাগের পর থেকেই, সেই আবেগই অনেক মানুষকে একত্র করেছিল দেশের জন্য। কিন্তু “আমরা” থেকে “আমি” ব্যাপারটা এখন বড় হয়ে উঠেছে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত।’
স্মৃতিচারণা করলেন একাত্তরে ২ নম্বর সেক্টরের অধীন থেকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া নার্স বীর মুক্তিযোদ্ধা পদ্মা রহমান। তিনি বলেন, ‘মারণাস্ত্র নয়, জীবনদানের অস্ত্র নিয়ে লড়াই করেছিলাম আমরা।’
বইটি প্রকাশিত হয়েছে প্রথমা প্রকাশন থেকে। ৩০০ পৃষ্ঠার বইটিতে স্থান পেয়েছে বেশ কয়েকজন চিকিৎসাসেনার অভিজ্ঞতার কথা। আছে মন্ত্রিসভার কার্যবিবরণী ও সিদ্ধান্তের নথি।
অনুষ্ঠানের সম্মানিত অতিথি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ বি এম খুরশীদ আলম জানান, ২০২১ সালের ২ মে প্রথমবারের মতো পালন করা হয় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিবসটি, যা শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালে। খায়রুল ইসলাম তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ উল্লেখ করে বলেন, মিটফোর্ড হাসপাতালের বহু নতুন তথ্য খায়রুল ইসলাম ছাত্রাবস্থাতেই খুঁজে বের করেছিলেন।
অনুষ্ঠানে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, বইটি রচনার সময় ইতিহাস লেখার সঠিক পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। গবেষণাকাজটি হয়েছে নিরপেক্ষ। সাহিত্যের মানেও অসাধারণ। ফলে এটি শুধু বই নয়, মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস একটি প্রামাণিক দলিল।