নারী পোশাকশ্রমিকদের জন্য এই ভবন করা হয়েছিল। তবে প্রকল্পটি ‘ব্যর্থ’। এখন ঋণ মওকুফ–সুবিধা পাওয়ার চেষ্টায় অধিদপ্তর।
বছরে আয় হওয়ার কথা ছিল ৫১ লাখ টাকা। হচ্ছে গড়ে সাড়ে আট লাখ টাকা।
আইএমইডির প্রতিবেদনে হোস্টেল ভবনের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি উঠে এসেছে।
দেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের নারী শ্রমিকদের আবাসন–সুবিধার কথা বলে তৈরি করা হয়েছিল ১২তলার একটি ভবন। ব্যয় হয়েছিল ২৮ কোটি টাকার বেশি। এখন দেখা যাচ্ছে, নারী শ্রমিকেরা সেখানে থাকেন না। হোস্টেলটির বেশির ভাগ কক্ষ ফাঁকা পড়ে থাকে।
শ্রমিকদের জন্য নির্মিত এই হোস্টেলটি সাভারের আশুলিয়ার খেজুরবাগানে অবস্থিত। ‘কর্মরত মহিলা গার্মেন্টস শ্রমিকদের আবাসনের জন্য হোস্টেল নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এটি তৈরি করেছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। নির্মাণ শুরু হয় ২০১৩ সালে, শেষ হয় ২০১৭ সালে। এতে ৭৫০ জন নারী শ্রমিকের আবাসনের ব্যবস্থা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
সরেজমিনে গিয়ে ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হোস্টেলটিতে এখন ৩৮৮টি আসনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিপরীতে কর্তৃপক্ষ ভাড়া দিতে পেরেছে ১৩০টি আসন। পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকদের জন্য হোস্টেলটি তৈরি করা হলেও সেখানে যাঁরা থাকছেন, তাঁদের বেশির ভাগ স্থানীয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রী।
এ ধরনের প্রকল্প নেওয়ার কারণ এতে গাড়িসুবিধা পাওয়া যায়, পরামর্শক হওয়া যায়, প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। মন্ত্রণালয়ের কেউ কেউ সুবিধাভোগী থাকেন।জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ
শ্রমিকেরা কেন থাকছেন না, সেই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় তাঁদের সঙ্গে কথা বলে। তাঁরা বলছেন, হোস্টেলে তাঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নেই। অন্যদিকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) গত জুনে তৈরি করা এক মূল্যায়ন প্রতিবেদন বলছে, পোশাককর্মীদের থাকার উপযোগী করে হোস্টেলটি বানানো হয়নি। এ ধরনের আবাসনের প্রয়োজন আছে কি না, তা যাচাইয়ে করা হয়নি বিস্তারিত সমীক্ষাও।
এদিকে হোস্টেলটিতে আসন ভাড়া দিয়ে যে পরিমাণ আয়ের আশা করা হয়েছিল, তা পূরণ হচ্ছে না। হোস্টেলটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) বলা হয়েছিল, সেখান থেকে বছরে আয় হবে ৫১ লাখ টাকা। আইএমইডির প্রতিবেদন বলছে, হোস্টেল চালুর পর পাঁচ বছরে আয় হয়েছে ৪৩ লাখ টাকা। বছরে গড়ে সাড়ে আট লাখ টাকার মতো।
মহিলা অধিদপ্তর বলছে, পরিস্থিতি বিবেচনা করে গণরুমব্যবস্থা বাতিল করা হয়। নতুন করে প্রতি তলায় দুই আসন, তিন আসন ও চার আসনবিশিষ্ট কক্ষ করা হয়। এতে আসনসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩৮৮টিতে। বাড়তি ব্যয় হয় প্রায় দেড় কোটি টাকা। তবু নারী শ্রমিকেরা হোস্টেলে বাস করতে আগ্রহী হচ্ছেন না।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর হোস্টেলটি নির্মাণে বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহঋণ তহবিল থেকে ২৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। সেই টাকা এখন পরিশোধ করতে পারছে না।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফরিদা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যাতে ঋণ মওকুফ করে দেয়, আমরা সেই চেষ্টা করছি।’ তিনি আরও বলেন, হোস্টেলটির সমস্যাগুলো সমাধান করা হচ্ছে। সুযোগ-সুবিধা বাড়ালে ধীরে ধীরে সেবাগ্রহীতা নারী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়বে।
শুরুতে গণরুম, পরে আলাদা কক্ষ
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, শুরুতে হোস্টেলটি নির্মাণ করা হয়েছিল প্রতি তলায় দুটি করে কক্ষ রেখে। গণরুমের মতো করে একটি কক্ষে ৬০ জন, অন্যটিতে ২০ শ্রমিকের থাকার ব্যবস্থা রাখা হয়। কিন্তু থাকার জন্য শ্রমিক পাওয়া যায়নি। কারণ, শ্রমিকেরা এমন পরিবেশে থাকতে রাজি ছিলেন না। তাঁদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা না থাকা এবং জিনিসপত্র হারানোর ভয় ছিল।
মহিলা অধিদপ্তর বলছে, পরিস্থিতি বিবেচনা করে গণরুমব্যবস্থা বাতিল করা হয়। নতুন করে প্রতি তলায় দুই আসন, তিন আসন ও চার আসনবিশিষ্ট কক্ষ করা হয়। এতে আসনসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩৮৮টিতে। বাড়তি ব্যয় হয় প্রায় দেড় কোটি টাকা। তবু নারী শ্রমিকেরা হোস্টেলে বাস করতে আগ্রহী হচ্ছেন না।
৪ জুলাই গিয়ে দেখা যায়, ১২তলা ভবনটিতে লিফট আছে তিনটি। কিন্তু দুটি লিফট বন্ধ থাকে। হোস্টেলে রান্নার কোনো ব্যবস্থা নেই। সরকারিভাবে ক্যানটিন–সুবিধা চালু হয়নি। হোস্টেলের হিসাবরক্ষক আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, সবার সুবিধার বিষয়টি বিবেচনা করে ব্যক্তি উদ্যোগে ক্যানটিন চালানো হচ্ছে।
মহিলা অধিদপ্তর জানিয়েছে, হোস্টেলটিতে দুই আসনবিশিষ্ট কক্ষে এক আসনের ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা। তিন আসনবিশিষ্ট কক্ষে এক আসনের ভাড়া ৮০০ টাকা। চার আসনের কক্ষে এক আসনের ভাড়া ৭০০ টাকা। এর মানে হলো, চারটি আসনের একটি কক্ষে চারজন শ্রমিকের থাকার ব্যয় ২ হাজার ৮০০ টাকা।
স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়িতে তিন হাজার টাকা ভাড়ায় চারজন থাকার মতো একটি কক্ষ ভাড়া পাওয়া যায়। সেখানে রান্নাসহ সব ব্যবস্থা রয়েছে। শ্রমিকেরা মূলত জোর দেন খাবার ব্যয়ের দিকে।
যেমন স্থানীয় একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক নীপা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, হোস্টেলে খাবার খরচ বেশি। আবার নিজের আয়-ব্যয় বিবেচনা করে খাওয়ার ব্যয় নির্ধারণের সুযোগও নেই। ক্যানটিনে যা পাওয়া যায় তাই খেতে হয়। তিনি আরও বলেন, অতিরিক্ত সময়ের (ওভারটাইম) কাজ শেষে গভীর রাতে ফিরলে খাবার পাওয়া যায় না।
স্থান নির্বাচনে ‘গলদ’
আইএমইডির প্রতিবেদনে হোস্টেল ভবনের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি উঠে এসেছে। সংস্থাটি বলছে, হোস্টেল ভবনটির স্থান নির্ধারণ করা ছিল ভুল। কারণ, এটি ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। হোস্টেলের আশপাশে বড় কোনো পোশাক কারখানা বা অন্য কোনো কারখানা নেই।
আইএমইডি আরও বলছে, পুরো হোস্টেলে নিরাপদ পানির জন্য নিচতলায় মাত্র একটি ফিল্টার স্থাপন করা হয়েছে। পানির জন্য ১২তলা থেকে নিচে নামতে হয়। হোস্টেলের নিরাপত্তাব্যবস্থাও দুর্বল।
আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া নিরাপত্তা প্রহরীরা সবাই পুরুষ। অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জামগুলো পরিচর্যার অভাবে নষ্ট হচ্ছে। পুরো ভবনে বহির্গমনের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। হোস্টেলের ভেতর একটি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সেটিও অব্যবহৃত।
মতামত জানতে চাইলে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পোশাককর্মীদের জন্য আবাসস্থল করা হলো অথচ তাঁদের উপযোগী করে ভবন নির্মাণ না করা হাস্যকর, অযৌক্তিক ও বাস্তববর্জিত। এ ধরনের প্রকল্প নেওয়ার আগে অবশ্যই বিস্তারিত সমীক্ষা করা উচিত ছিল। এটা সরকারি টাকার অপচয়। তিনি বলেন, এ ধরনের প্রকল্প নেওয়ার কারণ এতে গাড়িসুবিধা পাওয়া যায়, পরামর্শক হওয়া যায়, প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। মন্ত্রণালয়ের কেউ কেউ সুবিধাভোগী থাকেন।