পিছিয়ে যাচ্ছে রূপপুরের সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ

সোনালী ব্যাংকে ঋণপত্র খোলার জন্য কয়েকবার যোগাযোগ করেছে পিজিসিবি। কিন্তু এ বিষয়ে অগ্রগতি নেই।

পাবনার রূপপুরে দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে
ফাইল ছবি

ডলার–সংকটের কারণে পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খুলতে না পারার কথা অনেক দিন ধরে বলে আসছেন ব্যবসায়ীরা। এবার খোদ সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ডলার–সংকটে তাদেরও ঋণপত্র খুলছে না ব্যাংক। এ কারণে রূপপুরের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ করতে সঞ্চালন লাইন নির্মাণের যন্ত্রপাতি আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে সঞ্চালন লাইনের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকে ঋণপত্র খোলার ব্যবস্থা করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

ডলার–সংকট কতটা প্রকট, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সে চিত্র তুলে ধরে বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র খোলার জন্য দুই মাস ধরে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি) বিভিন্ন ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছে। কিন্তু কেউই ৫ হাজার ২৪০ কোটি টাকার এ ঋণপত্র খুলতে রাজি হয়নি।

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকও ঋণপত্র খুলতে অনাগ্রহ দেখিয়েছে। নিরুপায় হয়ে তাদের অর্থ মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন হওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক যাতে এই নিশ্চয়তা দেয় যে ডলার তারা জোগান দেবে। তবেই কেবল সোনালী ব্যাংক ঋণপত্র খুলবে।

আরও পড়ুন

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ঋণপত্র খোলার বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের একটি চিঠি তাঁরা পেয়েছেন। যেহেতু রূপপুরের সঞ্চালন লাইনটি স্পর্শকাতর প্রকল্প এবং ঋণপত্রের অঙ্কটা বেশ বড়, তাই বিষয়টি তারা গুরুত্বসহকারে দেখছেন। ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজন করার বিষয়ে আলোচনা চলছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

পিজিসিবি সূত্র বলছে, পাবনার রূপপুরে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে সঞ্চালন লাইনের অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৮ সালে একনেকে অনুমোদন পায়। এই প্রকল্পের আওতায় মোট সাতটি প্যাকেজ রয়েছে, যার মধ্যে ছয়টি প্যাকেজের কাজ চলমান।
তবে জটিলতা তৈরি হয়েছে একটি প্যাকেজ (৬) নিয়ে। এই প্যাকেজের আওতায় সঞ্চালন লাইন নির্মাণের জন্য যমুনা নদীতে ১৪টি ও পদ্মা নদীতে ২টি টাওয়ার বসবে।

সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে গত ১৭ আগস্ট ৬ নম্বর প্যাকেজের কাজটি পায় ভারতের ট্রান্সরেইল লাইটিং লিমিটেড। কাজের চুক্তিমূল্য ৫২ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৫ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। এ প্যাকেজের আওতায় যমুনা ও পদ্মা নদীতে ৪০০ ও ২৩০ কেভির ১৬ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে যমুনা নদীর ওপর সাত কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করা হবে। আর পদ্মা নদীতে হবে দুই কিলোমিটার লাইন।

দুটি নদীতে টাওয়ার বসাতে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হবে। যন্ত্রপাতি আমদানিতে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও তুরস্কের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু ঋণপত্র খুলতে না পারায় যন্ত্রপাতি আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। জটিলতা নিরসনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ট্রান্সরেইল লাইটিং লিমিটেডের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) পঙ্কজ ট্যান্ডন এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। প্রসঙ্গত, সঞ্চালন লাইন নির্মাণের বাকি পাঁচটি প্যাকেজে আমদানিসংক্রান্ত জটিলতা নেই।

অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, ঠিকাদারের বিল ডলারে পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ঠিকাদারের বিল পরিশোধে ব্যাংকে ঋণপত্র খোলার আবশ্যকতা রয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যাংকই ঋণপত্র খুলতে রাজি হচ্ছে না। চুক্তিমূল্য অনুযায়ী ডলার পরিশোধ করতে না পারায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করতে পারছে না।

বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ঋণপত্র খোলার বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন পিজিসিবির কর্মকর্তারা। সেখানে ঋণপত্র খোলার শর্ত হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সরবরাহ করবে, এই নিশ্চয়তা চায় সোনালী ব্যাংক। অর্থ বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ ও সোনালী ব্যাংকের মধ্যে একটি বৈঠকের আয়োজন করতেই অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া।

এদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার–সংকটের কারণে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়াতে যাচ্ছে, রূপপুরে নির্মাণাধীন ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ আগামী বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা, কিন্তু ওই সময়ে রূপপুরের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজ শেষ হচ্ছে না। ফলে এই বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণপত্র খুলতে আমরা বিভিন্ন ব্যাংকে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কেউ রাজি হচ্ছে না। সোনালী ব্যাংক ঋণপত্র খোলার আগে নিশ্চয়তা চায় যে ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক সরবরাহ করবে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ডলারের নিশ্চয়তা চাই।’ তিনি বলেন, ডলারের সংকট না কাটলে যন্ত্রপাতি আমদানি সম্ভব হবে না।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরমাণু শক্তি কমিশন। ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট নির্মাণ করছে রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কাজ করছে পিজিসিবি।