হেনস্তার শিকার আগের দুই ছাত্রীও বিচার চান

সর্বশেষ ঘটনায় ছাত্রলীগের দুই কর্মীসহ পাঁচ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিন করে রিমান্ডের আবেদন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদে নারী একজন মানুষ শিরোনামে নাটিকা মঞ্চস্থ করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বারোমাসি’। গতকাল রাত সাড়ে আটটায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশনে
ছবি: জুয়েল শীল

গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর দুই ছাত্রী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির কাছে হেনস্তার অভিযোগ দেন। পরে অভিযোগটি যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্রে পাঠানো হয়। ওই ঘটনার ১০ মাস পার হলেও এখনো বিচার হয়নি।

গতকাল রোববার হেনস্তার শিকার দুই ছাত্রীর একজন প্রথম আলোকে বলেন, হেনস্তার শিকার হওয়ার পর দফায় দফায় তাঁদের দুজনের সাক্ষাৎকার নেয় যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্রের অভিযোগ কমিটি। এরপর আর কিছু জানানো হয়নি।

ওই ছাত্রী আক্ষেপ করে বলেন, ঘটনার বিচার না করে প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়া উল্টো গণমাধ্যমে তাঁদের নিয়ে মিথ্যাচার করেছেন। প্রক্টর গণমাধ্যমে বলেন, ঘটনার পর তাঁরা (দুই ছাত্রী) অভিযুক্ত চারজনকে মাফ করে দিয়েছেন। আদতে এ ধরনের কিছু হয়নি। তাঁরা কাউকে মাফ করেননি। জানতে চাইলে রবিউল হাসান ভূঁইয়া গতকাল দুপুরে তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ কমিটির এক সদস্য মাফ করে দেওয়ার বিষয়টি তাঁকে জানিয়েছিলেন। এ কারণে তিনি গণমাধ্যমে এ কথা বলেন।

এর আগে গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার দিকে ক্যাম্পাসে দুই ছাত্রীকে হেনস্তা করেন ছাত্রলীগের চার কর্মী। তাঁরা হলেন আরবি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. জুনায়েদ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রুবেল হাসান, দর্শন বিভাগের একই বর্ষের ইমন আহাম্মেদ এবং আর এইচ রাজু। তাঁরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হকের অনুসারী।

জানা গেছে, সর্বশেষ এক ছাত্রীকে নিপীড়নের ঘটনায় শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পর গত শনিবার সন্ধ্যায় নগরের চারুকলা ইনস্টিটিউটে নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্রের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দুই ছাত্রীকে হেনস্তার দায়ে চার শিক্ষার্থীকেই এক বছর করে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আরও দুটি ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সতর্ক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আজ সোমবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে এসব সিদ্ধান্ত জানাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান বলেন, এসব সিদ্ধান্তের চিঠি তাঁর কাছে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত পৌঁছায়নি। এ কারণে বিস্তারিত বলতে পারছেন না। অন্যদিকে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্রের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের সেলে তিনটি ঘটনার অভিযোগ জমা ছিল। তিন ঘটনাতেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ ১৭ জুলাই রাতে ক্যাম্পাসে পাঁচ তরুণের হাতে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন ও মারধরের শিকার হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় ওই ছাত্রীকে বেঁধে বিবস্ত্র করে মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করা হয়। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা এক বন্ধু প্রতিবাদ করলে তাঁকেও মারধর করেন পাঁচ তরুণ। এ ঘটনার দুই দিন পর গত মঙ্গলবার প্রক্টরের কাছে অভিযোগ দেন ওই ছাত্রী। এক দিন পর গত বুধবার ওই ছাত্রী হাটহাজারী থানায় মামলা করেন।

ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর বুধবার থেকেই উত্তাল হয়ে পড়ে ক্যাম্পাস। রাতেই ছাত্রীরা হল থেকে বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। বৃহস্পতিবারও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একযোগে প্রতিবাদ করেন। এর মধ্যে র‍্যাব ঘটনার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে।

পাঁচ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় পুলিশ

এদিকে ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগের মামলায় গ্রেপ্তার ছাত্রলীগের দুই কর্মীসহ পাঁচ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় পুলিশ। গতকাল সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয় আদালতে। চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা ইয়াসমিন কাল মঙ্গলবার শুনানির জন্য দিন ধার্য রাখেন। একই আদালত হাটহাজারী সরকারি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র আসামি সাইফুল আলমকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

বাকি চার আসামি হলেন ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মোহাম্মদ আজিম, নৃবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নুরুল আবছার, হাটহাজারী সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের ছাত্র নুর হোসেন ও স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের মাসুদ রানা। তাঁদের মধ্যে আজিম ও আবছার ছাত্রলীগের কর্মী। তাঁদের দুজনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। গত শুক্র ও শনিবার নগর ও জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। সাইফুল ছাড়া বাকি চার আসামিকে শনিবার কারাগারে পাঠান আদালত।

হাটহাজারী থানার ওসি রুহুল আমিন বলেন, আদালত শুনানির জন্য মঙ্গলবার দিন ধার্য করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ পেলে আসামিরা কেন এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন, তা বের করার চেষ্টা থাকবে।

আগের ঘটনায়ও ছাত্রলীগ

বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্রের কাছে আগের তিনটি ঘটনার অভিযোগ জমা ছিল এত দিন। এর মধ্যে এক ছাত্রী ২০১৮ সালে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিলেন। আরেকটি ঘটনায় আরেক ছাত্রী গত বছর এক ছাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন। এ ছাড়া দুই ছাত্রীকে হেনস্তার অভিযোগটি জমা পড়ে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর। এ তিন ঘটনার মধ্যে সর্বশেষটিতে ছাত্রলীগের চার কর্মী জড়িত। তাঁরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হকের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত।

ছাত্রী নিপীড়ন ও হেনস্তার ঘটনায় ছাত্রলীগের নাম আসায় অবাক হননি ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি প্রত্যয় নাফাক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মনে করেন, কাউকে নিপীড়ন করলে তাঁদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলতে পারবেন না। তাঁদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পারবে না। এ কারণে নেতা-কর্মীরা এসব অপকর্ম ঘটান।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ কম নয়। বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকাদারের কাছে চাঁদা দাবি, হলের আসন দখলের জন্য সংঘর্ষ, ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে মারামারি—সব জায়গায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নাম আসে। ক্যাম্পাসে বারবার সংঘর্ষ বাধে। নেতা-কর্মীরা হলের কক্ষ ভাঙচুর করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কারও বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা নেয় না।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি রেজাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগ একটি বড় সংগঠন। এখানে অনেকেই রাজনীতি করেন। ব্যক্তিগতভাবে কেউ অপরাধ করলে তার দায় সংগঠন নেবে না।