কষ্টকর অভিজ্ঞতার মধ্যে শিশুরা

শিশু নির্যাতন পরিবারে ও সমাজে নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে আছে। পরিস্থিতির উন্নতি দেখছেন না গবেষকেরা।

দেশের শিশু ও কিশোর–কিশোরীদের একটি বড় অংশ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাদের ওপর চলছে যৌন নির্যাতন। সামাজিক ও পারিবারিকভাবে তারা অবহেলার শিকার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনেক কিশোর–কিশোরীর জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। গণমাধ্যম এ ব্যাপারে সঠিক ভূমিকা রাখতে পারছে না।

দেশের শিশু ও কিশোর–কিশোরীদের ওপর করা ২৬টি পৃথক গবেষণায় এই চিত্র উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ এসব গবেষণা করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিএসএমএমইউতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গত পাঁচ বছরে করা এসব গবেষণার সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হয়।

ঢাকা শহরে তৃতীয় স্তরের বা টারশিয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৪৫ জন অটিজমে আক্রান্ত শিশুর ওপর একটি গবেষণা হয়েছে। গবেষকেরা ওই সব শিশুর মায়েদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এতে দেখা গেছে, ৩ থেকে ৯ বছর বয়সী প্রত্যেক শিশু শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এসব শিশুর ৮ দশমিক ৯ শতাংশ কোনো না কোনো সময়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে মায়েরা জানান।

বিএসএমএমইউ গবেষণায় গুরুত্ব বাড়িয়েছে। এখন প্রয়োজন গবেষণার এসব ফলকে কাজে লাগানো।
মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, উপাচার্য, বিএসএমএমইউ

২৬টি গবেষণা ৫টি বিষয়বস্তুকেন্দ্রিক গুচ্ছে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে ছিল শিশু অধিকার ও সুরক্ষা, অনলাইনে শিশু নির্যাতন, শৈশবের বিরূপ অভিজ্ঞতা ও পরবর্তী সময়ের স্বাস্থ্য সমস্যা, শিশু নির্যাতন বন্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা এবং অসংক্রামক রোগ: শিশু বিকাশের অন্তরায়। পাঁচজন গবেষক পাঁচটি বিষয়বস্তুসংশ্লিষ্ট গবেষণার ফল উপস্থাপন করেন। স্বাগত বক্তব্যে পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের অধ্যাপক মো. আতিকুল হক বলেন, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় অনেক আইনকানুন, সনদ থাকার পরও শিশু ও কিশোর–কিশোরীর প্রতি সহিংসতা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।

তাদের জন্য ইন্টারনেট বিপজ্জনক

ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে পৃথক দুটি গবেষণা হয়েছে। এর একটি গবেষণা গ্রামের ৪৬০ শিশুকে নিয়ে। তাদের বয়স ১১ থেকে ১৭ বছর। দেখা গেছে, ৫৯ শতাংশ শিশু একটি সাইবার অপরাধের শিকার। ৩৮ ও ২৬ শতাংশ যথাক্রমে দুটি ও তিনটি সাইবার অপরাধের শিকার। অপরাধের মধ্যে ছিল উপহাস–গুজব বা অপমান, অসৎ উদ্দেশ্যে বেনামে যোগাযোগ, যৌন নিপীড়নমূলক বার্তা কিংবা মন্তব্য, যৌনতাপূর্ণ ছবি বা ভিডিও।

২০২১ সালে শহর ও গ্রামের নবম ও দশম শ্রেণির ৪৫৬ শিক্ষার্থীর ওপর করা অন্য গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৬ শতাংশ কিশোর ও ৬৪ শতাংশ কিশোরী ইন্টারনেটের মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। গ্রামের চেয়ে শহরের কিশোর–কিশোরীরা দেড় গুণ বেশি নির্যাতনের শিকার।

গবেষকেরা বলছেন, যেসব কিশোর–কিশোরী ফেসবুক, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ ও চ্যাটরুম নিয়মিত ব্যবহার করে, তাদের নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। গতকালের অনুষ্ঠানে বলা হয়, যেসব বাবা–মা বা অভিভাবকের ইন্টারনেট সম্পর্কে জ্ঞান বা ধারণা কম, তাদের সন্তানদের ঝুঁকি বেশি।

গণমাধ্যমের ভূমিকা

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শিশু নির্যাতনের ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার পরও বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো শিশু যৌন নির্যাতনের গুরুতর ঘটনাগুলো এমনভাবে প্রকাশ করে যা নৈতিকতা বর্জিত। সংবাদপত্রগুলো বিষয়ভিত্তিক প্রতিবেদনের চেয়ে ঘটনাভিত্তিক বা এপিসোডিক প্রতিবেদন বেশি প্রকাশ করা। এর ফলে শিশুর বিকাশ, সুরক্ষা ও সুস্থতার সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে পাঠককে অবহিত করার সুযোগটি তারা হাতছাড়া করছে। সংবাদপত্রগুলোর এ বিষয়ে নিজস্ব নীতি–নির্দেশনার ঘাটতি আছে। ব্যতিক্রম প্রথম আলো

গবেষকেরা বলেন, শিশু নির্যাতন সামাজিকভাবে স্বীকৃত একটি গতানুগতিক ও কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা। নির্যাতনের মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া আছে। কম বয়সী শিশু, মেয়ে শিশু ও দরিদ্র শিশুদের ঝুঁকি বেশি। পরিবার, স্কুল ও কর্মক্ষেত্রে তারা নিম্ন স্তর ও নিম্ন অবস্থানে থাকে বলে তাদের মতামতের কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অসচেতনতা ও আইন প্রয়োগের ঘাটতি শিশু নির্যাতন নির্মূলের অন্যতম বাধা।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিএসএমএমইউর উপাচার্য মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএসএমএমইউ গবেষণায় গুরুত্ব বাড়িয়েছে। এখন প্রয়োজন গবেষণার এসব ফলকে কাজে লাগানো।