শিশু হাসপাতালে ৬৫ চিকিৎসকের নিয়োগ বাতিল করতে বলেছে তদন্ত কমিটি

গুরুতর অনিয়ম

  • নোটিশ বোর্ডে ছিল ৪২ মেডিকেল অফিসার নিয়োগের কথা।

  • নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৬৫ জনকে।

  • ২৩ জনের নিয়োগে গুরুতর অনিয়ম হয়েছে।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটছবি: বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইট থেকে

শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ৬৫ জন চিকিৎসকের নিয়োগ বাতিল করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। কমিটি বলছে, বিধি না মেনেই মেডিকেল অফিসার পদে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগে মেধা যাচাই করা হয়নি। তা ছাড়া জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক নিয়োগের মতো কোনো পরিস্থিতিও হাসপাতালে সৃষ্টি হয়নি।

শিশু হাসপাতালে ৬৫ জন চিকিৎসক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটি সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু অনিয়ম ও অসংগতি তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি এই নিয়োগ বাতিলসহ বেশ কিছু সুপারিশও কমিটির সদস্যরা করেছেন। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কী সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তা এখনো জানা যায়নি।

গত মাসের শেষ সপ্তাহে শিশু হাসপাতালে ৬৫ জন চিকিৎসককে জরুরি ভিত্তিতে ছয় মাসের জন্য অ্যাডহক নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগের আগে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমে কোনো বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেনি কর্তৃপক্ষ। তবে হাসপাতালের নোটিশ বোর্ডে একটি বিজ্ঞপ্তি টাঙানো হয়েছিল। চাকরির জন্য এই হাসপাতালের বাইরের কোনো চিকিৎসক আবেদন করেননি। নিয়োগের আগে লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়নি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২ জুলাই শিশু হাসপাতালের পরিচালককে চিঠি দিয়ে জানতে চায়, অ্যাডহক পদে নিয়োগের জন্য দরখাস্ত আহ্বানসহ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছিল কি না। ৭ জুলাই মন্ত্রণালয়কে দেওয়া চিঠিতে পরিচালক বলেন, পরিচালনা বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবং হাসপাতালের চাকরি ও নিয়োগবিধি অনুসরণ করে চিকিৎসকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরপর ১০ জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। তিন সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক করা হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন অধিশাখা) খন্দকার মোহাম্মদ আলীকে। কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্বে ছিলেন যুগ্ম সচিব (শৃঙ্খলা শাখা) শব্বির ইকবাল এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন।

তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। আপাতত এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।’

কী কী অনিয়ম হয়েছে

তদন্ত কমিটি হাসপাতাল পরিদর্শন করে এবং হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মো. মাহবুবুল হক, চাকরি পাওয়া ১৪ জন চিকিৎসক, বঞ্চিত চারজন চিকিৎসক, পরিচালনা বোর্ডের দুজন সদস্যের বক্তব্য নেয়। এ ছাড়া তাঁরা সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র, আইন, বিধি পর্যালোচনা করেন।

তদন্ত কমিটি বলেছে, শিশু হাসপাতালে ৬৫ জন আবাসিক মেডিকেল অফিসার নিয়োগ বিধিসম্মত হয়নি। নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ও মেধা যাচাই হয়নি। এ ছাড়া অ্যাডহক ভিত্তিতে চিকিৎসক নিয়োগের এমন কোনো জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।

তদন্ত কমিটি বলেছে, দ্রুততার সঙ্গে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে, যা নিয়োগপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ২৮ মে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে ৩০ জুন নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করা হয়।

নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে যোগসাজশে। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এ ধরনের নিয়োগ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

গুরুতর অনিয়ম আরও আছে। নোটিশ বোর্ডে ৪২ জন মেডিকেল অফিসার নিয়োগ করা হবে—এমন বিজ্ঞপ্তি টাঙানো হয়েছিল। কিন্তু নিয়োগ দেওয়া হয় ৬৫ জনকে। ২৩ জন নিয়োগে গুরুতর অনিয়ম হয়েছে বলে তদন্ত কমিটি মতামত দিয়েছে।

তদন্ত কমিটি সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছে, এই নিয়োগ আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। কারণ হিসেবে কমিটি বলেছে, আবেদনপত্র গ্রহণের কোনো রেজিস্ট্রি সংরক্ষণ করা হয়নি। কার পরে কে আবেদন করেছেন, তেমন কোনো ক্রম বা সিরিয়াল অনুসরণ করা হয়নি। আবেদনকারীকে কোনো ধরনের প্রাপ্তি স্বীকারপত্রও দেওয়া হয়নি। কর্তৃপক্ষ আবেদনপত্রে সই করেছে ঠিকই, কিন্তু কোন তারিখে সই করা হয়েছে, তার উল্লেখ নেই।

এখন কী করণীয়

তদন্ত কমিটি সুপারিশের শুরুতেই বলেছে, ৬৫ জন মেডিকেল অফিসার নিয়োগ বাতিল করতে হবে। বাতিল করার পর গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি অনুসরণ

করে নিয়োগ কমিটি গঠন করতে হবে এবং নিয়োগের ব্যাপারে জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে।

তদন্ত কমিটি বলেছে, অবিলম্বে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট আইন, ২০২১-এর প্রবিধান তৈরি করতে হবে। এই প্রবিধান তৈরি হওয়ার আগপর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের নিয়োগসহ গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। এ ছাড়া শিশু হাসপাতালের কার্যক্রম নজরদারি করতে হবে।

শিশু হাসপাতালসহ দেশের বহু হাসপাতালে দুর্নীতি-অনিয়মের ঘটনা নতুন নয়। এত বিপুলসংখ্যক চিকিৎসককে এর আগে এমন ঢালাওভাবে নিয়োগ দেওয়ার নজির বিরল।

দুর্নীতি প্রতিরোধবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে যোগসাজশে। এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। নির্বাচিত বা অন্তর্বর্তী কোনো সরকারের আমলে এ ধরনের নিয়োগ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।