হুইলচেয়ারে বসে দুবাইয়ে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কথা বলছেন ঢাকার আনিলা

কপ–২৮–এর আসরের বিভিন্ন সেশনে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে কথা বলছেন আফিয়া কবীর আনিলাছবি: সংগৃহীত

২৩ বছরের তরুণী আফিয়া কবীর আনিলা। সেরিব্রাল পালসির কারণে তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটছে হুইলচেয়ারে। কেউ হুইলচেয়ার টেনে না নিলে নড়তেও পারেন না। কথা বলতে কষ্ট হয়। তবে এসব প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়েছেন তিনি। বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজের (কপ) ২৮তম আসরের বিভিন্ন সেশনে তিনি প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে কথা বলছেন।

গত ৩০ নভেম্বর শুরু হওয়া কপ–২৮ সম্মেলন চলবে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সম্মেলনে অংশ নিতে দুবাইয়ে বসেই আনিলা জেনেছেন তাঁর স্নাতকের ফলাফল। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৩.৪৪ পেয়েছেন তিনি।

কপ–২৮ সম্মেলন শুরুর আগে একই জায়গায় ২৬ থেকে ২৮ নভেম্বর যুবদের নিয়ে সিওওয়াই ১৮ (COY 18) সম্মেলনেও অংশ নিয়েছেন আনিলা। দ্য ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (ইউএনএফসিসিসি) পর্যবেক্ষক হিসেবে আনিলা সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন।

গতকাল শনিবার মেসেঞ্জারে কথা হয় আনিলার সঙ্গে। সম্মেলনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘এখানে সবার আন্তরিক ব্যবহারে আমার মনেই হচ্ছে না আমার কোনো শারীরিক সমস্যা আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তা নিয়ে কথা বলছি। বন্যা হলে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের অন্তঃসত্ত্বা নারীরা নানা সমস্যায় পড়ছেন—এগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি।’

আনিলা জানালেন, দেশে ফিরে সম্মেলনের নানা অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে চান। তিনি একটি রেসকিউ টিম গঠন করতে চান, যাঁরা বিভিন্ন দুর্যোগে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উদ্ধারসহ নানা সহায়তা দেবেন। প্রশিক্ষণ পাওয়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও এ টিমে কাজ করবেন।

কপ–২৮ সম্মেলনের ফাঁকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের সঙ্গে আনিলা
ছবি: সংগৃহীত

এর আগে ২০২০ সালে জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামে (বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি) ভলান্টিয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট (স্বেচ্ছাসেবক সহযোগী) হিসেবে দুর্যোগকালীন সহায়তা, প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা, খাদ্যনিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিবন্ধীবান্ধব পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা আছে আনিলার। আনিলা লন্ডন, ভারত, মালয়েশিয়া, ব্যাংকক, ভুটানসহ নানা দেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন।

আনিলার বাবা আশফাক-উল কবীর এবং মা মারুফা হোসেনও ইউএনএফসিসিসির খরচে কেয়ারগিভার (সেবাদাতা) হিসেবে আনিলার সঙ্গেই আছেন।

বাবা আশফাক-উল কবীর চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন শুধু মেয়েকে সময় দেওয়ার জন্য। তিনি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন ও তরী ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং এ প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।

আনিলার মা মারুফা হোসেন এই প্রতিষ্ঠান দুটোতে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আনিলার বাবা ও মা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন বিশেষ সম্মাননা। আর আনিলা তরী ফাউন্ডেশনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

আজ ৩ ডিসেম্বর ৩২তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস এবং ২৫তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ে সরকারিভাবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাথে সম্মিলিত অংশগ্রহণ, নিশ্চিত করবে এসডিজি অর্জন’। দিবসটি সামনে রেখেই আনিলা ও তাঁর বাবার সঙ্গে কথা হয়।

যুবদের নিয়ে আয়োজিত সিওওয়াই সম্মেলনে বক্তব্য দেন আফিয়া কবীর আনিলা
ছবি: সংগৃহীত

আনিলার মা–বাবা নানা প্রতিবন্ধকতাকে ঠেলে মেয়েকে নিয়ে এ পর্যায়ে এসেছেন। আশফাক-উল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আনিলা কপ–২৮ সম্মেলনের বিভিন্ন সেশনে প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে কথা বলছে। দুটো সেশনে প্যানেলিস্ট হিসেবেও থাকবে। আনিলা যখন কথা বলছে, তখন সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে তা শুনছেন।’

সম্মেলনে আনিলা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে চলাফেরা করতে পারছেন বলেও জানান তাঁর বাবা। তিনি বলেন, ‘এখানে প্রতিটি জায়গায় হুইলচেয়ার নিয়ে আনিলা যাতায়াত করতে পারছে। আমাদের দেশের মতো কেউ আনিলার দিকে অন্যভাবে তাকাচ্ছেন না। হুইলচেয়ারে বসা দেখার পরও আনিলাকে কেউ এসে জিজ্ঞাসা করছেন না সে হাঁটতে পারে কি না। প্রতিবন্ধী মানুষদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, কোনো লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না।’

আনিলার সংগ্রাম ও এগিয়ে যাওয়া
আনিলা তাঁর সঙ্গে ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন বিভিন্ন সময়। লেগে থেকে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। মাঝেমধ্যে তাঁর বিব্রতকর অভিজ্ঞতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও তুলে ধরেছেন।

বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর যাওয়ার মতো শৌচাগার না থাকায় প্রস্রাব-পায়খানা চেপে রাখায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন আনিলা। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রবেশগম্য শৌচাগার বানিয়েছে। ঢালু সিঁড়ির ব্যবস্থা করেছে।

২০২০ সালে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোটা সংরক্ষণ ও নিয়ম শিথিল করতে আনিলার একক আবেদন ও প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এ বিষয়ে দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চিঠি দিয়েছে। আনিলার নিজের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। টিপসই দিয়েই আনিলা ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারছেন।

ছোটবেলায় অন্য শিশুদের মতো আনিলা স্কুলে যেতে পারেননি। বেশির ভাগ স্কুল তো আনিলাকে ভর্তিই করতে চায়নি। কোনো স্কুল ভর্তি করলেও দোতলায় ক্লাস থাকায় পড়া সম্ভব হয়নি। একটি স্কুল নিচতলায় বসে ক্লাস করতে দিলেও আনিলার ঠাঁই হয়েছিল টয়লেটের পাশে। যে নামকরা স্কুল ভর্তি নেয়নি, সেই স্কুলই সানন্দে তাদের কোচিংয়ে ভর্তি করে তাকে। কোচিং আর বাসায় প্রাইভেট পড়েই আনিলা স্কুল-কলেজের গণ্ডি পার হয়েছেন।

আফিয়া কবীর আনিলার সঙ্গে মা মারুফা হোসেন। কপ-২৮ সম্মেলনের অবসরে মা–মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন
ছবি: সংগৃহীত

দৃষ্টিতে সমস্যা থাকায় আনিলার বই দেখে পড়তে কষ্ট হয়। তাই তাঁকে অন্য কেউ বই পড়ে শোনান। লিখতে পারেন না বলে শ্রুতলেখক লাগে সব পরীক্ষায়। ব্যবসায় শিক্ষা নিয়ে পড়া অবস্থায় তাঁর শ্রুতলেখক দেওয়া হয় বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে এমন একজনকে।

বেশির ভাগ জায়গায় র‍্যাম্প নেই
আনিলাকে বাবা আর গাড়ির চালক চ্যাংদোলা করে কোথাও নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন বহুবার। রাস্তায় গর্তে হুইলচেয়ার নিয়ে পড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তো আছেই।

শিশু বয়স থেকেই সেভ দ্য চিলড্রেনের ন্যাশনাল চিলড্রেন প্যানেলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আনিলা। পরে গ্লোবাল চিলড্রেন প্যানেলের সদস্য হয়েছেন। ২০১১ সালে লন্ডনে এই প্যানেলের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের শিশুদের প্রতিনিধিত্ব করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে ‘সুবর্ণ নাগরিক’-এর কার্ড নিয়েছেন আনিলা। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তরের বর্ষপঞ্জি, বুকলেটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আনিলার তোলা ছবি জায়গা করে নিয়েছে।

মা–বাবাকে ছাড়াই আনিলা যাতে এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারেন, তাঁর বাবা ও মা সেই প্রস্তুতি নিয়েছেন মেয়ের ছোটবেলা থেকেই। আনিলাকে নিয়ে তাঁরা সিলেটের লালাখাল, সেন্ট মার্টিন, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়েছিলেন। একইভাবে বিভিন্ন দেশেও বেড়াতে গিয়েছেন এই তিনজন। মেয়েকে ভালো রাখার জন্যই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের বিষয়ে পড়াশোনাও করেছেন মারুফা হোসেন।

আনিলার বাবা আশফাক-উল কবীর বললেন, নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজেবল (অটিজম, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী) শিশুদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিজস্ব ভবন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন।