দেশজুড়ে তীব্র শীতে কষ্টে মানুষ, সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নিকলীতে

কুয়াশাঢাকা সকালে নৌকায় করে কাজে চলেছেন অনেকেই। দৌলতপুর, খুলনা, ২৯ ডিসেম্বরছবি: সাদ্দাম হোসেন

বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে ছিলেন ফারুক মিয়া (৬৫)। অন্যদের সঙ্গে বসে টেলিভিশনে বাংলা সিনেমা দেখছিলেন তিনি। তাঁর বাড়ি কিশোরগঞ্জের নিকলীর কুর্শা এলাকায়। হাওরাঞ্চলে বোরো ধানের চারা রোপণের এই সময়ে হাওরের মানুষের প্রতিদিন কাজ থাকে। কিন্তু দুই দিন ধরে তীব্র শীতের কারণে ফারুক মিয়ার মতো অনেকেই কাজে যেতে পারছেন না।

ফারুক মিয়া বলেন, ‘৬৫ বছর বয়সে এরম শীত লাগে নাই। শীতে শইল জমে যাইতাছে। কামেও যাইতে পারতেছি না। এরম শীত থাকলে আমরা বাঁচুম না।’

ফারুক মিয়ার এলাকা নিকলীতে গতকাল সোমবার ছিল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা—১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ অবস্থায় ‘শইল জমে’ যাওয়ারই কথা। বিশেষ করে তাঁর মতো ষাটোর্ধ্বদের জন্য এ শীত সত্যিই কষ্টকর। শুধু তাঁর বয়সী মানুষই নন, অন্তত তিন দিন ধরে তীব্র শীত কাঁপন ধরিয়েছে দেশের প্রায় সব এলাকার, সব বয়সী মানুষকেই। ঘন কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে রোদের মুখ দেখা যাচ্ছে না। রোদ না থাকায় শীতের প্রকোপও বেশি। তীব্র শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। এতে কষ্টে পড়েছেন, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ। বেড়েছে শীতজনিত অসুখ-বিসুখও। আর কুয়াশায় যানবাহন চলাচলেও ঘটছে বিঘ্ন।

কুয়াশাঢাকা শীতের সকালে গ্রামের পিচঢালা পথ ধরে গন্তব্যে চলেছে মানুষ। যশোপাড়া, বগুড়া, ২৯ ডিসেম্বর
ছবি: সোয়েল রানা

আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, আজও দেশের বিভিন্ন এলাকায় কুয়াশার দাপট থাকবে। রোদ ওঠার সম্ভাবনা কম। উঠলেও বিকেলের দিকে কিছুটা উঠতে পারে। এরই মধ্যে গতকাল রাতের তাপমাত্রা আরও কমেছে।

যদিও আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, আগামী বৃহস্পতিবার থেকে কুয়াশা কমে যেতে পারে। কমতে পারে শীতের তীব্রতাও।

বিপর্যস্ত জনজীবন, কষ্টে শ্রমজীবীরা

মেহেরপুর শহরের কোর্ট মোড় এলাকায় গতকাল কথা হয় রিকশাচালক আবদুল মালেকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভোরবেলায় কাজে বের হয়ছি, এত শীত পড়িছি যে হাত-পা ঠান্ডা হয়ি গিছি। রাস্তায় যাত্রীও দেখা যাইছি না। এখন সংসার চালাবু কী কইরি বুলা যাচ্ছি না।’

দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে জেঁকে বসেছে শীত। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে দুই দিন ধরে দেখা মিলছে না সূর্যের। সেই সঙ্গে হিমেল বাতাস থাকায় দিনরাত অনুভূত হচ্ছে কনকনে শীত। দিনে রোদ না ওঠায় কমেছে দিনের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধান।

তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা যায়, গতকাল সকাল ৯টায় তেঁতুলিয়ায় দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

শেরপুরের গারো পাহাড়ঘেঁষা সীমান্ত জনপদে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী বিশপনগর গ্রামের কৃষিশ্রমিক সীতা দিও (৫২) বলেন, সন্ধ্যার পর ঘরের চালের ওপর বৃষ্টির মতো কুয়াশার পানি পড়ে। সঙ্গে পাহাড়ি বাতাস বইলে শীত অসহনীয় হয়ে ওঠে। তবু পেটের দায়ে বাইরে গিয়ে কাজ করতে হয়।

বেড়েছে অসুখ-বিসুখ, করণীয় কী

দেশের উত্তরাঞ্চলজুড়ে চলছে তীব্র শীতের প্রকোপ। শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহীতে ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মুখপাত্র শংকর কে বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, শীতজনিত জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে রোগীর চাপ কিছুটা বেড়েছে। বিশেষ করে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে এসব রোগের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি।

শুধু উত্তর জনপদে নয়, দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা মেহেরপুরেও শীতজনিত রোগ বেড়ে গেছে। মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এক অভিভাবক শিউলি খাতুন বলেন, ‘আমার বাচ্চার সর্দি-কাশি আর জ্বর। এই ঠান্ডায় বাচ্চাদের খুব কষ্ট হচ্ছে।’

মেহেরপুর জেলা সিভিল সার্জন এ কে এম আবু সাঈদ বলেন, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে কয়েক দিন ধরে শিশু ও বয়স্ক রোগীরা ভর্তি হচ্ছেন। তাঁদের বেশির ভাগই শীতজনিত সর্দি–কাশি ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত।

ঘন কুয়াশায় তাপমাত্রা হঠাৎ করেই কমে গেছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এতে শ্বাসকষ্টজনিত নানা রোগে আক্রান্ত রোগী বেশি হারে পাচ্ছেন বলে জানান দেশের বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক টিটো মিঞা। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এ সময়টায় যাদের অ্যাজমা বা নিউমোনিয়ার মতো রোগ আছে, তা বেড়ে যেতে পারে, যাচ্ছেও। বিশেষ করে দিনাজপুর অঞ্চলে বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে রক্তনালি চুপসে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। একে ‘ফ্রস্টবাইট’ বলা হয়। কারও কারও গ্যাংরিন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এ সময়টায়, বিশেষ করে বয়স্ক ও শিশুদের বিশেষ যত্ন দরকার বলে জানান অধ্যাপক টিটো মিঞা। তিনি বলেন, গরম কাপড় পরে থাকতে হবে। বাইরে যাওয়া যতটুকু সম্ভব কমাতে হবে। বিশেষ করে বয়স্কদের হাতে ও পায়ে তাপ নিতে হবে।

কুয়াশার কারণেই শীতের তীব্রতা বেশি

কোনো এলাকায় তাপমাত্রা ৮ দশমিক ১ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। সে অনুযায়ী, গতকাল শুধু নিকলী এলাকাতেই শৈত্যপ্রবাহ ছিল।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত ডিসেম্বর মাসে পশ্চিমা লঘুচাপ আসে দুবার। কিন্তু চলতি মাসে একবারও লঘুচাপ আসেনি। লঘুচাপে জোরে বাতাস বয়, বৃষ্টিতে কুয়াশা কাটে। কিন্তু বৃষ্টির অনুপস্থিতিতেই ঘন কুয়াশা বিস্তৃত হয়েছে।

গতকাল সন্ধ্যায় দেওয়া আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে, ঘন কুয়াশার কারণে আজ মঙ্গলবার বিমান, নৌ ও সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা সাময়িকভাবে বিপর্যস্ত হতে পারে।

আবহাওয়াবিদ মো. হাফিজুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, কুয়াশা আজ মঙ্গলবার ও কাল বুধবার থাকতে পারে। তবে বৃহস্পতিবার থেকে তা কিছুটা কমে আসতে পারে।

[তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন প্রতিনিধি, কিশোরগঞ্জ; রাজশাহী; পঞ্চগড়; মেহেরপুর এবং নালিতাবাড়ী, (শেরপুর)]