কত মানুষ মদ পান করে, বিক্রি কত জানতে চায় পুলিশ

প্রতীকী ছবি

দেশে কত প্রতিষ্ঠান মদ বিক্রি করে, কত মানুষ মদ পান করে এবং বিক্রির পরিমাণ কত—এসব তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ। মদ বিক্রির অনুমোদন আছে এমন বার, হোটেল ও রেস্তোরাঁয় গিয়ে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) মাঠপর্যায়ের সদস্যরা তথ্যগুলো সংগ্রহ শুরু করেছেন।

এসবির কর্মকর্তারা তাঁদের প্রধান কার্যালয়ের একটি চিঠির কথা বলে তথ্য চাচ্ছেন। গত ২৯ আগস্ট এসবির স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স শাখা থেকে মাঠপর্যায়ের কার্যালয়গুলোকে ওই চিঠি দেওয়া হয়।

বৈধ মদ বিক্রেতাদের অভিযোগ, এসবির সদস্যরা বারে গিয়ে কারা কারা মদ পান করতে যান, সেই তালিকা চাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে লিখিত কোনো চিঠিও দেওয়া হচ্ছে না। মৌখিকভাবে তথ্য চাওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ হোটেল, রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মেজর (অব.) এম জাহাঙ্গীর হোসেইন প্রথম আলোকে বলেন, এসবি যেসব তথ্য চেয়েছে, তা মদ্যপানের অনুমতি পাওয়া ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত স্পর্শকাতর তথ্য। এসব তথ্য চাওয়া বা অনুসন্ধান করার ক্ষেত্রে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) মহাপরিচালকের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

জাহাঙ্গীর হোসেইন আরও বলেন, এসবির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা এসব তথ্য মৌখিকভাবে চেয়েছেন। এ কারণেই তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছ থেকে অনুমতি বা পারমিট নিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকেরা মদ পান করতে পারেন। তবে অনুমতি পেতে নানা শর্ত রয়েছে।

ডিএনসির নিরোধ শাখা সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের বাইরের অন্য ধর্মাবলম্বীরা মদ পানের অনুমতির আবেদন করলে এক বছরের জন্য তাঁরা অনুমতি পান। প্রতি মাসে বৈধ বিক্রয়কেন্দ্র থেকে তাঁরা সাড়ে পাঁচ লিটার বিদেশি অথবা কেরু অ্যান্ড কোম্পানির তৈরি মদ কিনতে পারেন। দেশি মদ হলে কেনা যায় সাড়ে ৯ লিটার।

মুসলমানদের অনুমতি দেওয়া হয় না। তবে কারও যদি সুস্থ থাকার জন্য মদ পানের প্রয়োজন হয় এবং সিভিল সার্জন অথবা সরকারি হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক পর্যায়ের চিকিৎসক এ-সংক্রান্ত সনদ দেন, তাহলে তিনি অনুমতির জন্য আবেদন করতে পারবেন।

কী উদ্দেশ্যে তথ্য সংগ্রহ

এসবির চিঠিতে মদবিষয়ক তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্য হিসেবে নজরদারির আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ২১তম বৈঠক থেকে ৩০তম বৈঠকে হওয়া সিদ্ধান্তগুলোর আলোকে মদ ও মাদকের ক্রেতা-বিক্রেতার তথ্য সংগ্রহ করতে হবে এবং মাদক কেনাবেচার জায়গা ও আশপাশের স্থান ক্লোজড সার্কিট (সিসিটিভি) ক্যামেরার আওতায় আনতে হবে।

নির্ধারিত ছকে চাওয়া তথ্যগুলো হলো লাইসেন্সধারী মদ বিক্রয়ের দোকানের সংখ্যা, লাইসেন্সধারী মদের ক্রেতা বা ভোক্তার সংখ্যা, প্রতি মাসে ক্রয়-বিক্রয়ের হিসাব এবং এই হিসাব লাইসেন্সধারী ও ভোক্তার পরিমাণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা।

চিঠিটি পাঠানো হয় এসবির নগর বিশেষ শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সুফি উল্লাহর স্বাক্ষরে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় পুলিশ সদর দপ্তর ও এসবির প্রধান কার্যালয় থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। এসবির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বিভিন্ন বার থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছেন। তবে কোনো কোনো বার তথ্য দিচ্ছে, আবার কোনো কোনো বার তথ্য দিচ্ছে না। তিনি বলেন, স্বতঃস্ফূর্তভাবে যাঁরা তথ্য দিচ্ছেন, কেবল তাঁদের কাছ থেকেই তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

এসবির একটি সূত্র বলছে, বিক্রেতারা মদ বিক্রির যে হিসাব দেখায়, সেখানে অনেক গরমিল রয়েছে বলে তাদের ধারণা। আর অনুমোদনহীন ব্যক্তিদের কাছে তারা প্রচুর মদ বিক্রি করে, যেটা বৈধ নয়। সব মিলিয়ে নজরদারি আনা তাদের উদ্দেশ্য।

ডিএনসি যা বলছে

হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও বারের লাইসেন্স প্রদান করে ডিএনসি। বৈধভাবে মদ কেনা ও বেচার বিষয়ে সব ধরনের তথ্য ডিএনসিকে সরবরাহ করে বিক্রেতারা।

ডিএনসির উপপরিচালক (প্রশাসন) শামীম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, লাইসেন্সধারী মদ বিক্রেতা ও মদের ক্রেতাদের বিষয়ে এসবি তথ্য চাচ্ছে, এটা ডিএনসির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা সদর দপ্তরকে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে এসবি ডিএনসিকে দাপ্তরিকভাবে কিছু জানায়নি।

ডিএনসিকে না জানিয়ে এসবি এ ধরনের তথ্য চাইতে পারে কি না, জানতে চাইলে শামীম আহমেদ বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি মন্তব্য করব করব না।’

এদিকে বাংলাদেশ হোটেল, রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার অ্যাসোসিয়েশন গত ৬ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে চিঠি দিয়ে তথ্য চাওয়ার প্রতিবাদ জানিয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়, ২১তম থেকে ৩০তম সভার সিদ্ধান্তের কথা বলে এসবি তথ্য চাচ্ছে। কিন্তু এসব সভায় মদ এবং বার সম্পর্কে কোনো তথ্য সংগ্রহের কথা বলা হয়নি। ২৬তম সভার কার্যবিবরণীতে মাদক পাচারকারী, মাদক ব্যবসায়ী, সব রোহিঙ্গা এবং মাদকের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশিদের তালিকা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। এখানে মদ বিক্রি এবং ভোক্তা সম্পর্কিত কোনো বিষয় নেই।

মদের বিষয়ে সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য ডিএনসির কাছে সংরক্ষিত থাকে। এসবি তথ্য ডিএনসির কাছে চাইতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।
বাংলাদেশ হোটেল, রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর হোসেইন বলেন, এসবি যেসব তথ্য চেয়েছে, এসব তথ্য সর্বজনীনভাবে প্রকাশের সুযোগ নেই।

মদপানকারীদের নাম কি প্রকাশ করা যায়  

মানুষের গোপনীয়তার অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, অনুমতি নিয়ে কে মদ পান করেন, সেই তথ্য চাওয়া অনুচিত। এটা মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার ভঙ্গ করে।

২০০২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সেখানে বলা হয়, মদ্যপান সমাজে এখনো গোপন বিষয়। গোপনীয়তার স্বার্থে মদ্যপানকারীদের তালিকা প্রদান সমীচীন হবে না।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০০২ সালের প্রজ্ঞাপন এখনো জারি আছে।

অধিকারকর্মী ও গবেষক রেজাউর রহমান লেনিন প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা মদ উৎপাদন, বিপণন ও পান করেন, তাঁদের সম্পর্কে তথ্য চাওয়ার কোনো আইনগত অধিকার পুলিশকে দেওয়া হয়নি। তারা কেন এ ধরনের তথ্য চাচ্ছে, এর যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যাও নেই। এভাবে ব্যক্তিগত তথ্য চাওয়ার বিষয়টি উদ্দেশ্যমূলক ও বৈষম্যমূলক।