বর্ষার যত স্বাদু পিঠা
বাংলাদেশে পিঠার সঙ্গে শীত ঋতুর যেন গভীর প্রণয়ের সম্পর্ক। পিঠা বস্তুটির কথা ভাবলেই মনের দুয়ারে কিছু দৃশ্য হেঁটে হেঁটে চলে আসে। শীতের সকালে গাছি ভাই খেজুরগাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামিয়ে আনছেন, তাফালে রস জ্বাল হচ্ছে, সেই গাঢ় রসে টইটম্বুর হয়ে ওঠা চিতই পিঠা হিম হিম সকালে পরখ করছেন বাড়ির ছেলে-বুড়োরা।
শীত এ দেশে পিঠার ঋতু। তা মেনে নিয়েই আজ বর্ষার পিঠা নিয়ে কিছু আলাপ হোক। পিঠা তৈরির উপকরণ প্রাপ্তির সঙ্গে ঋতুর একটা গাঁটছড়া রয়েছে। শীতে যে পিঠা হয়, তা বর্ষা বা গরমকালে হবে না। আবার কিছু পিঠা সারা বছরই হয়।
পিঠা তৈরির সঙ্গে নতুন চাল ওঠার সম্পর্ক রয়েছে। আউশ-আমন কৃষকের ঘরে ওঠে হেমন্তে। আবার বোরো ওঠে বৈশাখের শেষে। হেমন্তে নবান্ন উৎসবের মতো না হলেও গ্রীষ্মও নতুন ধান ওঠার ঋতু। তাহলে বর্ষাকালে পিঠা নিয়ে চর্চা কম কেন? দেখা যাক, আমাদের পিঠা সংস্কৃতিতে বর্ষাকালের কতটা অবদান।
যেমন কলাপিঠা—এটা বর্ষাকালেই বেশি হয়। পাকা কলা, ময়দা, চালের গুঁড়া, চিনি, বেকিং পাউডার আর তেল—এটুকু উপকরণ কলাপিঠা বানানোর জন্য যথেষ্ট। বর্ষাকালে গ্রামবাংলায় কলার প্রাচুর্যের কারণেই বাগেরহাট, খুলনাসহ সারা দেশেই এ সময় পিঠাটির সুঘ্রাণ বেশি ছড়ায়।
বর্ষা হলো কাঁঠালের ঋতু। কাঁঠাল দিয়েই এ সময় তৈরি হয় মজাদার বড়া পিঠা। এই পিঠা বানাতে লাগে নরম কাঁঠাল, চালের গুঁড়া, ময়দা, গুড় বা চিনি, বেকিং পাউডার, লবণ ও ভাজার জন্য তেল।
কাঁঠালের বড়া পিঠা বানানো এমন কঠিন কিছু নয়। নরম কাঁঠাল চালনিতে চেলে ক্বাথ বের করে নিতে হবে প্রথমে। এই ক্বাথে মিশিয়ে নিতে হবে চালের গুঁড়া ও ময়দা আধাআধি করে। এর সঙ্গে গুড় বা চিনি, সামান্য বেকিং পাউডার আর এক চিমটি লবণ দিয়ে ভালো করে মাখিয়ে রেখে দিতে হবে ১০ মিনিট। এরপর পাত্রে তেল গরম করে মাঝারি আঁচে ছোট ছোট বল আকারে ভাজতে হবে লালচে রং না হওয়া পর্যন্ত।
আজকাল ফেসবুক পেজেও নানা ধরনের পিঠা তৈরি করে বিপণন করা হচ্ছে। এসব পেজে থাকছে ঋতুভিত্তিক পিঠা তৈরির আয়োজন। পুরান ঢাকার ওয়ারীর বাসিন্দা শামশাদ রহমান, পেশায় যিনি একজন আইনজীবী, তাঁর পেজের নাম ‘শামশাদের রসুইঘর’। শামশাদ জানালেন, বর্ষাকালে তাঁর পেজের বিশেষ পিঠা হলো ইলিশ-চিতই। এটি বিক্রমপুর তথা মুন্সিগঞ্জের প্রসিদ্ধ পিঠা।
বর্ষায় যেহেতু ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ে, তাই এই সময়েই এই পিঠা বেশি তৈরি হয়। শামশাদের মতে, বানানোর প্রণালিও খুব সহজ। এর জন্য লাগবে চালের গুঁড়া, ইলিশ মাছ, কাঁচা মরিচ ও লবণ। চাল ভিজিয়ে পাটায় বেটে নিতে হবে ভেজা ভেজা করে। অথবা চালের গুঁড়া গুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে চিতই পিঠার গোলার মতো করে। অন্য একটি পাত্রে লবণ ও কাঁচা মরিচসহযোগে ইলিশ মাছ জ্বাল দিয়ে নিতে হবে পানিতে। সেদ্ধ হলে নামিয়ে রাখতে হবে।
শামশাদ রেসিপিটা বললেন এভাবে: চিতই পিঠার খোলা গরম হলে এতে চালের গোলা ঢেলে দিন, মাঝে বসিয়ে দিন এক টুকরা জ্বাল করে রাখা ইলিশ আর কাঁচা মরিচ। এরপর ঢাকনা দিয়ে দিন। এক মিনিট পর ঢাকনা খুলে তুলে নিন পিঠা। ব্যস, তৈরি হয়ে গেল মজাদার ইলিশ–চিতই। এ পিঠা খেতে হবে গরম–গরম।
এটি ইলিশ মাছের পিঠা নামেও পরিচিত। নিনা নাওয়াজের বিক্রমপুরের রান্না বইটিতে এ পিঠার রেসিপিটি রয়েছে।
তাল যদিও ভাদ্র মাসে পাকে, তবে আষাঢ়ের শেষে ও শ্রাবণের শুরুতেও তা মেলে। তাল দিয়ে নানা ধরনের সুস্বাদু পিঠা তৈরি হয় বর্ষাতেই। তালের বড়া, তালের সপ্তপুরী তো আছেই, এর সঙ্গে আছে তালের কেক পিঠা। মূলত শহরেই তৈরি হয় পিঠাটি।
সারা বাংলাদেশে চোখ রেখে কিছু আঞ্চলিক পিঠার নামও জানা গেল, যেগুলো এই ঘন ঘোর বর্ষাতেই তৈরি হয়। খুলনার গ্রামগঞ্জে সেদ্ধ চাল ভেজে আধভাঙা করে গুড় ও নারকেল দিয়ে জ্বালিয়ে হাতের মধ্যে চেপে একটা জনপ্রিয় পিঠা তৈরি করা হয়। স্থানীয় ভাষায় এই পিঠার নাম ভুদো। সিলেট-মৌলভীবাজারে তালমন নামে যে পিঠা আছে, আদতে তা তালপিঠাই। নওগাঁয় মলকা নামের একটি পিঠা বর্ষাকালে খাওয়া হয়, যা তৈরি করা হয় চালের খুদ ও আটা দিয়ে। এ রকম আরও কিছু বিচিত্র নামের পিঠার অস্তিত্ব সারা দেশে রয়েছে।
বৃষ্টিথামা বিকেলে উঠানে মাটির চুলায় মা-কাকিদের সঙ্গে তালপিঠা, কলাপিঠা বানানো দেখা আর গরম-গরম খাওয়া আমাদের মতো অনেকেরই শৈশবের আনন্দময় স্মৃতি। বর্ষাকালে পিঠা বানানোর চল গ্রামগঞ্জ থেকে এখনো হারিয়ে যায়নি। আনন্দটা এ প্রজন্মেরও সঙ্গী হোক।