শিশু–কিশোরদের কণ্ঠ অশ্রুত রয়ে যায়

দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি শিশুর অধিকার নিয়ে। তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়—সমাজের বিভিন্ন স্তরের শিশুদের সাহচর্য পাওয়ার অনন্য অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। শিশুদের সান্নিধ্য যে পবিত্রতা আর সরলতায় আমাকে উদ্ভাসিত করেছে, ওদের ভাবনাগুলো যেভাবে ঋদ্ধ করেছে, বড়দের ক্ষেত্রে সে রকম হয়নি। শিশুদের ভাবনায় যে নিষ্কলুষতা আর সরলতার সন্ধান পেয়েছি, তা যদি বড়দের মধ্যে থাকত তাহলে নিশ্চয়ই এত দিনে এই পৃথিবী স্বর্গভূমিতে পরিণত হতো। কিন্তু শিশুমনের সেসব ভাবনা শুনবে, তেমন মানুষ এই জগতে কোথায়! 

আমার কেবলই মনে হয়, শিশুদের ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্ম’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে আমরা হয়তো ওদের বর্তমান অস্তিত্ব আর ওদের চাওয়া–পাওয়াগুলোকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। আমরা বড়রা স্বার্থপরের মতো ধরেই নিয়েছি, শিশুরা কী এমন জানে! কীই-বা বলার আছে ওদের! আমরা চেয়েছি শিশুরা ঠিক ততটুকুই বলবে, যতটুকু আমরা বড়রা শুনতে চাইব।

শিশুর সংজ্ঞা কী

প্রায় ৫৫ বছর হতে চলল বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে বিস্ময়কর হলো, স্বাধীনতার ৫৫ বছরেও এই রাষ্ট্র ‘শিশু’র সর্বজন গ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ দেশে প্রচলিত আছে নানা আইন ও নীতিমালা। কিন্তু এসব আইন ও নীতিমালায় শিশুর বয়স-সংক্রান্ত সমন্বয়হীন ব্যাখ্যা শিশুর সংজ্ঞাকে বিভ্রান্ত করেছে বারবার।

শিশুর সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন শিশুর জন্য সর্বজনীন ও গ্রহণযোগ্য একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করা এবং সে অনুযায়ী শিশুর অধিকার নিশ্চিত করা। শিশু আইন ২০১৩-এর ৩-এর ধারা ৪-এ বলা হয়েছে, ‘বিদ্যমান অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হইবে।’

কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রচলিত বিভিন্ন আইন ও নীতিমালায় শিশুর বয়স-সংক্রান্ত মারপ্যাঁচ এবং প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সংস্কার না আসায় শিশুর সংজ্ঞা ও বয়স নির্ধারণে দেখা দিচ্ছে নানা বিভ্রান্তি ও জটিলতা। শিশু বঞ্চিত হচ্ছে তার অধিকার থেকে।

শিশুর সংজ্ঞা এবং বয়স সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারিনি বলেই হয়তো আমাদের জানা নেই এ দেশে ১৮ বছরের কম বয়সী নাগরিকদের প্রকৃত সংখ্যা কত। জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ অনুযায়ী, দেশে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ৪ কোটি ৮৯ লাখের বেশি, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৯ শতাংশ। 

অন্যদিকে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী নাগরিকের সংখ্যা ৩ কোটি ১৫ লাখ ৬১ হাজার ৮১১, যা মোট জনসংখ্যার ১৯ দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থাৎ শিশু আইনে উল্লিখিত শিশুর সংজ্ঞা অনুযায়ী, দেশের মোট শিশুর সংখ্যা বের করতে হলে কাগজ-কলম সঙ্গে নিয়ে জটিল হিসাব–নিকাশে বসতে হবে। তবে বলা হয়, দেশের মোট জনসংখ্যার আনুমানিক ৪০ শতাংশ শিশু। সে হিসাবে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে ১৮ বছরের কম বয়সী নাগরিকের সংখ্যা সাড়ে ছয় কোটির বেশি।

কেমন আছে শিশুরা

প্রশ্ন হলো, কেমন আছে বাংলাদেশের এই সাড়ে ছয় কোটি শিশু? ওদের অবস্থা বোঝার জন্য যদিও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির দিকে চোখ রাখাই যথেষ্ট, তবু সাম্প্রতিক কিছু তথ্য-উপাত্তের সাহায্য নেওয়া যেতেই পারে।

বাল্যবিবাহ আজও এ দেশে শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় এক নম্বর সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। দেশের মোট শিশুর অর্ধেক মেয়ে। এই মেয়েশিশুদের আবার অর্ধেকই বাল্যবিবাহের হুমকির মুখে জীবন অতিবাহিত করছে।

দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, এমনকি যুগের পর যুগ চলে যায়; কিন্তু কিছুতেই কমে না বাল্যবিবাহ। গত মার্চ মাসে প্রকাশিত ইউনিসেফ, ইউএন উইমেন এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের ‘গার্লস গোলস: হোয়াট হ্যাজ চেঞ্জড ফর গার্লস? অ্যাডলেসেন্ট গার্লস রাইটস ওভার থার্টি ইয়ার্স’ শীর্ষক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৫১ দশমিক ৪ শতাংশেরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর হওয়ার আগে।

গ্লোবাল হাঙ্গার রিপোর্ট বা বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ২০২৪-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১১ দশমিক ৯ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার। অপুষ্টি মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলছে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে। অন্যদিকে ২০২২ সালে ইউনিসেফ এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে শ্রমের হার ছিল প্রায় ৮ দশমিক ৯ শতাংশ, যা প্রায় ৩৫ লাখ শিশুকে অন্তর্ভুক্ত করে।

এর মধ্যে প্রায় ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু আবার ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সঙ্গে যুক্ত। শিশুদের জন্য নেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্যমতে, মেগা সিটি ঢাকায় জনসংখ্যার অনুপাতে অন্তত ১ হাজার ৩০০ খেলার মাঠের প্রয়োজন, যেখানে আছে মাত্র ২৩৫টি। খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত শিশুরা হাতে তুলে নিচ্ছে মুঠোফোন-ট্যাবের মতো যন্ত্র। কিন্তু সেখানেও জাল বিস্তার করে রেখেছে সাইবার অপরাধীরা।

২০২৩ সালে প্রকাশিত সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়্যারনেস ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাইবার অপরাধ ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশের বয়সই ১৮ বছরের কম।

অপরিকল্পিত নগরে উন্মুক্ত ম্যানহোল, দখল হয়ে যাওয়া ফুটপাত, বখাটের আতঙ্ক, যানজট আর খানাখন্দে ভরা রাস্তার মধ্য দিয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন পথ চলে এ দেশের শিশুরা। ব্যস্ত রাস্তায় কোনো কারণে শিশুর হাত একবার মা-বাবার হাত থেকে ছুটে গেলে সেই শিশু আর কখনো মায়ের কোল ফিরে পাবে, তেমন নিশ্চয়তা নেই এ দেশে।

শিশুদের কাঁধে বইয়ের বোঝা বেড়েছে, বাড়েনি শিক্ষার গুণগত মান। বইয়ের ভারে শিশুর শরীর নুয়ে পড়ছে, কিন্তু শিক্ষাক্রম আর পাঠ্যপুস্তক নিয়ে বিতর্ক থামেনি। পরীক্ষাপদ্ধতি, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুও এ দেশে রাজনীতির অংশ। শিশুরা বোঝে না, কী অদ্ভুত কলাকৌশলে তাদের উপজীব্য করে শিক্ষা–বাণিজ্য আর রাজনীতি চলে এই দেশে।

সাম্প্রতিক সময়ে শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতন ও সহিংসতা মাত্রা ছাড়িয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসেই ৩০৬ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৭৫ শতাংশ বেশি। এই শিশুদের মধ্যে ৪৯ জনের বয়স ৬ বছরের মধ্যে এবং অন্যরা ৭ থেকে ১৭ বছর বয়সী। শিশুর প্রতি নির্যাতনের এই ভয়াবহতা স্তব্ধ করে দেওয়ার মতো। প্রকাশের বাইরে থেকে যায় হাজারো সহিংসতার গল্প। নিজের ঘরটি পর্যন্ত শিশুর জন্য নিরাপদ নয়।

আর কতকাল শিশুরা বঞ্চিত থাকবে

শিশুরা উদার বলেই হয়তো রাষ্ট্রকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করায় না। ওরা জানতে চায় না কেন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে শিশুরা উপেক্ষিত থাকবে কিংবা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে? কেন রাষ্ট্র শিশুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ এই দেশে? যুগের পর যুগ কেন আইন শুধু বাক্সবন্দী থাকবে? কেন ওরা মুক্ত পরিবেশে খেলতে পারবে না, চলতে পারবে না, নির্ভয়ে নিজের অনুভূতিটুকু প্রকাশ করতে পারবে না? কী অপরাধ ওদের?

কিছুদিন আগে জাতীয় শিশু অধিকার সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টাকে শিশুদের উদ্দেশে বলতে শুনেছিলাম, ‘তোমরা যেকোনো সমস্যায় সরাসরি মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করবে।’

প্রশ্ন হলো, আমরা বড়রাই যেখানে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হিমশিম খাই, সেখানে শিশুদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা? শুধু কথার জন্য কথা আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতির চমকে আর কতকাল আমরা বঞ্চিত করব শিশুদের?

ভাবতে অবাক লাগে, সাড়ে ছয় কোটি শিশুর এই দেশে শিশুদের জন্য নেই পৃথক কোনো অধিদপ্তর। এ দেশে আছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তরসহ কত রকমের অধিদপ্তর! এমনকি আছে মৎস্য অধিদপ্তর, বন অধিদপ্তর, প্রাণীদের সুরক্ষার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। কিন্তু ৪০ শতাংশ শিশুর এই দেশে শিশুদের অধিকারকে পৃথকভাবে দেখভাল করার জন্য নেই আলাদা কোনো অধিদপ্তর।

বর্তমানে ২০টির বেশি মন্ত্রণালয় শিশু উন্নয়ন ও অধিকার নিয়ে কাজ করছে। এসব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে নেই সমন্বিত পরিকল্পনা, সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ও তার বাস্তবায়ন। শিশুদের অধিদপ্তরের প্রসঙ্গটি এলেই বারবার সম্পদের সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়। অথচ শিশুদের জন্য বিনিয়োগ রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

আমরা জানি, শিশুদের জন্য বিনিয়োগ করলে এর সুফল কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বাংলাদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন হয়, অথচ দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ শিশুদের জন্য বিনিয়োগের দাবিটি বারবার উপেক্ষিত হয়।

দেশের শক্তিশালী ভবিষ্যৎ নির্মাণের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্রটি হলো শিশু। শিশুর সঠিক বিকাশ ও তাদের যোগ্য করে গড়ে তোলার অর্থ হলো দেশের ভিত্তিকে মজবুত করে গড়ে তোলা। অথচ সেই মজবুত ভিত্তি স্থাপনের বিষয়টিই উপেক্ষিত থেকে যায় বারবার।

আসুন, শিশুদের শুধু ভবিষ্যৎ হিসেবে বিবেচনা না করে তাদের বর্তমান অস্তিত্বকে মেনে নিই এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ বর্তমান নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিই। আমাদের শুনতে হবে শিশুদের কথা, তাদের অনুভব করতে হবে, বুঝতে হবে তাদের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। শিশুরা ভালো না থাকলে ভালো থাকব না আমরা। শিশুরা সঠিকভাবে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি না হলে বাঁচবে না বাংলাদেশ।

শিশুদের কণ্ঠ রোধ করে নয়, বরং তাদের কণ্ঠ চারদিকে ছড়িয়ে নির্মাণ করি আগামীর বাংলাদেশ; যে বাংলাদেশে শিশুরা আগন্তুক হিসেবে বিবেচিত হবে না। বরং সেই বাংলাদেশ হবে শিশুদের জন্য, শিশুদের নেতৃত্বে ও তাদের নির্মাণে গড়া নতুন এক বাংলাদেশ।

  • নিশাত সুলতানা: লেখক ও উন্নয়নকর্মী