বঙ্গোপসাগরে ডাকাতদের নিশানায় বিদেশি জাহাজ
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশে ছয়টি জাহাজে দুষ্কৃতকারীদের হানা।
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় দেশি–বিদেশি জাহাজে চুরি–ডাকাতির ঘটনা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছিল। এ জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রশংসাও করেছিল দস্যুতা পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। তবে এ প্রশংসা বেশি দিন ধরে রাখা যায়নি। কারণ, জাহাজের মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি–ডাকাতি করতে আবারও বিদেশি জাহাজ নিশানা করছে দুষ্কৃতকারীরা।
এশিয়ায় জাহাজে চুরি–ডাকাতি ও দস্যুতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা রিক্যাপের (দ্য রিজিওনাল কো–অপারেশন অ্যাগ্রিমেন্ট অন কমব্যাটিং পাইরেসি অ্যান্ড আর্মড রবারি এগেইনেস্ট শিপস ইন এশিয়া) প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশে ছয়টি জাহাজে হানা দিয়েছে দুষ্কৃতকারীরা। এর মধ্যে চারটি ঘটনায় দুষ্কৃতকারীরা জাহাজে উঠে মালামাল লুট করেছে। আর দুটি জাহাজে চুরি–ডাকাতির চেষ্টা করলেও সফল হয়নি। একটি ছাড়া সব কটি ঘটনা ঘটেছে বঙ্গোপসাগরের চট্টগ্রাম বন্দর জলসীমায়। গত শুক্রবার প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।
বন্দর জলসীমা যেভাবে তদারকি করা হয়, তাতে ছিঁচকে চুরির মতো ঘটনাও ঘটনার কথা নয়। এরপরও যেহেতু এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, সে জন্য বন্দর চাইলে নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে পারে।সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ, সভাপতি, শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন
বন্দরের বেতার নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বা ভিটিএমআইএসের মাধ্যমে জলসীমার সচিত্র তদারকি করা হয়। কোনো অপ্রয়োজনীয় নৌযান বড় জাহাজের কাছাকাছি গেলে সতর্ক করা হয়। আবার উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকা তদারকি করে কোস্টগার্ড। এই দুই সংস্থার বাইরে জাহাজ নোঙর করার পর সার্বক্ষণিক নজরদারির জন্য পাহারাদারও নিয়োগ দেওয়া হয়। এমন নানামুখী পদক্ষেপের পরও জাহাজে চুরি–ডাকাতির ঘটনা থামছে না।
জানতে চাইলে শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ প্রথম আলোকে বলেন, বন্দর জলসীমা যেভাবে তদারকি করা হয়, তাতে ছিঁচকে চুরির মতো ঘটনাও ঘটনার কথা নয়। এরপরও যেহেতু এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, সে জন্য বন্দর চাইলে নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে পারে।
বাংলাদেশের জলসীমায় সোমালিয়া উপকূলের মতো দস্যুতা নেই। গত দুই দশকে বাংলাদেশ জলসীমায় জাহাজ জিম্মি করার ঘটনাও ঘটেনি। এরপরও জাহাজে ছিঁচকে চুরি ও ডাকাতির ঘটনায় দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। সমুদ্রপথের বাণিজ্যেও প্রভাব পড়ে।
বন্দর জলসীমায় যেগুলো ঘটছে, তা ছিঁচকে চুরির মতো ঘটনা। বন্দর জলসীমা ২৪ ঘণ্টা তদারকি করা হয়। জাহাজে পাহারাদারও নিয়োগ দিচ্ছে শিপিং এজেন্ট। পাহারাদারদের গাফিলতির কারণে এমন কোনো ঘটনা ঘটছে কি না, তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।মো. ওমর ফারুক, বন্দর সচিব
কোন জাহাজে কখন কী ঘটেছিল
এ বছর ছয়টি ঘটনায় চারটিতে দুষ্কৃতকারীরা জাহাজে উঠে মূল্যবান পণ্য চুরি–ডাকাতি করে। আর দুটিতে হানা দিলেও সফল হয়নি। ছয়টি ঘটনার মধ্যে পাঁচটি বিদেশি জাহাজে ও একটি দেশি জাহাজে হয়েছে।
প্রথম ঘটনা ঘটে গত ১৪ জানুয়ারি কুতুবদিয়া এলাকায় বাংলাদেশের পতাকাবাহী এমটি ওমেরা লিগ্যাসি নামের একটি ট্যাংকারে। মালামাল চুরি করতে ট্যাংকারটি নিশানা করেছিল দুষ্কৃতকারীরা। জাহাজের মাস্টার দ্রুতই বন্দরের নিয়ন্ত্রণকক্ষ ও কোস্টগার্ডকে অবহিত করেন। দুষ্কৃতকারীরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়।
দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে ১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া নোঙর এলাকায়। এদিন লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী এমভি মায়ের্সক হাই পং নামের একটি কনটেইনার জাহাজে চারজন দুষ্কৃতকারী ওঠে। তারা রশি চুরি করে পালিয়ে যায়।
ওই ঘটনার তিন দিনের মাথায় কুতুবদিয়া এলাকায় এমটি গ্যাস কারেজ নামের পানামার পতাকাবাহী আরেকটি জাহাজ নিশানা করে দুষ্কৃতকারীরা। এদিন নৌযানে করে এসে নয়জন দুষ্কৃতকারী জাহাজে উঠে ওয়াচম্যানকে (পাহারাদার) বেঁধে ফেলে। তারা জাহাজের স্টোর থেকে মূল্যবান মালামাল ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
রিক্যাপের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত এক দশকে সবচেয়ে বেশি চুরি–ডাকাতির ঘটনা বা ঘটনার চেষ্টা হয়েছে ২০১৪ সালে।
চতুর্থ ঘটনা ঘটে ৩ মার্চ মোংলা বন্দরের হিরণ পাইলট স্টেশন এলাকায়। লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী এরা স্টার ট্যাংকারে হানা দেয় ৮–১০ দুষ্কৃতকারী। তাদের হাতে ছিল লম্বা ছুরি। পরে তারা পালিয়ে যায়।
পঞ্চম ঘটনা ঘটে ৩০ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে। এদিন মার্শাল আইল্যান্ডের পতাকাবাহী এএসএল লেবান জাহাজে হানা দেয় তিন দুষ্কৃতকারী। তাদের দেখে জাহাজে সতর্কসংকেত বাজানো হয়। এ সময় নাবিকেরা একত্র হলে দুষ্কৃতকারীরা নৌযানে করে পালিয়ে যায়।
সর্বশেষ ৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী এমভি মায়ের্সক চট্টগ্রাম নামের জাহাজে চুরির ঘটনা ঘটেছে। দুজন দুষ্কৃতকারী জাহাজের রং, সেফটি চেইন, ব্রাশফায়ার ও ফায়ার হোস চুরি করে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
চুরি–ডাকাতি বাড়ছে, সমাধান কী?
রিক্যাপের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত এক দশকে সবচেয়ে বেশি চুরি–ডাকাতির ঘটনা বা ঘটনার চেষ্টা হয়েছে ২০১৪ সালে। ওই বছর জাহাজে ১৬টি চুরি–ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ ও ২০২১ সালে কোনো ঘটনা ঘটেনি। ২০২২ সালে বাংলাদেশের জলসীমায় পাঁচটি ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে চট্টগ্রামে তিনটি ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালে মাত্র একটি ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছে রিক্যাপ।
জানতে চাইলে বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, বন্দর জলসীমায় যেগুলো ঘটছে, তা ছিঁচকে চুরির মতো ঘটনা। বন্দর জলসীমা ২৪ ঘণ্টা তদারকি করা হয়। জাহাজে পাহারাদারও নিয়োগ দিচ্ছে শিপিং এজেন্ট। পাহারাদারদের গাফিলতির কারণে এমন কোনো ঘটনা ঘটছে কি না, তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।