গ্রন্থকীট থেকে লেখক: আকবর আলি খানের বইয়ের জগৎ

আকবর আলি খান নিজেকে বলতেন গ্রন্থকীট। আরও বলতেন, তিনি সজ্ঞানে লেখক হতে চাননি, পাঠকই থাকতে চেয়েছেন। বই লেখা শুরু করেছিলেন ৫২ বছর বয়সে। দুই কারণে তিনি লেখক হয়েছিলেন। বিচিত্র বিষয়ে পড়তে পড়তে কিছু বিষয় নিয়ে নিজের যেসব বক্তব্য দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, পাঠকদের সেসব জানানো; আর ভালো লাগা বইগুলোর ভাবনা নিজের মতো করে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছা।

আকবর আলি খান গল্প, উপন্যাস বা কবিতা লেখেনি; যা লিখেছেন সবই প্রবন্ধ। সুনির্দিষ্ট করে বললে গবেষণা প্রবন্ধ। হতে চেয়েছিলেন শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির কারণে শিক্ষক হতে পারেননি। ঢুকেছিলেন সরকারি চাকরিতে। পরে আবার ফিরেও এসেছিলেন পছন্দের শিক্ষকতায়।

তবে যেখানেই ছিলেন, গবেষণা কখনো ছাড়েননি। তাঁর লেখা গবেষণা প্রবন্ধের প্রতিটি বই বিপুলভাবে পাঠকপ্রিয়। দীর্ঘ সময়ে গবেষণা ছাড়া কোনো বইই তিনি লিখেননি। তিনি বলেছেন, ‘পণ্ডিতদের জন্যই লিখি বা সাধারণ পাঠকদের জন্য লিখি না কেন, সব বই লেখার পেছনে রয়েছে অনেক বছরের চিন্তা ও ভাবনা।’

আরও পড়ুন

প্রবন্ধের বইয়ের বিপুল পাঠক পাওয়ার রহস্যের কথাও তিনি আমাদের জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমার শুধু একটি দোষ ছিল, আমি কিশোর বয়সে সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা গোগ্রাসে গিলেছি। এর প্রভাবে আমার অনেক গবেষণাগ্রন্থও লেখা হয়েছে রম্যরচনার ঢঙে। এই ঢঙটিই আমার লেখাকে সাধারণ পাঠকের কাছে নিয়ে গেছে।’

লেখক হিসেবে আকবর আলি খানকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম বই, পরার্থপরতার অর্থনীতি। ২০০০ সালে ইউপিএল বইটি প্রকাশ করেছিল। অর্থনীতির মতো জটিল ও দুর্বোধ্য বিষয়টি যে রম্যরচনার ঢঙে বৈঠকী মেজাজে লেখা যায় এবং সাধারণ পাঠকও সহজে আনন্দের সঙ্গে বুঝতে পারেন, এমনটা এর আগে দেখা যায়নি। তিনি এই ধারার প্রবর্তক।

আকবর আলি খানের প্রথম প্রকাশিত বই ছিল ইংরেজিতে, সাম আসপেক্টস অফ পিজেন্ট বিহেভিয়ার ইন বেঙ্গল, ১৮৯০-১৯১৪: আ নিও-ক্ল্যাসিক্যাল অ্যানালিসিস। প্রকাশ করেছিল এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, ১৯৮২ সালে। আকবর আলি খান তখন শিক্ষকতা ছেড়ে আবার ফিরে এসেছেন সরকারি প্রশাসনে। তখন তিনি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত একটি প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক। এরপর বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের জার্নালে একক বা যৌথভাবে পেশাগত কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাঁর বেশ কিছু গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

আরও পড়ুন

তাঁর দ্বিতীয় বইটিও ইংরেজি ভাষাতেই লেখা, ডিসকভারি অব বাংলাদেশ: এক্সপ্লোরেশন ইন্টু ডাইনামিকস অফ আ হিডেন নেশন।’ অনেক পরে, ২০০৪ সালে, বইটির অনুবাদ প্রকাশ করেছিল বাংলা একাডেমি।

আকবর আলী খান
প্রথম আলো ফাইল ছবি

আমলা থেকে অবসর নেওয়ার পরে তাঁর লেখা প্রথম বইটি ছিল ইংরেজি ভাষায় লেখা, ফ্রেন্ডলি ফায়ারস, হামটি ডামটি ডিসঅর্ডার, অ্যান্ড আদার এসেজ: রিফ্লেকশনস অন ইকোনমি অ্যান্ড গভর্নেন্স ইন বাংলাদেশ। ২০১০ সালে প্রকাশ করেছিল ইউপিএল। পরের বছর প্রকাশিত হয় অন্ধকারের উৎস হতে: সাহিত্য, সমাজ, পরিবেশ ও অর্থনীতি সম্পর্কে আলোর সন্ধান নামের বইটি। পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশিত এ বইটির নির্দিষ্ট কোনো বিষয় ছিল না। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য—নানা প্রসঙ্গে ছিল এতে।

এরপর লেখার ক্ষেত্রে আকবর আলি খানের আরেকটি পরিবর্তন দেখা যায়। তিনি আরও নয়টি বই এরপর প্রকাশ করেছেন। সেসবের একটি ছিল ইংরেজিতে, বাকি আটটি বাংলায়। প্রতিটি বই নির্দিষ্ট বিষয়কে থিম করে। তাঁর এই পর্যায়ের সবগুলো বইয়ের প্রকাশক প্রথমা প্রকাশন। প্রথমার ওপর বইয়ের জন্য নিরঙ্কুশ আস্থা আর বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন তিনি।

আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি ছিল প্রথমা থেকে প্রকাশিত আকবর আলি খানের প্রথম বই। ২০১৩ সালের এই বইটির বিষয়বস্তু অর্থনীতি, সেই রম্য ঢঙেই লেখা। ১৯৭৩ সালে তিনি কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন অর্থনীতিতে উচ্চশিক্ষা নিতে। তখন থেকেই অর্থনীতির তত্ত্বগুলো বাংলায় উপস্থাপনের কথা ভাবছিলেন। তারই ফসল এই বই। অর্থনীতি নিয়ে পরে আরও দুটো গবেষণামূলক বই প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর—২০২০ সালে দারিদ্র্যের অর্থনীতি: অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এবং ২০২১ সালে বাংলাদেশে বাজেট: অর্থনীতি ও রাজনীতি।

দারিদ্র্য এ অঞ্চলের প্রধানতম সমস্যা। যুগ যুগ ধরে অসংখ্য প্রকল্প তৈরি হয়েছে দারিদ্র্য কমানোর লক্ষ্য নিয়ে। খরচ করা হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাংলা ভাষায় কেবলই দারিদ্র্য নিয়ে একমাত্র বইটি আকবর আলি খানেরই লেখা। ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘দীর্ঘ ৫২ বছর ধরে দারিদ্র্য নিয়ে পড়াশোনা করেছি, কোথাও নিরীক্ষা করেছি, কোথাও সরাসরি কাজ করেছি। এসব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই আমি এই বই লিখেছি। আশা করি, এই বইয়ের মাধ্যমে দারিদ্র্য সম্পর্কে আমার চিন্তাভাবনা বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারব।’

কেবল দারিদ্র্যই নয়, বাজেট নিয়ে বড় গবেষণাটিও আকবর আলি খানেরই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন শেষে তিনি অর্থসচিব হয়েছিলেন ১৯৯৫ সালে। সব মিলিয়ে ৯টি বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাজেট নিয়ে বইটি ছিল সেই বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে তত্ত্বের এক দারুণ সংমিশ্রণ। এতে বাংলাদেশের বাজেটের পরিবর্তনগুলো যেমন ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, তেমনি বাজেট ব্যবস্থার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধানগুলোও খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন তিনি।

আকবর আলি খানের কৌতূহল বিচিত্র বিষয়ে। বনলতা সেনকে নিয়ে তিনি চিন্তা শুরু করেছিলেন ১৯৬৮ সাল থেকে। সে চিন্তার পরিপূর্ণ ফসল বের হলো ২০১৪ সালে। প্রথমা থেকে বের হলো চাবিকাঠির খোঁজে: নতুন আলোকে জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা প্রশ্ন আর নানা চিন্তা শুরু করেছিলেন সেই ১৯৬১ সালে, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে।

সেসবেরই পরিণতি দুর্ভাবনা ও ভাবনা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, প্রকাশিত হল ২০১৯ সালে। ১৯৭৭ সালে কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করার সময় পুরোনো যেসব আদমশুমারির প্রতিবেদন পড়েছিলেন, তারই সূত্র ধরে ইতিহাস নিয়ে তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য বই বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ, প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।

অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি বেরিয়েছে ২০১৭ সালে। এর মূল অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের বিশ্লেষণ। আকবর আলি খান ভূমিকায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অনেক অর্জনের জন্য আমি গর্বিত। তবু রাজনৈতিক অবক্ষয় ও সুশাসনের ক্রমাগত অধোগতি আমার প্রজন্মের যারা আমার মতো গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাদের জন্য দৈহিক যন্ত্রণার চেয়েও মর্মান্তিক মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করেছে। এই গ্রন্থের জন্ম এই যন্ত্রণাবোধ থেকেই।’ আমলাজীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে গভীর তত্ত্ব ও তথ্যের মিশ্রণে লেখা বই বাংলাদেশের প্রশাসন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকাশনা।

আকবর আলি খান আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেছিলেন। আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড পুরোনো সেই দিনের কথা তাঁর শেষ প্রকাশিত বই। প্রকাশ পেয়েছে এ বছরই। এর দ্বিতীয় খণ্ড লেখার কাজও শুরু করেছিলেন। শেষ করে যেতে পারলেন না।

এ ছাড়া পানির সংকট এবং বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে আরও দুটি বই লেখার কথা তিনি জানিয়েছিলেন আত্মজীবনীতেই। তবে লিখেছিলেন, ‘শেষ পর্যন্ত এই বইগুলো লেখার কাজ সমাপ্ত করতে পারব কি না, সে বিষয়ে আমি এখনো নিশ্চিত নই।’

শেষ পর্যন্ত তাই হলো। গত বৃহস্পতিবার, ৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যু হলো তাঁর। ফলে অনেক অজানা তথ্য অজানাই থেকে গেল। পাঠকেরাও বঞ্চিত হলেন নানা বিষয় নিয়ে লেখা অন্তর্দৃষ্টিময় নতুন নতুন বই থেকে।