মুক্তিযুদ্ধের মোড় ফেরানো একটি পর্ব

একাত্তরের ৫ ও ৬ জুলাই গোপনে শিলিগুড়ি সম্মেলনে সমবেত হয়েছিলেন প্রবাসী সরকারের নেতারা এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সদস্যরা। গুরুত্বপূর্ণ এ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে প্রবাসী সরকার শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তৈরি হয় ঐক্য–সমঝোতা, গতি সঞ্চার করে মুক্তিযুদ্ধে। দুর্লভ নথির ভিত্তিতে মতিউর রহমান সম্পাদিত ও প্রথমা প্রকাশন প্রকাশিত ‘১৯৭১: দ্য শিলিগুড়ি কনফারেন্স’ বই অবলম্বনে মুক্তিযুদ্ধের মোড় ফেরানো সেই ঘটনা নিয়ে বিশেষ লেখা।

১৯৭১: দ্য শিলিগুড়ি কনফারেন্স, সম্পাদনা: মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হামলার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। দু-চারটি বড় শহর ছাড়া প্রায় সারা দেশই মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনেকে আত্মগোপন করেন অথবা ভারতে আশ্রয় নেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। কোনো সরকার গঠন ছাড়াই স্বাধীনতাযুদ্ধের সূত্রপাত হয়।

৩ এপ্রিল রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে স্বাধীনতাযুদ্ধে সহযোগিতা চান। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা নিশ্চিত করার এবং সরকার গঠনের পরামর্শ দেন। তাজউদ্দীন আহমদ অল্প কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে আলোচনা করে ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, নিজেকে প্রধানমন্ত্রী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে মন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী সরকার গঠন করেন। সাবেক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৭ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা মুজিবনগরে শপথ নেন।

নিদারুণ বাস্তবতায় প্রবাসী সরকার গঠনপ্রক্রিয়ায় তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি বা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের মতামত নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই শুরু থেকেই তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্ব এবং নবগঠিত সরকার নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রায় প্রত্যেকেই নিজেদের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যোগ্য মনে করতে থাকেন এবং তরুণ নেতারা নিজেদের শেখ মুজিবের বৈধ প্রতিনিধি বলে দাবি তোলেন। ভারতীয়রা তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষে থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে বিতর্ক বাড়তে পারেনি। তবে তাজউদ্দীন আহমদ এবং তাঁর সরকার তাঁদের নিয়মিত কর্মকাণ্ডে নানা পক্ষের কাছ থেকে অনবরত বাধা পেতে থাকেন এবং সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হন।

প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্লাহ নীরবতা ভেঙে বইয়ে বলেছেন, ‘মুজিবনগর প্রবাসী সরকার গঠন কিংবা তাজউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রী করা অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। তরুণ অংশ চাইছিল তারা নেতৃত্ব দেবে। আবার দেশের একটি ভৌগোলিক অঞ্চলের লোক চাইছিল, তাদের এলাকার লোক প্রধানমন্ত্রী হবে। অর্থাৎ চরম দুঃসময়েও গোষ্ঠীস্বার্থ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছিল।’

তাজউদ্দীন আহমদের বিরোধিতার পাশাপাশি নেতারা নিজেরাও কোন্দল ও উপদলীয় বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। দলীয় শৃঙ্খলা বিপর্যস্ত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত নৌ-কমান্ডো শিবিরের অধিনায়ক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আহমেদ রেজা একাত্তরের স্মৃতিচারণ বইয়ে লিখেছেন, ‘১৭ এপ্রিল পাঁচ সদস্যের অস্থায়ী সরকার গঠিত হলেও উপদলীয় মতবিরোধের কারণে এই সরকারের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের মধ্যেও সামগ্রিক স্বীকৃতি লাভে বহুলাংশে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দলীয় তথা জাতীয় নেতৃত্ব কবজা করার অভিলাষে যে উপদলীয় তৎপরতা চলছে, প্রশ্নাতীতভাবে সে কারণে পরিস্থিতির জটিলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিনে দিনে। আওয়ামী লীগের উপদলীয় অনেক নেতাই প্রধানমন্ত্রিত্ব ও মন্ত্রিত্বের দাবিদার এবং তাঁদের সবারই নিজস্ব সমর্থক কর্মী গোষ্ঠী আছে।’

সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগের অধিকাংশ সদস্যের আশা ছিল যে সরকার তাঁদের পরামর্শে চলবে। এই চাহিদা পূরণ না হওয়ায় তাঁরা ক্ষুব্ধ হন। এ সম্পর্কে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য মো. আবদুল মোহাইমেন ঢাকা-আগরতলা-মুজিবনগর বইয়ে লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ পার্টি বরাবরই চেষ্টা করে আসছিল যাতে সরকার তাদের নির্দেশ ও নিয়মকানুন অনুসারে চলে। ঘন ঘন ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং হবে। সরকার সব সময় তাদের কাছে জবাবদিহি করবে। কিন্তু ওই সময় বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে ও উপদলীয় কোন্দলের কারণে যুদ্ধপ্রস্তুতি ব্যাহত হতে পারে মনে করে তাজউদ্দীন সাহেব ও তাঁর সরকার অনেকটা স্বাধীনভাবে কাজ করে যাচ্ছিল। এ সময় পার্টিতে কোন্দল খুব গুরুতর আকার ধারণ করে। আজিজ-সেরনিয়াবাত গ্রুপ, মিজান-মোশতাক গ্রুপ, কামারুজ্জামান-ইউসুফ আলী গ্রুপ প্রভৃতি তাজউদ্দীনকে ক্ষমতাচ্যুত করে নতুন সরকার গঠনের জোর তৎপরতা আরম্ভ করে।’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

সরকার গঠনের পর প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও যুদ্ধে গতি সঞ্চারিত হয়নি, প্রাথমিক বিজয়ও ধরে রাখা যায়নি, বরং মুক্তিযোদ্ধারা সর্বত্র পিছিয়ে পড়তে থাকেন। এই পরিস্থিতি সবার মধ্যে হতাশার জন্ম দেয়।

সাংবাদিক মঈদুল হাসান মে মাসে তাজউদ্দীন আহমদের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি তাজউদ্দীন আহমদ এবং তাঁর সরকারের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে মূলধারা ’৭১ বইয়ে লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগের ভেতরে একটি গ্রুপের পক্ষ থেকে তাজউদ্দীনের যোগ্যতা এবং তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের বৈধতা নিয়ে নানা বিরুদ্ধ প্রচারণা চলতে থাকে। কর্নেল ওসমানীর বিরুদ্ধেও এই মর্মে প্রচারণা চলতে থাকে যে মুক্তিযুদ্ধ ব্যবস্থাপনায় তাঁর অক্ষমতার জন্যই মুক্তিসংগ্রাম দিনের পর দিন স্তিমিত হয়ে পড়েছে।’

সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত তাজউদ্দীন আহমদ এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষ উত্তরণের পথ খুঁজতে থাকেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বইয়ে লিখেছেন, ‘এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্য ও নেতাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। কারণ, এমন একটি বৈঠকই প্রমাণ করতে পারে যে তাজউদ্দীন সরকারের প্রতি সংশ্লিষ্ট সবার শুধু সমর্থনই নেই, এ পর্যন্ত তাঁর সব কার্যক্রমের প্রতিও তাঁদের অনুমোদন রয়েছে।’

সম্মেলনের প্রস্তুতি

১০ জুন ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব অশোক কে রায় তাজউদ্দীন আহমদকে দ্রুত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সম্মেলনের প্রস্তাব করেন। অশোক রায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ ডেস্কের কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর কার্যালয় ছিল কলকাতায় ইস্টার্ন কমান্ড সদর দপ্তরে। তিনি প্রথমে ১৯ জুন মেঘালয় রাজ্যের তুরায় এই সম্মেলনের প্রস্তাব করেন। তাজউদ্দীনের সম্মতি সত্ত্বেও এত দ্রুত সবাইকে জড়ো করার অসুবিধা বিবেচনা করে সম্মেলন পিছিয়ে ৫ ও ৬ জুলাই হিমালয়ের পাদদেশে শিলিগুড়ি শহর-সংলগ্ন বনে নির্ধারণ করা হয়। শিলিগুড়ি শহর পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং দুই জেলারই প্রতিনিধিত্ব করে। যুদ্ধপূর্ব নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সদস্যরা সম্মেলনে অংশ নেন।

সম্মেলনের আয়োজন এবং তা সফল করার দায়িত্ব দেওয়া হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতীয় আধা সরকারি বাহিনী বা বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)। সেনাবাহিনীর তরফ থেকে তুরায় অবস্থিত ৩৩ কোর সদর দপ্তরকে সম্মেলনের সমন্বয়ক নির্ধারণ করা হয়। বিএসএফ সম্মেলনের আবাসন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় জড়িত ছিল। ব্রিগেডিয়ার এ কে মিত্র ৩৩ কোরে প্রশাসনের ব্রিগেডিয়ার ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি উপস্থিত থেকে পুরো সম্মেলনের তদারক করেন। তাঁকে সহযোগিতা করেন ৩৩ কোর সদর দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল (এএজি) লে. কর্নেল কে এ মজুমদার এবং ৬৪৭ ফিল্ড সিকিউরিটি সেকশনের ক্যাপ্টেন এ ডি সুরভি।

প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম

শিলিগুড়ি সম্মেলনে আমন্ত্রিত আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি এবং ১৯৭০ সালে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রায় সবাই উপস্থিত হন। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল, ‘দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এই সভায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের ৩৭৪ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ জরুরি কাজে ব্যস্ত ৩০ জন সদস্য উপস্থিত হতে পারেননি। তাঁরা এই সভার যেকোনো সিদ্ধান্তের প্রতি তাঁদের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং একাত্মতা প্রকাশ করে বাণী প্রেরণ করেন।’ (জয়বাংলা, ১৬ জুলাই ১৯৭১)। ৩৭৪ জনের মধ্যে ১৩৫ জন ছিলেন জাতীয় পরিষদের সদস্য, বাকিরা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা প্রতিনিধিসহ বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা।

৪ জুলাই সম্মেলনে যোগ দিতে আওয়ামী লীগের সদস্যরা নানা পথে শিলিগুড়ি শহরে এসে পৌঁছান। সেখান থেকে তাঁদের শিলিগুড়ি শহরের উপকণ্ঠে বিএসএফের শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়।

নিরাপত্তার কারণে সম্মেলনের কথা গোপন থাকে। সম্মেলনের স্থান ও সময় অংশগ্রহণকারীদেরও জানানো হয় একেবারে শেষ মুহূর্তে। সর্বোচ্চ গোপনীয়তা সত্ত্বেও আনন্দবাজার পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়, ‘বাংলাদেশের কোথাও দেশের গণপ্রতিনিধিদের অধিবেশন শুরু হয়েছে। এই অধিবেশনে গুপ্ত জাতীয় পরিষদের শতাধিক নির্বাচিত সদস্য (এমএনএ) যোগ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনসহ বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সদস্যরা এবং রাষ্ট্রের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব নজরুল ইসলাম বৈঠকে উপস্থিত রয়েছেন।’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ জুলাই ১৯৭১)

উত্তপ্ত সূচনা

আওয়ামী লীগের শিলিগুড়ি সম্মেলন মুক্তিযুদ্ধের খুবই অনালোচিত একটি অধ্যায়। এর বিস্তারিত বিবরণ বা আনুষ্ঠানিক কার্যবিবরণীও সংরক্ষিত নেই। ফলে সম্মেলনটি সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য পাওয়া দুষ্কর। সম্মেলনে অংশ নেওয়া প্রায় ৪০০ প্রতিনিধির মধ্যে মাত্র কয়েকজন এ প্রসঙ্গে সামান্য কিছু তথ্য লিখে রেখেছেন। সেখান থেকে সম্মেলন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া কঠিন। অথচ এই সম্মেলন এবং এর অব্যবহিত পরে অনুষ্ঠিত সামরিক নেতাদের সম্মেলন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি, কোন্দল ও বিবাদের অবসান ঘটায় এবং যুদ্ধের সার্বিক নীতি ও কৌশল তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন ভারত থেকে এই সম্মেলনের আংশিক কার্যবিবরণী সংগ্রহ করে বই হিসেবে প্রকাশ করেছে। তাতে শিলিগুড়ি সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক সভা, সদস্যদের আলোচনা এবং ভারতীয় পর্যবেক্ষকদের মূল্যায়ন পাওয়া যায়। কার্যবিবরণীতে সম্মেলনের মূল প্রতিবেদন যুক্ত না থাকলেও সম্মেলনের সময়সূচি, গোপন সভার কার্যবিবরণী, জাতীয় পরিষদের সদস্য মিজানুর রহমান চৌধুরীর বিবৃতি, ভারতীয় পর্যবেক্ষক ব্রিগেডিয়ার এ কে মিত্রের প্রতিবেদন, লে. কর্নেল কে এ মজুমদারের প্রতিবেদন ও ক্যাপ্টেন এ ডি সুরভির প্রতিবেদন ধারাবাহিকভাবে যুক্ত আছে।

প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ

৫ জুলাই সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই গোপন সভায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভাপতিত্ব করেন। মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, বিশেষভাবে আমন্ত্রিত কয়েকজন এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর পর্যবেক্ষকসহ সভায় ৪০ জন উপস্থিত ছিলেন।

শুরুতে প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘ বক্তৃতা দেন। তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধের পটভূমি, আওয়ামী লীগের ইতিহাস, জাতীয় নির্বাচন, পাকিস্তানিদের আক্রমণ, যুদ্ধের বর্তমান অবস্থা ইত্যাদির বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, সরকারের অনেক দুর্বলতা আছে, ভুলও করেছে। আওয়ামী লীগের সদস্যদের মধ্যে কলহ, অভিযোগ ও সন্দেহ জন্মেছে। সরকারকে ক্ষমতা ও সহযোগিতা না দিলে তা কার্যকর হবে না। তিনি সরকারের ঐক্যের প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব দেন।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা নিয়ে অনেকে আলোচনা করেন। মিজানুর রহমান চৌধুরী দল, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়, বিশেষ করে মাঠপর্যায়ের সমস্যা তুলে ধরেন। রণাঙ্গনে বিভিন্ন ব্যর্থতার কথাও বলেন। তিনি মুক্তিবাহিনী, যুব শিবির, অভ্যর্থনা শিবির, প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলো আরও কার্যকরভাবে সংগঠিত করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর আলোচনা বিশদভাবে তুলে ধরেন। এরপর একটি লিখিত বিবৃতি পড়ে শোনান।

বিবৃতিতে মিজানুর রহমান চৌধুরী চলমান সশস্ত্র যুদ্ধের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন এবং এর বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। মুক্তিবাহিনী অস্বাভাবিক অসুবিধার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ করছে। তাদের রেশন ও ভাতা অপ্রতুল ও অনিয়মিত। অধিকাংশের সাধারণ পোশাক, গরম কাপড় ও জুতা নেই। বাইনোকুলার, কম্পাস, টর্চ, বর্ষাতি, তাঁবুর সরবরাহ নেই। রেডিও, পত্রিকাসহ বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। ওষুধ, সার্বক্ষণিক চিকিৎসক ও নিরাময়কেন্দ্র নেই। সম্পূর্ণ সুস্থতার আগেই রোগীকে হাসপাতাল ছেড়ে দিতে হয়।

মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, মুক্তিবাহিনীতে নেতৃত্বের কাঠামো সন্তোষজনক নয়। সেনাপতি ও সেক্টর অধিনায়ক এবং সেক্টর অধিনায়ক ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সমন্বয় নেই। যুব শিবিরে যুবকেরা মানবেতর অবস্থায় থাকছে। বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য যুবক প্রশিক্ষণের জন্য এলেও সমন্বয়ের অভাবে অধিকৃত এলাকায় ফিরে যাচ্ছে। এসব অনিয়ম চলতে থাকলে আশাবাদীরাও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে।

গোপন সভার সমাপ্তি

মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী মিজান চৌধুরীর বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, বিবৃতি তৈরির আগে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করলে মিজান চৌধুরীর বিবৃতি বাস্তবানুগ হতো। প্রধান সেনাপতি তাঁর বিভিন্ন অভিযোগের উত্তর দেন। দেশে গজিয়ে ওঠা প্রাইভেট আর্মির কথা বলেন। তবে যুদ্ধ পরিচালনায় কিছু প্রতিবন্ধকতার কথাও স্বীকার করেন।

বক্তাদের আলোচনা থেকে ভারতীয় পর্যবেক্ষকেরা ধারণা করেন, ওয়ার্কিং কমিটি এবং মন্ত্রিপরিষদের মধ্যে ব্যবধান বিস্তর। প্রবীণেরা রাজনীতি, অর্থনীতি ও রণনীতিতে দলের প্রাধান্য রক্ষায় অবিচল থাকলেও সংসদীয় বিষয়, কার্যসম্পাদনের কূটকৌশল এবং যুদ্ধ পরিচালনার জটিল ব্যবস্থা সম্পর্কে অধিকাংশের ধারণাই নগণ্য।

৬ জুলাই সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত যুদ্ধপূর্ব নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। দুই ওয়ার্কিং কমিটির ৩৯ জন সদস্য সভায় ছিলেন। সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

ব্রিগেডিয়ার এ কে মিত্র
ছবি: ‘১৯৭১: দ্য শিলিগুড়ি কনফারেন্স’ বই থেকে

সভায় দলের সাংগঠনিক বিষয়, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা হয়।

নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম কামারুজ্জামান সভায় সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বদলে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নিরস্ত্র ও নিরীহ বাঙালির ওপর অতর্কিতে নৃশংসতম গণহত্যা চালায়। তাই বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

সভায় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করা হয় এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নতুন নাম দেওয়া হয় ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের নতুন কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম নতুন ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের শপথ পাঠ করান। কমিটির সদস্যরা বাংলাদেশ থেকে হানাদার বাহিনী উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প করেন।

প্রথম অধিবেশন

৫ জুলাই বেলা দেড়টা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত সাধারণ সভার প্রথম অধিবেশন এবং ৬ জুলাই বিকেল সাড়ে চারটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত সাধারণ সভার দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। দুটিরই সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সাধারণ সভায় মন্ত্রিপরিষদ এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা অংশ নেন।

সভার শুরুতে সভাপতি বক্তৃতা করেন। তিনি ২৫ মার্চ–পরবর্তী ঘটনাবলি পর্যালোচনা করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। তিনি জানান, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, আনসার ও পুলিশ সদস্যদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছে। পরে অন্যরাও যোগ দিয়েছে। তিনি মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে তাঁদের অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, রাশিয়া বাংলাদেশের আন্দোলনে সহানুভূতিশীল হলেও চীন প্রতারণা করেছে। অন্য দেশগুলোর স্বীকৃতি কেন পাওয়া যাচ্ছে না—তিনি তার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, স্বীকৃতি না পেলেও বাংলাদেশ সরকার এবং এর জনগণ বহির্বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে। তিনি ভারতীয় সহায়তার ব্যাপারে সবাইকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বলেন। তবে এ–ও জানান যে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য আরও বেশি সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে।

গার্ড অব অনারে সালাম গ্রহণ করছেন প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম

সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাজনৈতিক নেতা এবং মুক্তিবাহিনীর অধিনায়কদের মধ্যে পার্থক্য দূর করতে বলেন। জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের (এমপিএ) ঐক্যবদ্ধ থেকে একই মত ও নীতি মেনে চলতে অনুরোধ করেন। প্রশিক্ষণকেন্দ্রে তরুণ শরণার্থীদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। ওয়ার কাউন্সিল গঠন, বাংলাদেশকে কয়েকটি জোনে ভাগ এবং জোনগুলোকে সেক্টর ও সাবসেক্টরে ভাগ করার প্রস্তাব করেন।

সভাপতির বক্তব্য সম্পর্কে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য মো. আবদুল মোহাইমেন ঢাকা-আগরতলা-মুজিবনগর বইয়ে লিখেছেন, ‘সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেদিন তেজস্বী ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলীকে যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন সেটা মনে রাখার মতো। আমাদের শেষ বিজয় সম্পর্কে অনেকের মনে যেটুকু সন্দেহ ও দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল, সৈয়দ নজরুল ইসলামের দীপ্ত ও প্রাণবন্ত বক্তৃতায় তা অনেকটা কেটে গেল।’

দ্বিতীয় অধিবেশন

৬ জুলাই বিকেলে সাধারণ সভার দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। শুরুতেই বক্তব্য দেন প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী। তিনি মুক্তিবাহিনী গঠন ও বিকাশের বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ প্রাথমিকভাবে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাই যুদ্ধের আগে দলে সামরিক নেতৃত্ব ও সামরিক সংগঠনের কোনো কাঠামো তৈরি হয়নি। ২৫ ও ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানিদের হামলার পর সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। পরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি ব্যাটালিয়ন, অধিকাংশ ইপিআর, আনসার এবং পুলিশ সদস্যরা সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দেয়। এভাবে গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী। তারাই পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুরুতে তারা সম্মুখযুদ্ধ করত, এখন করছে গেরিলা পদ্ধতিতে।

এম এ জি ওসমানী বলেন, মুক্তিবাহিনীর জন্য হাতিয়ার ও গোলাবারুদ, বিশেষ করে ভারী অস্ত্র এবং বেতারযন্ত্র ও চিকিৎসাব্যবস্থা অত্যন্ত অপ্রতুল। যানবাহন, প্রয়োজনীয় পোশাক ও যুদ্ধসামগ্রী সময় ও পরিমাণমতো পাওয়া যাচ্ছে না, শরণার্থীদের প্রতি ভারত সরকার যথাযথ মনোযোগ দিচ্ছে না এবং যুবশিবিরের আয়োজনও সন্তোষজনক নয়। তবে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিএসএফের কাছ থেকে মুক্তিবাহিনীর প্রশাসনিক দায়িত্ব নেওয়ার পর সামান্য উন্নতি দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে সব জানানো হয়েছে। তিনি ভারতের কিছু নীতির সমালোচনা করার সময় পেছন থেকে কিছু সদস্য টিটকারি দেন।

এরপর বক্তব্য দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। দীর্ঘদিন পর সভার আয়োজন করার জন্য তিনি ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান। সংগ্রামরত মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানান এবং দেশের জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। এমএনএ ও এমপিএদের মধ্যে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের শরণার্থীদের ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার এবং জনগণ সর্বোচ্চ সহযোগিতা দিচ্ছে। শরণার্থীদের জন্য ভারত প্রতিদিন প্রায় দেড় কোটি রুপি খরচ করছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা

ভারত যে যথেষ্ট পরিমাণে অস্ত্র, যন্ত্রপাতি এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করছে না—প্রধান সেনাপতির এ মতের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ পুরোপুরি একমত নন বলে জানান। প্রধান সেনাপতিকে বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে তিনি খাপ খাইয়ে নিতে পরামর্শ দেন। কিছু সদস্যের উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কেও তিনি দ্বিমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ভারত সম্পূর্ণ চাহিদা পূরণ করতে না পারলে তাঁরা অন্য দেশের সাহায্য নিতে পারেন।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সাধারণ সভায় ১১টি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র-গোলাবারুদ সরবরাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিবাদ জানানো।

সাধারণ সভার দুই অধিবেশনে বিভিন্ন বক্তার বক্তব্য এবং প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য মো. আবদুল মোহাইমেন ঢাকা-আগরতলা-মুজিবনগর বইয়ে লিখেছেন, ‘মিটিং আরম্ভ হওয়ার প্রথম দিকে কিন্তু উপদলীয় নেতাদের মধ্যে মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, খুলনার শেখ আ. আজিজ প্রভৃতির নেতৃত্বে আরও দু–চারজন বিরোধী নেতা সরকার গঠনের পর তিন মাসব্যাপী যথেষ্ট ব্যর্থতার নজির তুলে ধরে সরকার ও বিশেষভাবে তাজউদ্দীন সাহেবকে আক্রমণ করে জোরালো বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করেছিলেন।...সুখের বিষয়, বিরোধী নেতাদের এসব বক্তৃতা উপস্থিত শ্রোতাদের বিশেষ প্রভাবিত করতে পারেনি। শামসুল হক, আবদুল মান্নান, ব্যারিস্টার আমীর–উল ইসলাম, আবদুস সামাদ আজাদ প্রমুখ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ সরকারের সমর্থনে নতুন সরকারের শক্তির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যুদ্ধপ্রচেষ্টাতে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে এবং বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা ও সদস্যদের সুখ–সুবিধার জন্য কতটুকু বন্দোবস্ত করা হয়েছে, তার বিবরণ দেবার পর উপস্থিত সদস্যরা তুমুল হর্ষধ্বনির মাধ্যমে তাজউদ্দীন সরকারের প্রতি আস্থাজ্ঞাপন করেছিলেন।’

ভারতীয়দের পর্যবেক্ষণ

ভারতীয় পর্যবেক্ষকেরা সম্মেলনের প্রতিটি সভায় উপস্থিত ছিলেন। সাধারণ সভায় বিভিন্ন বক্তার বক্তব্য শুনে তাঁদের মনে হয়েছিল, অধিকাংশ বক্তৃতায় বাস্তবতার চেয়ে আবেগ ছিল বেশি। তাঁদের বক্তব্যে বারবার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা ও গণহত্যার প্রসঙ্গ এসেছে। প্রায় সব নেতাই ভারতের সহায়তার কথা বলেছেন। একমাত্র প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী পরিস্থিতির বাস্তবানুগ বিশ্লেষণ করেছেন। তিনিই উপলব্ধি করেছেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ একান্তভাবে নিজেরই দায়িত্ব এবং নিজেদেরই তা অর্জন করতে হবে।

ব্রিগেডিয়ার এ কে মিত্র সম্মেলনে পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত থেকে আলোচনা শোনার পাশাপাশি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং এম এ জি ওসমানীর সাক্ষাৎকার নিয়ে তার ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রতিবেদনে তিনি মূলত নেতৃত্ব এবং ভারত সম্পর্কে অংশগ্রহণকারীদের মনোভাব বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য ও মতামত দেন।

ব্রিগেডিয়ার মিত্র সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় লক্ষ করেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ধীরস্থির মেজাজের মানুষ। প্রধানমন্ত্রীও মানুষ হিসেবে ধীরস্থির ও মনোযোগী, তথ্যপূর্ণ বক্তা ও মতপ্রকাশে স্বল্পভাষী। তাঁকে তিনি সুশিক্ষিত, শান্ত কিন্তু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বলে মন্তব্য করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তাঁর চালাক, রসিক ও কিছুটা সতর্ক মনে হয়। তিনি গুরুতর বিষয়ে কথা বলেননি এবং তীক্ষ্ণ প্রশ্ন চাতুর্যের সঙ্গে এড়িয়ে গেছেন। প্রধান সেনাপতিকে খোলামেলা ও সহজ-সরল মনে হয়েছে। সব বিষয়েই তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে মত প্রকাশ করেছেন।

ভারতীয় পর্যবেক্ষকেরা যাঁর যাঁর মতো করে প্রতিবেদন তৈরি করে নিজেদের মতামত দেন।

৪ জুলাই সদস্যরা সম্মেলনে পৌঁছানোর পর নিজেরা খোলামেলা আলাপ করেছিলেন এবং ক্ষোভ-বিক্ষোভের কথা বলেছিলেন। লে. কর্নেল কে এ মজুমদার তাঁর প্রতিবেদনে সেসব লিপিবদ্ধ করেন।

ভারতীয় পর্যবেক্ষকেরা মন্তব্য করেন যে আন্দোলন এখনো পরিপক্ব হয়নি। অধিকাংশ ব্যক্তিই পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পারেননি। মাসিক ভাতা ছাড়া আর সব বিষয়েই তাঁদের নিরুদ্বিগ্ন মনে হয়েছে। পুরো আয়োজনটি ছিল যেন ‘এক চমৎকার প্রমোদভ্রমণ’।

সর্বাত্মক গোপনীয়তা রক্ষার করার চেষ্টা করা সত্ত্বেও সম্মেলনের বিভিন্ন বিষয় পশ্চিম বাংলার দৈনিক যুগান্তর–এ প্রকাশিত হয়। তাদের খবরে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের তিনশরও বেশি নির্বাচিত প্রতিনিধি মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তাঁদের অবিচল সংগ্রামের সংকল্প পুনরায় ঘোষণা করেছেন। জাতীয় পরিষদ ও রাজ্য বিধানসভার আওয়ামী লীগ সদস্যরা গত ৬ই ও ৭ই জুলাই বাংলাদেশের কোনো এক স্থানে দুদিনব্যাপী সম্মেলন হয়।’ (যুগান্তর, ১০ জুলাই ১৯৭১)

শিলিগুড়ি সম্মেলনের পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিবাদ আপাতদৃষ্টে স্তিমিত হয়ে আসে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর সরকারকে নৈতিক ভিত্তি দেয়। প্রবাসী সরকার, বিশেষ করে তাজউদ্দীনের সামনে যে প্রতিবন্ধকতা ছিল, তা দূর হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের বাকিটা সময় তাঁকে আর বড় বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়নি। সরকারও নিজেদের ত্রুটিবিচ্যুতি শুধরে নেওয়ার সুযোগ পায়। সম্মেলনের সফল পরিসমাপ্তিতে ভারত সরকারও স্বস্তিবোধ করে।

৩০ জুলাই ১৯৭১ তারিখে সাপ্তাহিক জয় বাংলা উল্লেখ করে, ‘এই বৈঠক কয়েকটি দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।...ইয়াহিয়া সরকার আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণা করে, আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী ও নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের উপর সকল রকম অত্যাচার চালিয়ে তাদেরকে সর্বস্বান্ত করেছে। আর সর্বশেষে আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণা করা হলেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্বাচন বাতিল হবে না বলে একটা মস্ত বড় প্রলোভনের টোপ ছেড়েছিল। কিন্তু এই বৈঠক প্রমাণ করে দিয়েছে যে ইয়াহিয়ার প্রলোভনের টোপ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।...

‘ভাবীকালের ঐতিহাসিকেরা যেদিন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস লিখবেন, সেদিন এই মুজিবনগর-বৈঠকের গুরুত্ব তার যথার্থ প্রেক্ষিত নিয়ে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’