এফডিসির একাল–সেকাল ১: জৌলুশ নেই, দিন চলছে ‘চেয়েচিন্তে’

মূল ফটকের সামনেরটা দেখেই বোঝা যায় এফডিসির ভেতরের কী অবস্থা
ছবি: মানসুরা হোসাইন

‘এমন সময় ছিল যখন এফডিসির পুকুরে, বাগানে, কখনো ঝরনা স্পটে বা বিভিন্ন ফ্লোরে প্রতিদিন তিন থেকে চারটি সিনেমার শুটিং করতাম’—এটুকু বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রোজিনা। বাংলা চলচ্চিত্রের একসময়ের জনপ্রিয় এই নায়িকার ‘দীর্ঘশ্বাস’ই বলে দেয় এফডিসির বর্তমান অবস্থা কেমন।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন বা বিএফডিসিতে (মুখে মুখে প্রচারিত ‘এফডিসি’) গত ২৫ ও ২৮ মে, ৬ জুলাই ও ১০ আগস্ট—এই চার দিন গিয়ে দেখা গেল, সেই ঝরনা স্পটের কৃত্রিম ঝরনা অকেজো হয়ে পড়ে আছে। ভেঙে গেছে সেতুটি। পুকুরে শেওলার রাজত্ব। আর সুইমিংপুলটি ভরাট হয়ে গেছে বহু আগেই। বাগানে ফুল নেই। তালা ঝুলছে শুটিং ফ্লোরগুলোয়। এফডিসি চত্বরে কোথাও কোলাহল নেই।

সরেজমিনের চার দিনের এক দিনও এফডিসিতে কোনো নায়ক-নায়িকা, পার্শ্বনায়িকা, খলনায়ক বা ‘এক্সট্রা’ হিসেবে পরিচিত কোনো অভিনেতা–অভিনেত্রীর দেখা পাওয়া গেল না।

এফডিসিতে কাজ করেই আমি আজকের রোজিনা হয়েছি। প্রতিষ্ঠানটির আজকের যে পরিস্থিতি হয়েছে, তা কখনো চাইনি।
রোজিনা, নায়িকা

এফডিসির বিভিন্ন দেয়ালে দুই–একটি চলচ্চিত্রের পোস্টার লাগানো; বেশির ভাগই রাজনীতিসহ অন্যান্য বিষয়ের। ‘তুমি হৃদয়ের আয়না’ চলচ্চিত্রের পোস্টারের পাশেই সাঁটা রয়েছে চিশতিয়া সাইদিয়া দরবার শরিফের বার্ষিক ইসলামি জলসার পোস্টার। ‘নয়ন সমুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই’—শিরোনামে একটি সাদা বোর্ডে চলচ্চিত্রে অবদান রাখা প্রয়াত ব্যক্তিদের নাম, জন্ম ও মৃত্যুতারিখ লেখা রয়েছে। তবে বোর্ডটিতে ১৯৭০ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত মারা যাওয়া ব্যক্তিদেরই তথ্য রয়েছে কেবল।

কর্মচাঞ্চল্য নেই, খাঁ খাঁ করছে এফডিসি চত্বর
ছবি: প্রথম আলো

এরপর আর হালনাগাদ হয়নি। চলতি বছরের মে মাসে মারা যাওয়া নায়ক ফারুকের (আকবর হোসেন পাঠান) প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো কিছু পোস্টার কয়েক জায়গায় চোখে পড়ল। ফাঁকা এফডিসি চত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছে কুকুর–বিড়াল।

ঢাকাই চলচ্চিত্রে রোজিনার আগমন ঘটে ১৯৭৭ সালে। এরপর বহু চলচ্চিত্রে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পান তিনি। পরে পরিচালনায়ও নাম লেখান। তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘ফিরে দেখা’। গত ১৬ জুন মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রের কিছু কাজ তিনি এফডিসিতে করেছেন, আর বাকি কাজ করেছেন বাইরের স্টুডিওতে। নায়িকা রোজিনা বললেন, ‘এফডিসিতে কাজ করেই আমি আজকের রোজিনা হয়েছি। প্রতিষ্ঠানটির আজকের যে পরিস্থিতি হয়েছে, তা কখনো চাইনি।’

১৯৫৭ সালে যাত্রা শুরু করা এফডিসিকে কেন্দ্র করেই ঢাকাই চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের সূচনা হয়েছিল। সেই প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরাই এখন বলছেন, এটা এখন ‘মৃতপ্রায় প্রতিষ্ঠান’।

‘এমন এফডিসি আমাদের কাঙ্ক্ষিত না’

১৯৫৭ সালে যাত্রা শুরু করা এফডিসিকে কেন্দ্র করেই ঢাকাই চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের সূচনা হয়েছিল। বাংলা চলচ্চিত্রের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত সেই প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরাই এখন বলছেন, এটা এখন ‘মৃতপ্রায় প্রতিষ্ঠান’। অতীতের গল্প বলতে গিয়ে এফডিসিতে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত ব্যক্তিদের কয়েকজন জানালেন, এফডিসিতে একটি চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের জন্য বালু এনে মরুভূমি বানানো হয়েছিল, উটও আনা হয়েছিল। কিন্তু আগের সেই জৌলুশ আর নেই।

জৌলুশ হারানো সরকারি এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মীদের অবস্থা আরও খারাপ। এফডিসির এক কর্মকর্তা তাঁর মুঠোফোন থেকে ফোন করে এ প্রতিবেদককে কিছু তথ্য দিচ্ছিলেন। প্রতিবেদক তাঁর নিজের মুঠোফোন থেকে কল করতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বললেন, ‘সমস্যা নেই।’ তবে একটু পরেই মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। প্রতিবেদক আবার ফোন দিলে ওই কর্মকর্তা বললেন, ‘এফডিসিতে আমাদের অবস্থা হলো এখন মোবাইলেও ফোন করার জন্য টাকা থাকে না! বেতন–ভাতা না পেলে যা হয় আরকি!’

বাংলা চলচ্চিত্রের একসময়ের জনপ্রিয় নায়িকা রোজিনা
ছবি: সংগৃহীত

পরিচালক ও প্রযোজক কাজী হায়াৎ বললেন, ‘আমি এফডিসির রমরমা অবস্থা দেখেছি। আমার “রাজবাড়ি” সিনেমার গানের শুটিংয়ের জন্য বড় পুকুরটিতে ভাসানো নৌকাকে ময়ূরপঙ্খির মতো করে সাজানো হয়েছিল। “আম্মাজান”, “ঘর”সহ বিভিন্ন সিনেমার গানের শুটিং হয়েছে ঝরনা স্পটে।’ তিনি আক্ষেপ নিয়ে বললেন, ‘এই জীবনেই এফডিসিতে চোখের সামনেই সব বন্ধ হতেও দেখলাম।’

১৯৭৯ সালে ‘দি ফাদার’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচালনা–জীবন শুরু করেন কাজী হায়াৎ। এ পর্যন্ত ৫২টি সিনেমা পরিচালনা করেছেন। কাজী হায়াৎ বললেন, ‘এমন এফডিসি আমাদের কাছে কাঙ্ক্ষিত না। মৃত্যুর পর লাশটা তো এই এফডিসিতেই আনা হবে।’

বন্ধ শুটিং ফ্লোরের দরজা। একসময় প্রায় ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকত
ছবি: প্রথম আলো

জৌলুশ হারানোর পেছনের গল্প

এফডিসি একসময় লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে এটিই একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেটিকে নিজের আয়ে চলতে হয়। তবে এখন প্রতিষ্ঠানটি তহবিলশূন্য। মন্ত্রণালয়ের কাছে চেয়েচিন্তে আনা টাকা দিয়ে কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হচ্ছে। বেতন-ভাতা বকেয়া থাকায় কর্মীরা প্রায়ই আন্দোলনে নামছেন। দুই–তিন মাসের বেতন–ভাতা বকেয়া থাকায় তাঁদের জীবন ধারণ কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে মো. রাজিবুল হাসানের ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প : এফডিসির ভূমিকা: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গবেষণাগ্রন্থ। এতে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০০০ সাল থেকে ঝিমিয়ে পড়তে শুরু করে।

স্যাটেলাইট প্রযুক্তি, ভিসিডি, ভিসিআরের সহজলভ্যতা, ভারতীয় সিনেমার আমদানিসহ চলচ্চিত্রশিল্প হুমকির মুখে পড়ে। এসবের পাশাপাশি এফডিসির বাজেটের ঘাটতি, অনিয়ম, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দক্ষ জনবলের অভাব, প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের সদিচ্ছার অভাব এফডিসিকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।

সরকার পরিবর্তনের প্রভাবে বিভিন্ন সময় এফডিসির বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজও থেমে গেছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকেই লোকসান গুনছে এফডিসি। শিল্পীসংকট, সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়া, ভিডিও পাইরেসির আগ্রাসন, ভালো মানের চলচ্চিত্রের অভাবসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এফডিসি কার্যকর কোনো ভূমিকা নেয়নি।উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে থাকে প্রতিষ্ঠানটির আয়।

শুটিং নেই। তাই আলো জ্বলে না ‘জমিদার বাড়ি’তে
ছবি: খালেদ সরকার

বিএফডিসির ২০২১-২২ সালের নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, (২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত) প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের পরিমাণ ১৪২ কোটি ৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৪৮৭ টাকা। আর প্রতিষ্ঠানটির দায়ের পরিমাণ ১৩ কোটি ২ লাখ ৪৮ হাজার টাকার বেশি। বর্তমান যে অবস্থা তাতে করে সরকারের সহায়তা ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে চলা আর সম্ভব নয়।

ভাড়া বেশি, কাজের সুযোগ-সুবিধা কম

১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে তখনকার শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রমমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘দ্য ইস্ট পাকিস্তান ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন’ বিলটি উত্থাপন করেন। ওই বছরের ১৯ জুন থেকে আইনটি কার্যকর হয়। স্বাধীনতার পর সংস্থাটির নামের সঙ্গে ‘বাংলাদেশ’ যুক্ত হয়। তবে ১৯৫৭ সালের আইনের অধীনেই এখনো চলছে বিএফডিসি।

চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে গত ৬ জুলাই পর্যন্ত এক হিসাব বলছে, এফডিসিতে ১১টি চলচ্চিত্রের কিছু শুটিং হয়েছে বা চলচ্চিত্রের জন্য কিছু কারিগরি সুবিধা নেওয়া হয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এফডিসির চলচ্চিত্র নির্মাণের তালিকায় ১২৯টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও তিনটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম পাওয়া গেছে।

অথচ ১৯৮৭ সালে এফডিসি থেকে প্রকাশিত অনুপম হায়াৎ-এর ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস’ শিরোনামের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, দেশের ৫ শতাধিক (১৯৮৭ সাল পর্যন্ত) প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত সিনেমার মধ্যে শতকরা ৯৮টি সিনেমাই বিএফডিসিতে তৈরি। এতে করে প্রযোজনা, পরিবেশনা, প্রদর্শনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আড়াই লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ গবেষণাতেই উল্লেখ করা হয়েছে, সরকার বিএফডিসি থেকে নির্মিত সিনেমা থেকে বছরে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা বিনোদন কর পেত।

২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকেই লোকসান গুনছে বিএফডিসি। শিল্পীসংকট, সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়া, ভিডিও পাইরেসির আগ্রাসন, ভালো মানের চলচ্চিত্রের অভাবসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এফডিসি কার্যকর কোনো ভূমিকা নেয়নি। উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে থাকে প্রতিষ্ঠানটির আয়।

মূল দায়িত্ব থেকে সরে আসা

১৯৫৯ সাল থেকে এফডিসিতে চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে। চলচ্চিত্র নির্মাণসহ স্টুডিও প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানিকে ঋণ দেওয়া, চিত্রনির্মাতাদের ভাড়ার বিনিময়ে স্টুডিও ব্যবহার করতে দেওয়া, চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিবেশনা, চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা, সেমিনারের আয়োজন করা, নতুন শিল্পীর সন্ধান, চলচ্চিত্র নিয়ে উৎসব, বিদেশি চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য চলচ্চিত্র বাছাই, বিদেশি চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করা—কাগজে-কলমে এফডিসির এমন অনেক কাজ রয়েছে।

তবে বর্তমানে শুটিং ফ্লোরভাড়া বা কিছু কারিগরি সুবিধা দেওয়া ছাড়া দৃশ্যমান তেমন কোনো কাজ নেই। এফডিসিতে চলচ্চিত্রের চেয়ে বিজ্ঞাপনের শুটিং বেশি হচ্ছে। বিভিন্ন শুটিং ফ্লোর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ভাড়া নিয়ে বছরব্যাপী রিয়েলিটি শোসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান করছে।

বিএফডিসি বারবার লক্ষ্যমাত্রা পরিবর্তন করতেও বাধ্য হচ্ছে। কখনো ২০২১, কখনো ২০২৫, সর্বশেষ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম চলচ্চিত্র নির্মাণের সেবাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চেয়েচিন্তে কত দিন প্রতিষ্ঠানটি চলতে পারবে, এটাই এখন দেখার বিষয়।

‘নিজস্ব আয়ে চলা আর সম্ভব নয়’

১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত মির্জা তারেকুল কাদেরের ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প’ শিরোনামের গবেষণাগ্রন্থ বলছে, তখনো এফডিসিতে নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ছিল বছরে ৮০ থেকে ৯০টি। তবে চরম অব্যবস্থাপনা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা, একশ্রেণির চিত্রনির্মাতার প্রভাব, অসহযোগিতামূলক মনোভাব প্রতিষ্ঠানটিকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে।

১৯৭৬ সালে তৎকালীন সামরিক সরকার অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত কমিটিও গঠন করেছিল। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি যে জৌলুশ হারাচ্ছে, তার ইঙ্গিত অনেক আগে থেকেই দিচ্ছিলেন গবেষকেরা। তবে তা আমলে নেয়নি এফডিসি।
অ্যানালগ যুগের ৩৫ মিলিমিটার ফরম্যাটের বিভিন্ন ধরনের কাঁচা ফিল্ম যেমন সাউন্ড নেগেটিভ, পিকচার নেগেটিভ ও পজিটিভ আমদানি করে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে বিক্রি করার একচেটিয়া প্রতিষ্ঠান ছিল বিএফডিসি।

এফডিসিতে বীর চলচ্চিত্রের শুটিংয়ে শাকিব খান
প্রথম আলো ফাইল ছবি

বিএফডিসির কারিগরি সহায়তা ছাড়া বাইরের স্টুডিওতে শুটিং হলেও সেন্সর বোর্ডে যাওয়ার আগে চলচ্চিত্রটির জন্য প্রতিষ্ঠানটির অনাপত্তিপত্র লাগে। তবে বর্তমানে বিএফডিসির বেশির ভাগ অনাপত্তিপত্রে চলচ্চিত্রের নাম উল্লেখ করে লেখা থাকছে—চলচ্চিত্রটি বিএফডিসির কারিগরি সহায়তায় নির্মিত হয়নি। এটি বাইরে নির্মিত হতে পারে মর্মে প্রতীয়মান হয়। চলচ্চিত্রটির খাতে বিএফডিসির কোনো পাওনা না থাকায় অনাপত্তি প্রদান করা হলো।

বিএফডিসিতে গবেষণা বিভাগ, লাইব্রেরি, চলচ্চিত্র সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা, জাদুঘর কিছুই নেই। বিএফডিসিতে ঝরনা স্পটসহ শুটিং স্পটগুলো যেমন জমিদার বা ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত ভবনটিরও জৌলুশ নেই। ৬ নম্বর শুটিং ফ্লোরটি কাগজে-কলমে থাকলেও এটি বছরের পর বছর গুদামঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য সিনেমা হল, প্রজেকশন হলগুলোতে এখন এফডিসির সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

সংস্থাটির সর্বশেষ প্রকাশিত ২০১৭-২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে চলমান উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে নতুন চলচ্চিত্র অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলী খুঁজে পেতে ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ শীর্ষক কর্মসূচির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এফডিসিতে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত ব্যক্তিরা বলছেন, ১৯৯০ সালের পর এ কর্মসূচি আর অনুষ্ঠিত হয়নি। চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজনসহ অন্যান্য কার্যক্রম প্রসঙ্গে এফডিসির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বললেন, প্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরই বেতন-ভাতা বকেয়া থাকছে, সেখানে অন্যান্য আয়োজন করবে কীভাবে?

২০০২ সালের পর আর হালনাগাদ হয়নি
ছবি: প্রথম আলো

৬ জুলাই বিএফডিসিতে সরেজমিনে দেখা যায়, সেখানে ‘যাপিত জীবন’ নামের একটি চলচ্চিত্রের ডাবিংয়ের কাজ চলছে। এ চলচ্চিত্রের প্রযোজক ও পরিচালক হাবিবুল ইসলাম বললেন, এফডিসিতে একটি উন্নত মানের ক্যানটিন পর্যন্ত নেই, কাজ করতে আসা মানুষগুলো খাবেন কোথায়, সে চিন্তাও নেই কর্তৃপক্ষের।

পরিচালক কাজী হায়াৎ ও নায়িকা রোজিনা দুজনই বললেন, তাঁরা এফডিসিতে কাজ না করে বাইরে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এফডিসির ক্যামেরাসহ সবকিছুর ভাড়া বেশি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও বেড়েছে। বাইরের স্টুডিও থেকে এখানে কাজের সুযোগ-সুবিধাও কম। বাইরে রাত-দিন প্যাকেজে কাজ করার সুবিধা থাকলেও এখানে শিফট মেনে কাজ করতে হয়। এতে খরচটাও বাড়ে।

২৫ মে সরেজমিনে এফডিসিতে গিয়ে শুধু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক গাজী রাকায়েতকে একটি সিনেমার ডাবিংয়ের কাজ করতে দেখা গেল। তিনিও বললেন, সরকারের এ প্রতিষ্ঠানটি চাইলেই ভাড়া কম নেওয়াসহ বিভিন্ন ছাড় দিতে পারে। একসময় এফডিসির নির্মাতারা চিত্রনাট্য নিয়ে এফডিসিতে ঢুকে সম্পূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে এফডিসি থেকে বের হতেন। এখন আর তা হচ্ছে না।

যন্ত্রপাতি রাখা হয়েছে স্তূপ করে
ছবি: প্রথম আলো

চলচ্চিত্রশিল্প অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করলেও বাইরের স্টুডিওর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে বিএফডিসি। সংস্থার কর্মীরা ডিজিটাল যুগের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য প্রশিক্ষণের কোনো সুযোগ পাননি। তাঁরা মেশিন নাড়াচাড়া করে বা দেখতে দেখতে কাজ শিখেছেন বা শিখছেন।

কর্মীরা জানালেন, বিদেশে ক্যামেরাসংক্রান্ত বা অন্য কোনো প্রশিক্ষণে বিভিন্ন সময় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে অন্য কর্মকর্তারা গেছেন। অনেকেরই কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলেও বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্ব দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে।

নিজস্ব আয়ে চলা এফডিসিকে ২০১৪ সাল থেকেই সরকারের অনুদানের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদিত জনবল ৫৯১ থেকে কমতে কমতে ২১৮ জনে দাঁড়িয়েছে। মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কর্মীদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হচ্ছে।

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের আট সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে বিএফডিসির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব পদাধিকারবলে এর চেয়ারম্যান। এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পর্ষদে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বরের পরিচালনা পর্ষদের সভার কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, বিএফডিসির কর্মীদের বেতন-ভাতা, অবসরকালীন পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।

বর্তমানে শুটিং ফ্লোর ভাড়া বা কিছু কারিগরি সুবিধা দেওয়া ছাড়া দৃশ্যমান তেমন কোনো কাজ নেই। এফডিসিতে চলচ্চিত্রের চেয়ে বিজ্ঞাপনের শুটিং বেশি হচ্ছে। বিভিন্ন শুটিং ফ্লোর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ভাড়া নিয়ে বছরব্যাপী রিয়েলিটি শোসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান করছে।

তাই বিকল্প আয়ের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সভায় বলা হয়, বিএফডিসি কমপ্লেক্স বাস্তবায়িত হলে আর্থিক সংকট অনেকাংশে কমে যাবে, তবে তার জন্য আরও দুই থেকে তিন বছর সময় লাগবে এবং বর্তমানে বিএফডিসির আয় দিয়ে কর্মীদের বেতন দেওয়া সম্ভব নয়।

জানতে চাইলে বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুজহাত ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিষ্ঠানের বর্তমান মাসিক আয় ৫০ লাখ টাকা। কর্মীর সংখ্যা কমলেও বেতন–ভাতা বাড়ায় এখন বেতন-ভাতাতেই লাগছে প্রায় এক কোটি টাকা। অন্যান্য পরিচালন ব্যয় তো আছেই। তিনি বলেন, ‘অ্যানালগ আমলে ৮০ শতাংশ আয়ই হতো কাঁচা ফিল্মসহ এ খাত থেকে। ডিজিটাল যুগে নেগেটিভ বন্ধ হয়ে যায়, আয় কমে গেল। এখন আমরা নিজেদের আয়ে চলতে পারছি না।’

এমন এফডিসি আমাদের কাছে কাঙ্ক্ষিত না। মৃত্যুর পর লাশটা তো এই এফডিসিতেই আনা হবে।
কাজী হায়াৎ, পরিচালক ও প্রযোজক

এফডিসির পরিচালনা পর্ষদে এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ তথ্য, বাণিজ্য, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির প্রতিনিধি থাকেন।

গত ২ জানুয়ারি পরিচালনা পর্ষদের ৩০৭তম সভায় চেয়ারম্যান ও তথ্যসচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার চলচ্চিত্র মাধ্যমকে বলিষ্ঠ অবস্থানে আনার জন্য সবাইকে নতুন উদ্যমে কাজ করার পরামর্শ দেন। এ সভাতেই জানানো হয়েছে, বিএফডিসির কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য বকেয়া বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। তবে অর্থ বিভাগ থেকে ‘না’ জবাব এসেছে।