শিক্ষাসনদ নিয়ে ৪৮ বছরের আইনি লড়াই: ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের রায় বাস্তবায়নে বাধা নেই

সুপ্রিম কোর্ট
প্রথম আলো ফাইল ছবি

নির্ধারিত সময়ের ১৪ বছর পর নম্বরপত্রের সনদ দেওয়াকে কেন্দ্র করে মামলায় প্রয়াত জিল হোসেন খন্দকারের উত্তরাধিকারীদের দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণসহ এই অর্থের বিপরীতে ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দিতে হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দেননি আপিল বিভাগ।

হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা আবেদনটি আজ রোববার খারিজ করে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ।

একই সঙ্গে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) শুনানির জন্য রাখা হয়েছে।

প্রয়াত জিল হোসেনের করা ক্ষতিপূরণ মামলায় ২০০৮ সালের ২৬ আগস্ট রায় দিয়েছিলেন ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত। রায়ে ৩০ দিনের মধ্যে ২ কোটি টাকা জিল হোসেনকে দিতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ আপিল খারিজ করে গত ৭ মার্চ রায় দেন হাইকোর্ট। দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় বহাল রাখেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া রায়ের দিন থেকে উল্লিখিত অর্থের বিপরীতে ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দিতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

জিল হোসেন ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মারা গেলে মামলায় তাঁর উত্তরাধিকারীরা পক্ষভুক্ত হন।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিলের পাশাপাশি রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

আজ লিভ টু আপিল ও স্থগিতাদেশ চেয়ে করা আবেদন একসঙ্গে শুনানির জন্য ওঠে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তানিয়া আমীর। জিল হোসেনের উত্তরাধিকারীদের আইনগত সহায়তা দিচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি। লিগ্যাল এইডের আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস জিল হোসেনের উত্তরাধিকারীদের পক্ষে শুনানি করেন।

পরে আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিল হোসেনের উত্তরাধিকারীদের ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণসহ এই অর্থের বিপরীতে ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দিতে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন। এই রায় স্থগিত চেয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এর ফলে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নে আইনগত কোনো বাধা নেই।’

আইনি লড়াইয়ের শুরু

১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে জিল হোসেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি (অ্যাগ্রি) স্নাতক দ্বিতীয় পর্বের চতুর্থ বর্ষের পুরোনো পাঠ্যক্রমের চূড়ান্ত পরীক্ষার্থী ছিলেন।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার ফলাফলে জিল হোসেনকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। এই ফলাফল পুনর্বিবেচনা চেয়ে একাডেমিক কাউন্সিলে আবেদন করে বিফল হন জিল হোসেন। পরে ১৯৭৫ সালে তিনি আবার পরীক্ষায় অংশ নেন। কিন্তু তাঁকে বহিষ্কার করা হয়।

এসবের প্রতিকার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে জিল হোসেন মামলা করেন। মামলায় তিনি দাবি করেন, তাঁর প্রাপ্ত নম্বরের (১৯৭৩ সালে দেওয়া পরীক্ষায়) সঙ্গে ভগ্নাংশ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নম্বরের সঙ্গে ভগ্নাংশ যোগ না করে তাঁকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে।

জিল হোসেনের করা এই মামলায় বিচারিক আদালত ১৯৭৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে ভগ্নাংশ নম্বর যোগ না করে তাঁকে অকৃতকার্য করাকেও বেআইনি ঘোষণা করা হয়।

এই রায়ের বিরুদ্ধে জজ আদালতে আপিল করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের ৩১ জানুয়ারি জজ আদালতের দেওয়া রায়ে জিল হোসেনকে বহিষ্কার আদেশ বেআইনি ঘোষণা করা হয়।

একই বছর হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য প্রথম মুনসেফ আদালতে পাঠান।

১৯৭৮ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম মুনসেফ আদালত ভগ্নাংশ নম্বর যোগ করে ৩০ দিনের মধ্যে জিল হোসেনের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করার নির্দেশ দেন। এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবার জেলা জজ আদালতে আপিল করে, যা নামঞ্জুর হয়।

পরে হাইকোর্টে আপিল করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর ওপর ১৯৮৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় দেওয়া হয়। এই রায়ে বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল থাকে।

অতঃপর সনদ, ক্ষতিপূরণ মামলা

পরিবার ও মামলাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্য অনুযায়ী, হাইকোর্টের রায়ের পর ১৯৮৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর জিল হোসেনের একটি আবেদন গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে তাঁকে পাস নম্বর দিয়ে ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর নম্বরপত্রের সনদ দেয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

তখন জিল হোসেনের বয়স ৪৭ বছর। অর্থাৎ তাঁর সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা আর নেই। এরপর ২০০০ সালের ১৮ অক্টোবর ক্ষতিপূরণ দাবি করে অধস্তন আদালতে মামলা করেন জিল হোসেন।

ক্ষতিপূরণ মামলায় দাবি করা হয়, হাইকোর্টের রায় ১৪ বছর ৯ মাস পরে কার্যকর করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কাজে জিল হোসেনের জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ক্ষতিপূরণ মামলায় ২০০৮ সালের ২৬ আগস্ট রায় দেন ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত। রায়ে ৩০ দিনের মধ্যে ২ কোটি টাকা জিল হোসেনকে দিতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, যা গত ৭ মার্চ খারিজ করে হাইকোর্ট রায় দেন।

১৪ বছর পর আপিল নিষ্পত্তি

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের করা দেওয়ানি আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ৪ জুন হাইকোর্ট শর্ত সাপেক্ষে ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতের ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানসংক্রান্ত আদেশ স্থগিত করেন।

শর্তে ২ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ২৫ লাখ টাকা ৩ মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে বলা হয়। এতে ব্যর্থ হলে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়ে যাবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়।

সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর তথ্যমতে, জিল হোসেন মারা যাওয়ার পর আপিল শুনানির জন্য উঠলে ১৩ বছর আগে হাইকোর্ট ২ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা সামনে আসে। এ অবস্থায় হাইকোর্ট গত ডিসেম্বরে আপিলকারী পক্ষকে ২৫ লাখ টাকা জমা দিয়ে আসতে বলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গত ৪ নভেম্বর ওই অর্থ জমা দেয়।