‘আমি চিৎকার করে দৌড়াচ্ছি, স্যার আমাকে বলছেন, দোয়া করেন, আল্লাহকে ডাকেন’

সন্তান মাসনুন রহমান সিনানের সঙ্গে তাসলিমা আকতারছবি: তাসলিমার ফেসবুক থেকে নেওয়া

রাজধানীর উত্তরায় গতকাল সোমবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক‍্যাম্পাসে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনার একটি বিবরণ দিয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির একজন শিক্ষক।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক তাসলিমা আকতারের নিজের সন্তানও আটকা পড়েছিল দুর্ঘটনাস্থলে। তখন তিনিও ক্যাম্পাসে ছিলেন।

বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমানটি স্কুল চত্বরের একটি দোতলা ভবনে বিধ্বস্ত হয়। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই আগুন ধরে যায় স্কুল ভবনে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৭ জনের নিহত হওয়ার তথ্য জানা গেছে। আহত দেড় শতাধিক। হতাহতের ঘটনায় আজ রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হচ্ছে।

‘ভয়াবহ একুশে জুলাই ২০২৫’ শিরোনামে সেই ঘটনার বিবরণ গতকাল সোমবার দিবাগত রাতে তাসলিমা আকতার তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন। তাঁর অনুমতি নিয়ে সেই বিবরণ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

আরও পড়ুন
যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে পুড়ে যাওয়া ভবন। আজ মঙ্গলবার
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

আমার ছেলে মাসনুন রহমান সিনান।

উত্তরা মাইলস্টোন কলেজের দিয়াবাড়ি শাখার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র।

প্রতিদিনের নিয়ম অনুযায়ী ছুটি হয় দুপুর ১টায়।

আজকে আমার পরীক্ষার ডিউটি ছিল চার নং ভবনের ৮০৪ নম্বর রুমে। বেলা একটায় পরীক্ষা ডিউটি শেষ করে ছেলের ভবনের সামনে যাব, হঠাৎ মনে হলো রেস্ট নিই। ও নিজেই চলে আসবে আমার টিচার্স রুমে প্রতিদিনের মতো।

আমি টিচার্স রুমে রেস্ট নিচ্ছি। তখন দুপুর ১টা ১১ মিনিটে, আমার ছেলের ফরম মাস্টার বাবুল স্যার আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, ম্যাডাম আজকের সিনানের ছুটি হবে ১টা ৪০ মিনিটে। আমি বললাম, ক্লাস শেষ হলে ৭ নং ভবনের দোতলায় পাঠিয়ে দেবেন টিচার্স রুমে। আমি ওকে স্যার বলেই ফোনটা কেটে দিলাম। সাথে সাথে বোম ব্রাস্ট হওয়ার মত একটা সাউন্ড হইল—আমি মাঠের পাশে টিচার্স রুম থেকে দেখতে পেলাম, আমার ছেলের ভবনের সামনে আগুন।

আমার টিচার্স রুমে আমার সামনে আমার একজন সিনিয়র সহকর্মী জনাব এজাজ মাসুদ স্যার বসা ছিলেন। আমি এক চিৎকারে বললাম, স্যার আমার ছেলের ভবনে তো আগুন লাগছে।

উনার ছেলে ওই ভবনেই পড়ে, কোনো কারণে সে আজকে আসে নাই।

আমি চিৎকার করে দৌড়াচ্ছি, স্যার আমাকে বলছেন, দোয়া করেন আল্লাহকে ডাকেন। ৪০ সেকেন্ডের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাই।

আরও পড়ুন
যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের স্থান ঘিরে রাখা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

দৌড়াতে দৌড়াতে আমার হাজব্যান্ডকে ফোন দিয়ে বলেছি, আমার ছেলের ভবনে আগুন লাগছে।

যেখানে আগুন লাগছে, সেখানে গিয়ে দেখি, তিনটা গলিত লাশ। শুধু আইডি কার্ডটা পড়ে আছে।

একটা বাচ্চার গায়ে কাপড় নাই, পুরো শরীর ঝলসে গেছে।

সামনে গিয়ে দেখি, যে ভবনে আমার ছেলে ক্লাস করে, যেই রুমে আমার ছেলে ক্লাস করে, সেই রুমের চারদিকে ধোঁয়া।

ছেলের ক্লাসরুমে আগুন, আমি বাইরে থেকে কী বুঝব, তাই ক্লাসে ঢুকতে চাইলাম। সেনাবাহিনীর দুইজন আর আমার কলেজের বিএনসিসি ছাত্ররা আমাকে ঢুকতে দিলো না...।

আমি বারবার ঢুকতে চাইলাম, জোর করে ঢুকতে চাইলাম, আমাকে বাধা দিল দুজন, আমাকে জোর করে একপাশে নিয়ে গেল। আমি ডান পাশে ঘুরেই দেখি, আমার ছেলের ফরম মাস্টার বাবুল স্যার।

জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আপনি এখানে, আমার ছেলে কই???

শুধু হাতটা ধরে বলল, ওরা ওপরে দুই তালায়।

বিশ্বাস করলাম না। তারপর আমার একজন ছাত্র এসে বলল, ম্যাডাম কিছু হয় নাই, এই পাশে আসেন। ক্যানটিনের পাশে ওপরে ৭ থেকে আটজন মেয়ে বাচ্চাকে দেখা যাচ্ছিল। আমি আল্লাহর কাছে কী দোয়া পড়ছিলাম, আমার কিছুই মনে নাই।

আমার বিভাগের আমার একজন সহকর্মী মুকুল স্যারের ভাগ্নিও ওই ভবনে আটকা পড়ছেন। সে পাশ থেকে ওপারে দৌড়াচ্ছেন আর চিৎকার করতেছেন।

আমাকে দুইজন সেনাবাহিনী বসায় দিয়ে ধরে রাখলেন একপাশ থেকে। যেন আমি সামনে না যাই।

আরও পড়ুন
ফুটবলের একটি অংশ পুড়ে গেছে। আজ মঙ্গলবার
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

তারপর দোতলার সামনে গাছ ছিল, আম গাছ কেটে ফেলা হলো।

গ্রিলের তালা ভাঙ্গা হলো, একপাশ ভেঙে ফেলা হলো।

আমি শুধু দেখতে পাচ্ছি, কিছু ছাত্রী গ্রিলের নিচ দিয়ে দিয়ে বের হয়ে আসছে।

৮ থেকে ১০ জন ছাত্রী এবং একজন ম্যাডাম বের হওয়ার পর হঠাৎ আমার ছেলের চেহারা ভেসে উঠলো।

ওই মুহূর্তটা একজন মায়ের জন্য কী মুহূর্ত, সেটা বলে বোঝানো যাবে না, লিখেও শেষ করা যাবে না।

মুকুল স্যার যদি পারতো, তাকে দোতলা থেকেই টেনে বের করত। আমার ছেলেকে দেখার সাথে সাথে সে দৌড়ে গিয়ে জড়ায় ধরছে, বাবারে তুই তাড়াতাড়ি আয়।

আমার মানিককে, আমার সন্তানকে আমি জড়াইয়া ধরলাম।

যারা আমার ছেলের ক্লাসে আটকে ছিল, তারা কেউ বেঁচে ফিরে নাই। সবাই পুরে কয়লা হয়ে গেছে।

একজন মা বলতেছিল, বাবারে তুই আজকে আমার হাতের শেষ খাওয়াটা খাইয়া গেলি বাবা—আমি তো তোরে শেষ দেখা দেখতে পারলাম না।

মূলত বিমান ক্রাশ হয়ে ক্লাসরুমের ভিতরে ঢুকে গেছে।

বিমান ক্রাশ হওয়ার সাথে সাথেই ১৫ মিনিটের মধ্যেই যা ধ্বংস হওয়ার, যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে।

যাতে শরীর পুড়ে গেছে, তাদের বাঁচানো খুবই অসম্ভব, খুব খারাপভাবে শরীর পুড়ে গেছে।

আরও পড়ুন

এত কাছ থেকে কখনো দেখিনি। এত ভয়ঙ্কর!!

আমি রাত আটটা দশ মিনিটে সেই দুর্ঘটনাস্থলে আবার যাই। আমার ফরমের দুইটা মেয়ে অসুস্থ, তাদেরকে দেখার জন্য।

সেই ভবনের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম।

রাত ৮টা ১৫ মিনিটের সময় বিজিবির একজন সদস্য নাম মাসুদ, তিনি ফোনে কাউকে বলছিলেন, আরও একটি লাশ পাওয়া গেছে, কিন্তু কয়েকটি পুড়ে যাওয়া খন্ড বিখন্ড অংশ।

হে রাব্বুল আলামিন, রাহমানুর রাহিম, তুমি উত্তম পরিকল্পনাকারী—শিশুদের এমন মৃত্যু তুমি দিয়েছো, বাবা-মা তাঁদের গলে যাওয়া লাশের শেষ চিহ্নটুকু দেখতে পাবে না।

তাসলিমা আকতার

প্রভাষক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ

মাইলস্টোন কলেজ

২১/০৭/২০২৫, সোমবার

আরও পড়ুন