স্থাপত্য কোনো ব্যক্তিগত বা পরিবারিক বিষয় নয়, স্থাপত্য একটা সম্প্রদায় বা সমগ্র দেশের অগ্রগতির প্রতীক। বাংলাদেশকে সাজাতে হলে প্রচুর পেশাজীবী দরকার, যাঁরা দেশজুড়ে অবদান রাখবেন। এই পেশাজীবীদের লাইসেন্স থাকতে হবে। নগরায়ণের চাপ সামলে ওঠার জন্য রাজধানীকে নিয়ে বাংলাদেশের স্থপতিদের নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ আর্ক সামিট ২০২৫–এ কথাগুলো বলেন দেশি–বিদেশি স্থপতিরা। বাংলাদেশ–চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (আইএবি)।
বাংলাদেশেকে সাজাতে প্রচুর পেশাজীবী দরকার বলে মনে করেন আইএবির সভাপতি আবু সাইদ এম আহমেদ। তিনি বলেন, যেসব প্রকৌশলী ও স্থপতি নির্মাণকাজের নেতৃত্ব দেবেন, তাঁদের লাইসেন্স থাকতে হবে। বাংলাদেশে কোনো প্রকৌশলী ও স্থপতিকে লাইসেন্স ছাড়া কাজ করতে দেওয়া যাবে না। যদি দেওয়া হয় তাহলে ভূমিকম্প–পরবর্তী দেশের যে ক্ষতিটা হচ্ছে, বায়ুদূষণ হচ্ছে, অবাসযোগ্য শহর হচ্ছে—এগুলো বন্ধ হবে না।
আবু সাইদ এম আহমদ মনে করেন, স্থাপত্য কোনো ব্যক্তিগত বা পরিবারের বিষয় নয়, বরং স্থাপত্য একটা সম্প্রদায় ও দেশের অগ্রগতির বিষয়। তিনি বলেন, দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য শুধু রাজধানীকে গোছালে হবে না, পুরো দেশকে গোছাতে হবে। এই কাজের জন্য তাই দেশজুড়ে পেশাজীবীদের ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই এই দেশ এখনকার সময়ের জন্য বাসযোগ্য হয়ে গড়ে উঠবে।
আবু সাইদ এম আহমেদ বলেন, এবারের আর্ক সামিটের প্রধান আকর্ষণগুলোর একটি হলো—অ্যাসোসিয়েশন অব আর্কিটেক্টস সাউথ এশিয়ার (এএএসএ) প্রথম কাউন্সিল মিটিং। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, কোরিয়া, থাইল্যান্ডসহ সাতটি দেশের প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে অংশ নেবেন। বৃহস্পতিবার রাতেই সদস্যদেশগুলোর প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে আসবেন এবং এএএসএর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হবে। এবারের আর্ক সামিট চলবে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য দেন আর্ক সামিট ২০২৫–এর আহ্বায়ক কাজী এম আরিফ। তিনি বলেন, ‘বর্তমান বিশ্ব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। অর্থনীতি, প্রযুক্তি, জলবায়ু, সংস্কৃতি—সবকিছুর দ্রুত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে মানুষের বাসস্থান, কর্মস্থান এবং সামগ্রিক পরিবেশ কীভাবে সুসংহত হবে, সেটি নির্ধারণে স্থাপত্য বিশেষ ভূমিকা রাখছে।’
স্থাপত্য মানে শুধু একটি ভবন নয় উল্লেখ করে এম আরিফ বলেন, স্থাপত্য মানুষের জীবন এবং প্রতিটি স্থানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এবারের আর্ক সামিট দেশের স্থপতিদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কোরিয়ার খ্যাতিমান স্থপতি মিনসুক চো। তিনি বলেন, নগরায়ণের চাপ সামলে ওঠার জন্য ঢাকাকে নিয়ে এ দেশের স্থপতিদের নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে। অতীতের নানা ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার প্রভাব অক্ষুণ্ণ রেখে নগরকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়াও নগরায়ণের ধকলে অনেক ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলেছিল। তাঁরা এর মূল্য অনুধাবন করেছেন।
সম্মেলনে একটি ভিডিও বার্তায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘সাম্প্রতিক ভূমিকম্প দেশের মানুষকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। এটি আমাদের বার্তা দিয়েছে যে নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের সবচেয়ে জরুরি দাবি। এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেশাদার স্থপতি, প্রকৌশলী এবং বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে বিজ্ঞানসম্মত নকশা, নির্মাণকালে কঠোর তদারকি ও মানসম্মত নির্মাণকাজে পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করা অপরিহার্য।’
ভিডিও বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা স্থপতিদের নতুন সংগঠন সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জন্য শুভকামনা জানান। প্রধান উপদেষ্টা মনে করেন, স্থপতিদের নতুন এই সংগঠনের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার স্থপতিদের মধ্যে জ্ঞান বিনিময়, পেশাগত সহযোগিতা এবং একটি শক্তিশালী ভ্রাতৃত্ব তৈরি করবে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে প্রধান উপদেষ্টা দেশের সব স্তরের শিক্ষাবিদ ও নির্মাতাদের প্রতি আহ্বান জানান। ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, সরকার সারা দেশের জন্য একটি ‘বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি’ গঠনের পাশাপাশি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাঠামোগত পরিবর্তনে কাজ করছে।
সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার (সি আর আবরার)। তিনি অ্যাসোসিয়েশন অব আর্কিটেক্টস সাউথ এশিয়ার নতুন কার্যক্রমের জন্য শুভেচ্ছা জানান। শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘এই অ্যাসোসিয়েশনটি হতে পারে পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন আঞ্চলিক অংশীদারত্বের প্রতীক।’
এ বছর নতুন প্রায় ৮০০ স্থপতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে আইএবি। শিক্ষা উপদেষ্টা নতুন স্থপতিদের শুভেচ্ছা জানান। তাঁদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের কর্মজীবনে নিষ্ঠা, উদ্ভাবন, সহানুভূতি এবং সাধারণ মানুষের জন্য দায়িত্ববোধকে পথপ্রদর্শক নীতি হিসেবে গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করছি।’
সম্মেলনে আন্তর্জাতিক পদক পাওয়ার জন্য দেশের মোট ১১ জন স্থপতিকে সম্মাননা স্মারক দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন জিসান ফুয়াদ চৌধুরী, শরীফ উদ্দিন আহামেদ, শামস সানজিদা, মো. ইশতিয়াক জহির, মো. ইকবাল হাবিব, মেরিনা তাবাশ্যুম, সারাওয়াত ইকবাল, এনামুল করিম, সাইকা ইকবাল, মো. দিদারুল ইসলাম ভুঁইয়া ও খন্দকার আরিফুজ্জামান।
সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন স্থপতি ইনস্টিটিউটের সহসভাপতি (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স) খান মোহাম্মদ মাহফুজুল হক জগলুল, সহসভাপতি (ন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স) নওয়াজিস মাহবুব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব আসাদ আলম সিয়াম। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন আইএবির এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি মাসুদুর রশিদ।