তাঁকে ভুলতে পারি না 

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে পাঠকের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

সময়টা ১৯৭৮ সাল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেছি। সে সময় প্রতিদিনের নিয়মিত কাজ ছিল ইত্তেফাক পত্রিকার সব পাতা পড়ে শেষ করে চাকরির বিজ্ঞাপন খোঁজা। এরই মধ্যে মোহাম্মদপুর থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক পত্রিকা তিলোত্তমায় সম্পাদনার কাজ পেলাম। কিন্তু পত্রিকা তেমন চলে না। সুতরাং বেশি দিন থাকা হলো না। পেয়ে গেলাম বাড়ির কাছে নতুন পল্টন লাইন হাইস্কুলে চাকরি। কিন্তু মনে উচ্চাশা, বড় কোনো স্কুলে চাকরি করতে হবে।

সেদিনও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চাকরির বিজ্ঞাপন খুঁজছি। হঠাৎ ছোট্ট একটা বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ল। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে একটি শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগ করা হবে। মনে পড়ল, মাস চারেক আগে এই স্কুলের আরও একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল এবং আমি সেখানে ইন্টারভিউও দিয়েছিলাম। বেশ অনেক দিন পার হয়ে গেছে। ধরেই নিয়েছি যে ওখানে শিক্ষক নিয়োগ হয়ে গেছে।

তবে আবেদন করতে তো মানা নেই। সুতরাং আবার একটি আবেদনপত্র লিখে যথাযথ কাগজপত্রসহ পরদিন স্কুলে গেলাম।

প্রধান অফিস কর্মকর্তা কবির সাহেবের হাতে খামটা জমা দিলাম। উনি খামটা খুলে ভালো করে দেখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি সুরাইয়া চৌধুরী?’ আমি বললাম, জি। উনি খামটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘আপনি দু–এক দিনের মধ্যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে যাবেন।’

আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে তিনি খোলাসা করে বললেন, ‘এখানে আগেও আপনি শিক্ষক পদের জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। সেই পদে আপনি নির্বাচিত হয়েছেন।’

আমি নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

এত বড় একটা স্কুলে আমার মতো নিতান্ত সাধারণ, মুখচোরা স্বভাবের একটা মেয়ের চাকরি কীভাবে হলো! তবে দুদিন পরই নিয়োগপত্রটি হাতে পেয়ে নিজের ভেতর সত্যি একটা আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত তৈরি হলো।

কর্মজীবনের শুরুতে আমার বোধের ঘরে বিশ্বাসের এই শিকড় যাঁর মাধ্যমে গ্রথিত হলো, তিনি হলেন ওই স্কুলের অধ্যক্ষ রাজিয়া মতিন চৌধুরী।

স্কুলে যোগ দেওয়ার দু–এক দিন পর টিফিনের অবসরে শিক্ষকদের সঙ্গে বসে ছিলাম। একে তো আমি লাজুক স্বভাবের, তারপর এত বড় স্কুলে আমার চেয়ে বয়সে বড় সিনিয়র সব শিক্ষক। খুব কাঁচুমাচু হয়ে বসে ছিলাম।

হঠাৎ এক নারী শিক্ষক আমার দিকে তাকিয়ে অন্যদের উদ্দেশে বললেন, ‘প্রিন্সিপাল আপা ওকে কীভাবে নিল, বুঝলাম না। আপা তো সব সময় সুন্দর দেখে শিক্ষক নেন।’

আমি যেন লজ্জায় মরে গেলাম। একে তো শুকনা, রোগা, পাতলা, তারপর উজ্জ্বল শ্যামলাও নই। নিজেকে সুন্দরী বলার কোনো অবকাশই নেই।

স্কুলে নতুন ক্লাস শুরুর আগে আপা আমাকে তাঁর কক্ষে ডেকে অত্যন্ত স্নেহের দৃষ্টিতে বলেছিলেন, ‘আমাদের ছেলেরা খুব দুষ্টু কিন্তু। নতুন শিক্ষক, আর সে যদি হয় তরুণ বয়সী, তাকে নানাভাবে অপ্রস্তুত করতে চাইবে। সামাল দিতে পারবে তো?’

নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে বাংলা পড়াতাম। শুরুর দিকে সত্যিই ছেলেরা আমাকে অপ্রস্তুত করার জন্য নানা রকম ফন্দিফিকির করত। বিশেষ করে যেদিন আমি আমার প্রিয় গোলাপি শাড়িটি পরতাম, সেদিন ক্লাস শেষে রুম থেকে বের হওয়ামাত্র ওরা সমস্বরে সুর তুলত, গোলাপি এখন ট্রেনে।

তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, বিয়ের পর চাকরিটা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। তার জন্যও রাজিয়া মতিন আপা আমাকে যথেষ্ট বকা দিয়েছিলেন।

২.

চাকরি ছাড়ার কয়েক বছর পরের কথা। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে সেই একই পদের জন্য শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলো। আমি পরদিনই স্কুলে রাজিয়া মতিন আপার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি দ্রুত আবেদনপত্র জমা দিতে বললেন। আমিও সবকিছু জমা দিয়ে বসে আছি। কিন্তু ইন্টারভিউ লেটার আসে না। আমারও সময় হয় না একটু খবর নেওয়ার। তখন আমি আরব মিশন পাবলিক স্কুলে শিক্ষকতা করি। একান্নবর্তী সংসার, সন্তান, চাকরি করে হিমশিম অবস্থা। কয়েক দিন পর ডাকপিয়ন একটা চিঠি দিয়ে গেল। ইন্টারভিউ কার্ড এসেছে। কিন্তু দুদিন আগে সেই ইন্টারভিউর তারিখ পার হয়ে গেছে। আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। আবার ছুটে গেলাম। এবার আপা দ্বিগুণ সুরে বকা দিলেন, ‘জানো, তোমার জন্য আমি শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করে ছিলাম! কিন্তু তুমি এলে না। এখন আর আমার কিছুই করার নেই।’

কর্মজীবনে ওঠানামা আছে। এই ওঠানামার পথপরিক্রমায় পড়ে আমি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা করে সেই পেয়েও না পাওয়ার দুঃখ ভুলেছি। তবে ভুলিনি রাজিয়া মতিন চৌধুরী আপাকে, যিনি আমার বোধের ঘরে আলো জ্বেলে নিজের যোগ্যতার প্রতি আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করি তাঁকে।