জাহান প্রতিদিন ভাবেন, ‘আহা দিনটি কত সুন্দর’

জাহান ই গুলশান
ছবি: সংগৃহীত

জাহান ই গুলশান প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে ভাবেন, ‘আহা আজকের দিনটি কত সুন্দর।’ ২০২০ সাল থেকে তিনি যুদ্ধ করছেন ডিম্বাশয় (ওভারিয়ান) ক্যানসারের বিরুদ্ধে। অনেক ঝড়ঝাপটার মধ্যেও তাঁর কাছে প্রতিটি দিন সুন্দর মনে হয়।

চরম বিপদের দিনগুলোয় স্বজন ও বন্ধুদের পাশে পেয়েছেন জাহান। কখনোই মনে হয়নি তিনি একা সংগ্রাম করছেন। ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়ার জন্যই তিনি প্রতিদিন ভালো থাকার প্রতিজ্ঞা করেন।

জাহান বলেন, তিনি ক্যানসারজয়ী।  তিনি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বললেন, অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁর কাজটাকে সহজ করার জন্য বাসা থেকে কাজ বা অফিসে গেলেও কাজের চাপটা যাতে সহনীয় মাত্রায় থাকে, তার চেষ্টা করেন সব সময়। দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করার জন্য ছুটিছাটা পেতেও ঝামেলা হয় না।

সম্প্রতি কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে ক্যানসার নিয়ে অভিজ্ঞতার কথা বলেন জাহান ই গুলশান। বললেন, বিবাহিত জীবনের ১৬ বছর পার হয়েছে। হরমোনজনিত সমস্যার কারণে তিনি সন্তানের মা হতে পারেননি। এ নিয়ে নিজের বাবা–মা নাতি–নাতনির প্রত্যাশা করেন। তবে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন কখনো এ নিয়ে কিছু বলেননি। ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও এই স্বজনেরা পাশে আছেন।

জাহান বলেন, ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি বুঝেছেন, জীবন অনেক সুন্দর। তিনি বলেন,  চারপাশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্কগুলো এত সুন্দর-অসাধারণ হতে পারে, ক্যানসার না হলে জানাই যেত না। এই ভালোবাসার প্রতিদান তো দিতেই হবে।

কষ্টের দিনগুলো

২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী যখন করোনা মহামারি সেই সময়টাতেই জাহানকে  দেশে–বিদেশে বিভিন্ন অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। মুম্বাইয়ের  টাটা মেমোরিয়াল ক্যানসার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।  ২০২১ সালের মে মাসে জাহান দেশে ফেরেন।  দেশে ফেরার পর থেকে ছয় মাস পরপর ফলোআপে যেতে হচ্ছে। এখন ওরাল কেমো (কেমোর জন্য মুখে ওষুধ খাচ্ছেন) চলছে। বললেন, ক্যানসার চিকিৎসায় আর্থিক খরচ আর ভোগান্তির কথা বলতে গেলে তা এক মহাকাব্য হয়ে যাবে।

২০২০ সালের নভেম্বর মাসে দেশে অস্ত্রোপচারের পর জাহানের ক্যানসার ধরা পড়ে। ২০১৬ সাল থেকে অনিয়মিত মাসিকের সময় রক্তক্ষরণ, ব্যথা হচ্ছিল। রক্তপাত কমানোর জন্য অস্ত্রোপচার করে জরায়ুতে পাঁচ বছরের জন্য আলাদা একটি ডিভাইসও বসাতে হয়েছিল। শারীরিক সমস্যা নিয়েই ২০১৮ সালে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য কোরিয়া যান তিনি। প্রচুর রক্তপাতের জন্য হিমোগ্লোবিন কমে যেত, তখন শরীরে রক্ত দিতে হতো।

জাহান ই গুলশান
ছবি: সংগৃহীত

জাহান বলেন, মাসিকসংক্রান্ত জটিলতার চিকিৎসায় দেশের একটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে জরায়ু ও ওভারি কেটে ফেলে দেওয়া হলো (টোটাল হিস্টরেকটমি। চার ঘণ্টার অস্ত্রোপচার শেষে হাসপাতালে থাকতে হলো ২০ দিন। অস্ত্রোপচারের পর পা ফুলে ব্যথা শুরু হয়। চিকিৎসকেরা তখন বলেছিলেন পায়ে ক্যানোলা করার জন্য এমন হয়েছে। তখন পায়ে সেলুলাইটিস নামের জটিল রোগ দেখা দিয়েছে।

জাহান আরও বললেন, ‘মুম্বাই টাটা মেমোরিয়াল ক্যানসার হাসপাতালে যাওয়ার পর সব রিপোর্ট দেখে চিকিৎসক জানিয়েছিলেন আমার অস্ত্রোপচারটাই প্রটোকল মেনে করা হয়নি এবং তা ছিল অসম্পূর্ণ। অস্ত্রোপচারের আগে ক্যানসারের বিষয়টি চিকিৎসকের মাথায় থাকলে অস্ত্রোপচারের প্রটোকল অন্য রকম হতো। দুর্ভাগ্যবশত অন্যদের যে সমস্যাগুলো হয় না, তার প্রায় সবই আমার সঙ্গে হয়েছে।’

জাহান বললেন, তবে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া এটাই ক্যানসার শরীরে ছড়িয়ে পড়েনি (স্টেজ ১ সি)। জাহান বলেন, মুম্বাইতে যাওয়ার আগে স্তনের কোনো সমস্যা তিনি টের পাননি। ডিম্বাশয়ে ক্যানসার হওয়ার কারণে কয়েক দফায় পরীক্ষা চলে। তারপর স্তনে অস্ত্রোপচার করে কিছু অংশ কেটে ফেলে দেওয়া হয়। এতে  অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত থাকা যায়। মুম্বাইয়ের চিকিৎসকরা জাহানকে বলেন, ক্যানসার চিকিৎসা হলো সমন্বিত একটি চিকিৎসা, এতে কোনো কিছুই অবহেলা করা যাবে না।

ক্যানসার চিকিৎসার প্রতিটি পর্যায়ে রোগীর মনে ঝড় বইতে থাকে। জাহান বললেন, ‘কেমো দেওয়ার পর চুল পড়ে যাবে, সে মানসিক প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল। তাই মুম্বাই যাওয়ার আগেই বড় চুল কেটে ছোট করে ফেলেছিলাম। চুল পড়তে শুরু হলো, প্রচণ্ড ব্যথার সঙ্গে চুলে হাত না দিলেও ঝরঝর করে পড়তে শুরু করে। এই অবস্থায় নিজেকে ও ক্যানসারকে স্বীকৃতি দিতে পারাটা জরুরি। এখন মাথায় ঘন হয়ে চুল গজিয়েছে, তবে মাত্র ৪৩ বছর বয়সেই সব চুল সাদা হয়ে গজাচ্ছে।

স্বজনেরা পাশে

ক্যানসার শব্দটি শোনার পর থেকেই রোগী এবং স্বজনদের মানসিক যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। জাহান বললেন, ‘আমার সন্তান হয়নি, অস্ত্রোপচার করে জরায়ু, ডিম্বাশয় কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। এর সঙ্গে ক্যানসারের লড়াই। তাই পরিবারের সদস্যরা শুরুতে আমার কাছে বিষয়টি গোপন করার চেষ্টা করেন। মুম্বাই চিকিৎসার জন্য যেতে হুড়োহুড়ি করছেন কিন্তু কিসের তাড়া, তা বলছিলেন না। চিকিৎসক বন্ধুর কাছ থেকে প্রথম বিষয়টি জানতে পারি।’

মুম্বাই যাওয়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে থাকার সময়কার বড় আপু থেকে শুরু করে সবাই সব পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বলেন জাহান। স্বজন, বন্ধুরা আর্থিক সহায়তা করেছেন। এমনকি এক স্বজন গয়না বিক্রি করেও পাশে দাঁড়িয়েছেন। এক বন্ধু তাঁর সঙ্গে হাসপাতালেও ছিলেন বলেন তিনি।

মুম্বাইতে চিকিৎসার পাঁচ মাস স্বামী এহতেশাম উদ্দিন চৌধুরীকে পাশে পেয়েছেন জাহান। ইউটিউব দেখে জাহানের জন্য বিশেষ রান্না করতেন স্বামী। তাঁর সেবাতেই সুস্থ হয়েছিলেন।

কাউন্সেলিং জরুরি

জাহান বলেন, ঘুম না হওয়া, শরীর দুর্বল লাগাসহ বিভিন্ন জটিলতা থাকলেও তিনি সব সময় ভালো থাকার চেষ্টা করেন। মানসিকভাবে ভালো থাকার জন্য বন্ধুর সহায়তায় অনলাইনে কাউন্সেলিং করেছেন তিনি। মানসিক প্রশান্তির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলেন জাহান।

জাহান  টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে তাঁর দিনগুলো কেমন কেটেছে, তা ফেসবুকে এবং তাঁর ‘বিয়ন্ড ক্যানসার: মাই জার্নি টুয়ার্ডু এ নিউ লাইফ’ নামের পেজে লিখে রাখছেন। ক্যানসারজয়ী, আক্রান্ত, পরিবারের সদস্য, বন্ধু স্বজনদের নিয়ে ক্যানসার কেয়ার কমিউনিটি বাংলাদেশ নামে একটি উদ্যোগ শুরু করেছেন। এখানে ভুক্তভোগীরা নিজেদের অভিজ্ঞতা আদান–প্রদান করেন।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যানসার রোগতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, নারীদের স্তন, জরায়ু মুখের বা ডিম্বাশয়ের ক্যানসারসহ বিভিন্ন ক্যানসার হলে অনেক সময় ওই নারীর সংসারটাই ভেঙে যায়। অথচ ক্যানসার একটা রোগ এবং ক্যানসার ভালো হয়—এ দুটো মেনে নিয়ে পরিবার, স্বজন ও বন্ধুরা পাশে দাঁড়ালে ওই নারীর মানসিক শক্তি বাড়ে। একইভাবে সামাজিক সচেতনতাও জরুরি।