গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের পরামর্শ সরকারের মুক্ত মনে গ্রহণ করা উচিত

‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং থিঙ্কট্যাংক ইন সাউথ এশিয়া: হোয়াট আর দে অ্যান্ড হোয়াট দে ডু?’ শীর্ষক সেমিনারে উপস্থিত আলোচকেরা। আজ রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণাকেন্দ্রের মমতাজুর রহমান তরফদার সভাকক্ষেছবি: প্রথম আলো

গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (থিঙ্কট্যাংক) পরামর্শ মুক্ত মনে গ্রহণ করা উচিত সরকারের। যে দেশের রাজনৈতিক পরিপক্বতা যত বেশি, সেই দেশের গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের আলোচনা ও প্রস্তাব সরকার তত বেশি গ্রহণ করে। গণতান্ত্রিক পরিবেশে গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের বিকাশ হয়। আজ রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণাকেন্দ্রের মমতাজুর রহমান তরফদার সভাকক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা এই অভিমত দেন।

সেমিনারে ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং থিঙ্কট্যাংক ইন সাউথ এশিয়া: হোয়াট আর দে অ্যান্ড হোয়াট দে ডু?’ (দক্ষিণ এশিয়ার থিঙ্কট্যাংক নিয়ে জানাবোঝা: তারা কারা এবং তারা কী করে?) বিষয়ক বিশ্লেষণ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। থিঙ্কট্যাংক হচ্ছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যারা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, তথ্যপ্রযুক্তি, সংস্কৃতির মতো বিষয়ে গবেষণা করে নীতিনির্ধারণ–বিষয়ক সিদ্ধান্ত নিতে পরামর্শ দিয়ে থাকে।

আলোচনায় থিঙ্কট্যাংকের পরামর্শ সরকারকে মুক্ত মনে গ্রহণ করার আহ্বান জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণাকেন্দ্রের সভাপতি ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, থিঙ্কট্যাংকের উচিত রাজনৈতিক দলগুলের সঙ্গে আলোচনা করে নীতিনির্ধারণ এবং নীতি প্রয়োগের বিষয়ে তাদের চিন্তাভাবনা ভাগ করে নেওয়া। কেন সেই দায়িত্ব নেওয়া হচ্ছে না, থিঙ্কট্যাংকগুলোর তা নিয়ে গবেষণা করা উচিত।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি—যেসব বিষয়ে নীতিনির্ধারণ প্রয়োজন, সেসব কাজে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা থিঙ্কট্যাংকের কাজ। কোনো দেশে থিঙ্কট্যাংক কত বেশি, সেই তুলনায় না গিয়ে দেখা উচিত, থিঙ্কট্যাংকগুলো দেশটির গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখতে পারছে কি না।

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আরও বলেন, যে দেশের রাজনৈতিক পরিপক্বতা যত বেশি, সেই দেশের থিঙ্কট্যাংকের আলোচনা ও প্রস্তাব সরকার তত বেশি গ্রহণ করে। তিনি প্রতিবছর সরকারের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পর থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বাজেট বিশ্লেষণের উল্লেখ করে বলেন, ‘বিশ্লেষণ থেকে যে চিন্তাভাবনা আসে, সরকারের উচিত তা মুক্ত মনে গ্রহণ করা। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয় না।’ পরামর্শ গ্রহণ না করলে নীতিনির্ধারণ–বিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ কতটা কার্যকর হবে, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কমে গেলে থিঙ্কট্যাংকের কর্মকাণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ে বলে উল্লেখ করেন সেমিনারে মূল বক্তা কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক পরিবেশে থিঙ্কট্যাংকের বিকাশ হয়। এ ধরনের পরিবেশে যেকোনো নীতিনির্ধারণী সমস্যা সমাধানে দক্ষতার সঙ্গে পরামর্শ দিতে পারে থিঙ্কট্যাংক। থিঙ্কট্যাংক গণতন্ত্র চায়। আরও চায় তার টিকে থাকার লড়াইয়ে যেন আঘাত না আসে; সুষ্ঠু বিচারপ্রক্রিয়া যেন থাকে। এ ধরনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে একটি দেশের উন্নয়ন হয় না।

গ্লোবাল গো টু থিঙ্কট্যাংক রিপোর্ট ২০২০–এর ওপর ভিত্তি করে বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে ১১ হাজার ১৭৫টি থিঙ্কট্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে ৪৭ শতাংশ থিঙ্কট্যাংক উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে। দক্ষিণ এশিয়ায় থিঙ্কট্যাংকের সংখ্য ৭৯৭টি। এর মধ্যে ৬১২টিই ভারতের। বাংলাদেশে থিঙ্কট্যাংক ৪৬টি। এ ছাড়া আফগানিস্তানে ৪৬টি, পাকিস্তানে ৩৩টি, শ্রীলঙ্কায় ৩২টি, নেপালে ১৯টি, মালদ্বীপে ৬টি ও ভুটানে ৩টি থিঙ্কট্যাংক রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ২৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর বাস দক্ষিণ এশিয়ায়। এর মধ্যে ২৯ শতাংশ মানুষ অতিদরিদ্র। ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর থিঙ্কট্যাংক প্রত্যাশা অনুযায়ী ভূমিকা রাখতে পারছে না। থিঙ্কট্যাংকের দায়িত্ব বোধের অভাব, দুর্বল কাঠামো, অভিজাত শ্রেণির দখলে থাকা, স্বজনপ্রীতি, আমলাতান্ত্রিক সমস্যা, সরকারের স্বার্থ রক্ষা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও হস্তক্ষেপের কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর থিঙ্কট্যাংকের কাজ চ্যালেঞ্জের মুখে। কোথা থেকে অর্থ সংস্থান হচ্ছে, সেটার ওপরও থিঙ্কট্যাংকের কাজের ধরন নির্ভর করে।

সেমিনারে আলোচক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্ত্তী বলেন, এ মুহূর্তে বড় ঝুঁকি হচ্ছে ভুল তথ্য স্রোতের মতো ছড়িয়ে পড়া। এখন জীবনযাত্রায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম অনেক প্রভাব ফেলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গুজবের ভিত্তিতে একবার ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িকের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এ ধরনের প্রভাবের বিরুদ্ধে থিঙ্কট্যাংকগুলো দ্রুত কাজ করতে পারছে না। ব্যাংক থেকে এভাবে টাকা তুলে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি যে নেই, তা নিয়ে থিঙ্কট্যাংকের বক্তব্য অনেক পরে পেয়েছে জনগণ। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে এখন সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। গণতন্ত্রের কথা বললে তথ্যপ্রবাহ উন্মুক্ত করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সামাজিক নীতি উন্নয়নে থিঙ্কট্যাংকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দেশে থিঙ্কট্যাংকের সংখ্যা কম থাকলেও তারা সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছে।

সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক জসীম উদ্দিন।