শিক্ষকতার আনন্দ আর পাননি শ্যামল কান্তি ভক্ত
শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত সেদিন হাত নেড়ে অস্ফুট স্বরে শুধু বলেছিলেন, তিনি কথা বলতে চান না। মস্তিষ্কে দুই দফা রক্তক্ষরণ হয়েছে তাঁর। নানা জটিলতায় প্রায়ই অসুস্থ থাকেন এখন। তবে ছয় বছর আগে লাঞ্ছিত হওয়ার সেই ঘটনা এখনো ভুলতে পারেননি।
সেদিনের পর সপ্তাহখানেক বাদে ১৪ জুলাই শ্যামল কান্তি ভক্ত প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেন। বলেছেন সামান্যই। তবে তাঁর স্বজনেরা বলেছেন, ২০১৬ সালের ওই একটি ঘটনা তাঁদের পুরো পরিবারকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। তাঁরা এখনো ভয়ের মধ্যে দিন কাটান।
শ্যামল কান্তি ভক্ত নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ২০১৬ সালের ১৩ মে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তাঁর ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। প্রধান শিক্ষক কান ধরে ওঠবস করছেন, আর জাতীয় পার্টির তৎকালীন সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান কয়বার তিনি ওঠবস করলেন, তা গুনছেন—এমন একটি ভিডিও সে সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ ঘটনার পর শ্যামল কান্তিকে চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি। ঘটনাটি তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। তদন্তে শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং তাঁকে আবার প্রধান শিক্ষক করা হয়।
শ্যামল কান্তি ভক্তের পরও নানাভাবে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন শিক্ষকেরা। এই সংখ্যা কত, সে তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে, শুধু চলতি বছরেই মুন্সিগঞ্জের হৃদয় মণ্ডল, নওগাঁর মহাদেবপুরে সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনী পাল, নড়াইলে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস এবং সবশেষ রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ি ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক মো. সেলিম রেজা লাঞ্ছনার শিকার হন বলে খবর বেরোয়। ছাত্রের ব্যাটের আঘাতে নিহত হন আশুলিয়ার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের উৎপল কুমার সরকার।
এসব ঘটনায় নাগরিক সমাজ উদ্বেগ জানিয়েছে। ইউনিসেফ ৬ জুলাই এক বিবৃতিতে বলে, ‘শিক্ষকদের ওপর হামলা মানে শিক্ষার ওপর হামলা। আমরা যদি শিক্ষকদের সহিংসতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে ব্যর্থ হই, তাহলে শেষ পর্যন্ত শিশুরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
১৩ জুলাই শ্যামল কান্তি ভক্তের বড় মেয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি নাম বলতে চাননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের দুই বোন ঘটনার দিন ঢাকায় ছিলেন। তিনি তখন চাকরিতে, ছোট বোন কলেজে পড়তেন। মা ও আরেকটি বোন নারায়ণগঞ্জের খানপুরের বাসায় থাকতেন বাবার সঙ্গে। সেই বোনটি আগে থেকেই কিছুটা অসুস্থ।
ওই দিন প্রথমে এক বন্ধু শ্যামল কান্তির বড় মেয়েকে ইনবক্সে খুদে বার্তা পাঠিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। কেন হঠাৎ এই খুদে বার্তা বুঝতে পারেননি তিনি। এরপর তাঁকে নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় একটি পত্রিকার খবরের লিংক পাঠান আরেক ব্যক্তি। তখন তিনি জানতে পারেন, বাবা বিপদে পড়েছেন। পাগলের মতো মা–বাবার ফোনে কল করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পাচ্ছিলেন না। রাতের দিকে অসুস্থ অবস্থায় শ্যামল কান্তি ভক্তকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসেন স্ত্রী সেবিকা হালদার। সেখানেই বাবার সঙ্গে দেখা হয় মেয়ের। ওই সময় তাঁর অসুস্থ বোনটিকে বাইরে থেকে তালা মেরে আসতে হয়েছিল মা–বাবাকে।
শ্যামল কান্তি ভক্তের মেয়ে বলেন, তাঁরা ছোট থেকে দেখতেন, তাঁদের বাবা শুক্রবার স্কুলে বৈঠক করতে যান। সেদিনও গিয়েছিলেন। বৈঠক চলার সময় হঠাৎ মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা হয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ভক্ত ধর্ম অবমাননা করেছেন। কিছুক্ষণ বাদেই মিটিং রুমে অগুনতি মানুষ জড়ো হন। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তাঁর বাবার কানে প্রচণ্ড জোরে থাপ্পড় মারা হয়েছিল। এতে কান ফেটে যায়। এখনো তিনি ‘হিয়ারিং এইড’ ব্যবহার করেন। ঠিকমতো শুনতে পান না।
এরপর শ্যামল কান্তি ভক্ত আবার স্কুলে ফিরেছিলেন। পিয়ার সাত্তার লতিফ স্কুল থেকেই তিনি অবসরে যান। তাঁর মেয়ে বলেন, ‘বাবা অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন, বিজ্ঞান পড়াতেন। বোর্ডের পরীক্ষক ছিলেন ইংরেজির। ছাত্ররা যেন পাস করে সে জন্য খুব চেষ্টা করতেন।
প্রায়ই বাবার ফোন বন্ধ থাকত। ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে রাত করে বাবা বাসায় ফিরতেন। ওই ঘটনার পর বাবা আর বাবার মধ্যে ছিল না। পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যে আনন্দের সঙ্গে তিনি শিক্ষকতা করতেন, সেই আনন্দ আর পাননি। স্কুলে যেতে হয়, তাই যেতেন। কথাবার্তাও বলতেন না খুব একটা।’
বাবার ওপর এই নির্যাতনের ঘটনার প্রভাব পড়েছিল তাঁদের জীবনেও। ওই ঘটনার পর তাঁদের মা সেবিকা হালদার মেয়েদের নারায়ণগঞ্জের খানপুরের বাসায় আসতে নিষেধ করেছিলেন। একটা সময় শ্যামল কান্তি ভক্তের মেয়েরা কোথায়, দুষ্কৃতকারীরা সেই খোঁজ করেছিল। বিষয়টি আদালতে গড়ালে হামলাকারী ও উসকানিদাতাদের পক্ষ থেকে আপস করার চেষ্টা হয়। টাকাপয়সা দিয়ে ভারতে পাঠানোর প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। শ্যামল কান্তি ভক্ত সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তিনি আবার তাঁর পুরোনো প্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
১৪ জুলাই শ্যামল কান্তি ভক্ত প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ১৯৭৬ সালে শিক্ষকতা পেশায় তিনি ঢুকেছিলেন। কখনো ভাবেননি, তাঁকে তাঁর ছাত্রছাত্রীর সামনে এভাবে লাঞ্ছিত হতে হবে, কিংবা কারাগারে যেতে হবে তা–ও ছিল কল্পনাতীত। তিনি স্কুলে ফিরে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রায়ই তাঁর ভাষায় ‘নার্ভাস’ হয়ে পড়তেন। যে ছাত্র তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিল, সেই ছাত্র ও তার মা এসে শ্যামল কান্তি ভক্তের কাছে ক্ষমা চান। তিনি ছাত্রটিকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। তবে লাঞ্ছিত হওয়ার স্মৃতি ভুলতে পারেননি।
শ্যামল কান্তি ভক্তের পর আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছেন। এর শেষ কোথায়? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তিনি পিয়ার সাত্তার লতিফ স্কুলে চলা রাজনীতির শিকার। সারা দেশেই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় এই রাজনীতি চলছে। স্কুল পরিচালনা কমিটিতে যাঁরা থাকেন, তাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তাঁদের ক্ষমতা দেখানোর জায়গা মনে করেন। ক্ষমতা দেখানোর মাধ্যম হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবহার হলে বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের ওপর নিগ্রহ চলতেই থাকবে। তাঁর মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শ্রদ্ধা, স্নেহ, মমতা আর ভালোবাসার জায়গা। সেই চর্চা না করলে শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেউ বাঁচবে না।