লাশে লাশে একাকার বত্রিশ নম্বরের বাড়ি

১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সপরিবার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর এম সাখাওয়াত হোসেনের যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে। হত্যাকাণ্ডের পর তিনি ছিলেন সেই রক্তাপ্লুত বাড়ির প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী। প্রথমা প্রকাশন থেকে এ বছর বেরোনো তাঁর রক্তাক্ত দিনগুলো: ১৯৭৫-৮১: অভ্যুত্থান-পাল্টাঅভ্যুত্থান: প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা নামে বইয়ে আছে সে দিনের অভিজ্ঞতার রোমহর্ষক বিবরণ। বইটির ‘মৃত্যুপুরী বঙ্গবন্ধুর বাড়ি’ অধ্যায় থেকে পাঠকদের জন্য সে অভিজ্ঞতা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো লেখাটির তৃতীয় পর্ব

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ থেকে শুরু করে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডসহ অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের এই বাড়ি
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

জামিলের মৃতদেহের পাশ কাটিয়ে নিচের তলার প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়াতেই আমার সঙ্গে থাকা ক্যাপ্টেন বাশার আমাকে ভেতরে ঢুকে পুরো বাড়ি ঘুরে দেখে আসতে বললেন। তখন আনুমানিক সকাল ১০টা। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার-পরিজনের হত্যাকাণ্ড শেষ হয় ভোর আনুমানিক ৫টা ৩০ মিনিটের মধ্যে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরে দেখানোর দায়িত্বও নিলেন বাশার।

প্রসঙ্গত, এই অফিসারই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পাহারারত প্রথম ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটের সৈনিকদের কমান্ডার ছিলেন, যিনি রাতে সেনানিবাসে অফিসার মেসে থাকতেন। ভোরের দিকে তাঁকে নিয়ে এসে বাড়ির চার্জ বুঝিয়ে দেওয়া হয় (তিনি পরে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে সাক্ষী হয়েছিলেন)। যেতে যেতে তিনি আমাকে জানালেন যে সকাল থেকে এ পর্যন্ত আমিই প্রথম সামরিক অফিসার (অভ্যুত্থানে জড়িত অফিসাররা বাদে), যাঁকে প্রথম বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে, অর্থাৎ ১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে দৈনিক আজকের কাগজ-এ লে. কর্নেল হামিদ (বর্তমানে প্রয়াত) এই অভ্যুত্থান সম্পর্কে লিখেছিলেন। তাঁর ওই লেখায় তিনি দাবি করেছিলেন যে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ১৫ আগস্ট ২টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলেন। আমি এর একটি প্রতিবাদ পাঠালে ওই পত্রিকায় তা ছাপা হয়েছিল।

আরও পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভেতরে ঢুকে সবকিছু দেখার প্রস্তাব শুনে কেন জানি না মনে একটা সংশয়ের জন্ম হলো ভেতরে যাব কি যাব না, তা নিয়ে। পরে ভাবলাম গিয়ে দেখাটাই সমীচীন হবে। কারণ, স্বাধীন বাংলাদেশের রক্তাক্ত অধ্যায়ের তখন পর্যন্ত সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনার শেষ অঙ্কটির যবনিকা পড়ার পরেও তার কিছু প্রমাণ দেখতে পারাটা তো এক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হওয়ার মতো ব্যাপার, যা সারা জীবন মনে থাকবে। তাই কিছুটা যন্ত্রচালিতের মতো দরজার বাইরের কলাপসিবল গেট পার হয়ে সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই আমার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগল। বারবার নাকে এসে লাগছিল লাশের গন্ধ। সেই সঙ্গে বারুদের গন্ধ আর মৃত্যুর নিস্তব্ধতা মিলে সৃষ্টি হয়েছে অদ্ভুত এক পরিবেশের। সব মিলিয়ে মনে হলো এক মৃত্যুপুরীর মধ্যে এসে পড়েছি আমি। অন্তরে অকথিত বেদনা আর তারই প্রতিক্রিয়ায় চোখেমুখে গভীর বিষণ্নতা গ্রাস করতে লাগল আমায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের জাতির জনক আর রাষ্ট্রপতির বাড়ির এই গেট দিয়ে অনেকেরই কখনো ঢোকার সৌভাগ্য হয়নি। বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ যাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার বা কাছে যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকতেন, আমি এই মুহূর্তে সেই বাড়ির ভেতরে মৃত্যুর নিস্তব্ধতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, যার তর্জনী হেলনে একদা বাংলার মানুষ জীবন দিতেও কার্পণ্য করেনি, আজ সেই তাঁরই মৃতদেহ দেখার জন্য এখানে নেই কোনো ভিড়, নেই কোনো ক্রন্দন বা বিলাপ।

রক্তাক্ত দিনগুলো: ১৯৭৫-৮১: অভ্যুত্থান-পাল্টাঅভ্যুত্থান: প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা এম সাখাওয়াত হোসেন, প্রথম প্রকাশন

ভেতরে ঢুকতেই সিঁড়ির গোড়ার রুমে সেদিন রাতে ডিউটিরত পুলিশ ইন্সপেক্টরের মৃতদেহ সামনের টেবিলে রাখা টেলিফোনগুলোর ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখি। টেবিলটি রক্তে রক্তে একাকার। পরে জানতে পারলাম, বাড়ির ভেতরে প্রবেশের মুখে কলাপসিবল গেটের তালার চাবি দিতে অস্বীকার করায় তালা ভেঙে ফেলার পর প্রথমেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

ইউনিফর্ম পরা এই পুলিশ অফিসার আর একজন ব্যক্তি, যিনি নিজের কর্তব্য পালন করতে গিয়ে প্রাণ দিলেন। জানি না, এই অজানা পুলিশ অফিসার বাংলার ইতিহাসে কোনো দিন স্থান পাবেন কি না! না এ দেশের নাম না-জানা অগণিত শহীদের মতো তাঁর নাম হারিয়ে যাবে। ইতিহাসে স্থান পান আর না পান, একজন পুলিশ অফিসার সেদিন কর্তব্য পালনের এক বিরল দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন।

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চারপাশে মৃত্যুর বিভীষিকার চিহ্ন ছড়ানো জায়গাটির মধ্য দিয়ে হাঁটছি। একটু এগোতেই সিঁড়ির ডান দিকে আর একটি রুম চোখে পড়ল, বোধ হয় গেস্টরুম। তার ভেতরে ঢুকে দেখলাম বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের ও তাঁর এক সহকারীর বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহ। শেখ নাসেরের মৃতদেহ বাথরুমের দরজার সামনে পড়ে আছে। মুখে একটা আতঙ্কের ছাপ। শেখ নাসের আগের দিন খুলনা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন সেরনিয়াবাতের মেয়ের গায়েহলুদ উপলক্ষে। তিনি সেদিন হয়তো জানতেন না ঢাকায় এটাই তাঁর শেষ যাত্রা। একেই বোধ হয় বলা হয় অ্যাপয়েন্টমেন্ট উইথ ডেথ। শেখ নাসের সম্বন্ধে এর আগে অনেক কিছুই শুনেছি। আজ তিনি সবকিছুরই ঊর্ধ্বে চলে গেছেন।

আরও পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর নিষ্প্রাণ দেহ

তাড়াতাড়ি সে রুম থেকে বের হয়ে ওপরের তলায় ওঠার সিঁড়িতে পা রাখলাম। সিঁড়ির মাঝামাঝি এসেই সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখলাম, যা আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। আর সেই দৃশ্যটি ছিল সিঁড়ির ওপরে পড়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর নিষ্প্রাণ দেহ। মনে পড়ে, ১৯৫৬ সালে আমি তখন নিতান্তই বালক, সেবারই জীবনে প্রথমবার তখনকার যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখি রংপুরে। সেখানে আয়োজিত যুব উৎসবে তাঁর যোগ দেওয়ার সুবাদে।

আমার বাবা তখন রংপুরে সরকারি চাকরি করতেন। আমি রংপুর জিলা স্কুলে পড়তাম। তিনি এসেছিলেন আমাদের বাড়িওয়ালার দাওয়াতে। সেখানেই প্রথম দেখলাম একজন প্রাণবন্ত সুপুরুষ বাঙালি, উঠতি রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমানকে। আর আজ প্রায় দুই দশক পর তাঁরই বাড়ির দোতলার সিঁড়ির মধ্য ধাপে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বুলেটবিদ্ধ রক্তাক্ত নিষ্প্রাণ সুঠাম দেহ পড়ে থাকতে দেখতে পেলাম। গায়ে তাঁর সাদা পাঞ্জাবি, পরনে চেক লুঙ্গি, ডান হাত বুকের ওপরে, বাঁ হাত ঈষৎ এলানো। কিছু দূরে ছিটকে পড়া তাঁর চশমা। বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে গুলির আঘাতে। সিঁড়ির ওপরে জমাটবাঁধা চাক চাক রক্ত। মুখমণ্ডল তেমনি শান্ত। কোথাও কোনো ভয়ের চিহ্ন নেই।

দেখে মনে হলো মৃত্যুর সামান্য ছায়াও তাঁর মুখে পড়েনি। তাঁর মুখের অভিব্যক্তিতে মনে হলো, তিনি তাঁরই পরিচিত কাউকে সামনে দেখেছিলেন, যাকে দেখে হয়তো তিনি বিশ্বাসও করতে পারেননি যে এদের হাতেই তাঁকে বরণ করতে হবে এ রকমের একটি মৃত্যু। স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি সৈনিকদের গুলিতে তাঁর জীবনের ইতি ঘটবে, এ কথা তিনি বিশ্বাস করা তো দূরের কথা, কখনো দুঃস্বপ্নেও হয়তো ভাবতে পারেননি। তাঁর মৃত্যু হওয়ার কথা ছিল পাকিস্তানি সৈনিকদের গুলিতে, কিন্তু পাকিস্তানিদের সে সাহস হয়নি। তিনি যেন বেঁচে ছিলেন বাংলার মানুষকে স্বাধীন করে স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁরই নিজের বাড়িতে মৃত্যুবরণ করার জন্য।

বঙ্গবন্ধুর দেহের অবস্থান দেখে মনে প্রশ্ন জাগল, সামনের দিক থেকে গুলি করা হলে নিহতের তো সাধারণত ওপর থেকে নিচের দিকে মুখ থুবড়ে পড়ার কথা, কিন্তু তাঁর শরীর ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় কেন! পরে জানতে পারলাম, গুলি করা হয়েছিল সিঁড়ির ফার্স্ট ল্যান্ডিংয়ে। তিনি সিঁড়ির ওপরে মুখ থুবড়েই পড়ে ছিলেন। অতি উৎসাহী অভ্যুত্থানকারী সৈনিকেরা তাঁকে দেখার জন্য তাঁর দেহকে চিত করে দেয়।

বঙ্গবন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। এই সেই ব্যক্তিত্ব, যিনি মনেপ্রাণে বাঙালি ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের বিশালতা প্রকাশ পেতে থাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের একেবারে সূচনালগ্ন থেকে। ১৯৪৮ সাল থেকেই তাঁর সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, যখন পাকিস্তানের স্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে এক জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন, ‘উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’—তখন তার প্রতিবাদ করার ভেতর দিয়ে।

সেই থেকে শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন বাংলার ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাবরণ করতে হয়। কারাবন্দী হন তিনি গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে প্রধান আসামি করা হয় বাঙালির ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে সোচ্চার হওয়ার অপরাধে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত এশিয়ার ‘স্ট্রং ম্যান’ বলে খ্যাত আইয়ুব খানও তাঁকে বন্দী করে রাখতে পারেননি। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান গুঁড়িয়ে দিয়েছিল আইয়ুব খানের জেল-জুলুমের শাসনকে। সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এককথায় যাঁর জীবনের সুন্দর সময়গুলোই কেটেছে কারাগারে, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। আর এসব অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন তিনি বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য। একটা জাতির জীবনে এ ধরনের নেতার জন্ম বারবার হয় না।

কান্নাভেজা অতীত স্মৃতি

আমার মনে পড়ে, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির অনুভূতির কথা, যেদিন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসেন। আমি তখন হাজার মাইল দূরে পাকিস্তানের শিয়ালকোট রণাঙ্গনে অসহায় অবস্থায় আমার বাংকারে বসে বাংলাদেশ বেতারের ধারাবিবরণী শুনছিলাম। ভাষ্যকারের বিবরণ শুনতে শুনতে আনন্দে আর স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার গর্বে এবং এই মহান নেতার আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে আমি অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি।

আমার বাংকারে বসা এক বাঙালি সৈনিক, হাবিলদার আবু সাঈদ তো ডুকরে কেঁদে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতেই সে আমার কাছে জানতে চায়, আমরা কোনো দিন দেশে ফিরে যেতে পারব কি না।

আমি তাকে শান্ত করে বলার চেষ্টা করলাম, যে নেতা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঙালিকে একটি জাতিসত্তার অধিকারী করতে পারেন, তিনি থাকতে পাকিস্তানিরা আমাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না। এ রকম বিশ্বাস সেদিন কেবল আমার একার নয়, পাকিস্তানে আটকে পড়া সব বাঙালিরই ছিল বলে আমার ধারণা। আমার এ কথায় সেদিন আশ্বস্ত হয়েছিল সাঈদ।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা অনেক গর্ব করেছি। এক অকুতোভয় বাঙালি নেতা হিসেবে তাঁকে শ্রদ্ধা করেছি। যখন ১৯৭০ সালের নির্বাচনের রেজাল্ট দেওয়া হচ্ছিল, তখন আমরা, সমস্ত বাঙালিই মনেপ্রাণে বঙ্গবন্ধু আর আওয়ামী লীগের বিজয় কামনা করেছি। বিজয়ের পর গর্ববোধ করেছি।

গর্ববোধ করেছিলাম এ কথা ভেবে যে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। এতগুলো বছর পশ্চিম পাকিস্তানিরা যেভাবে বাঙালিদের তাদের প্রাপ্য সুযোগ ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করেছে, এবার তার অনেকাংশেরই নিরসন হবে। তবে মার্চের গোড়ায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন অফিসারদের মনমানসিকতা আর তাঁদের আলোচনা শুনে ক্রমেই সে আশা উবে যেতে শুরু করেছিল।

আমরা যে কয়জন বাঙালি অফিসার লাহোরে পাকিস্তানিদের নজরদারিতে ছিলাম, তার মধ্যে কর্নেল জামিলসহ অন্যরাও ছিলেন। সে বিষয়টি আগেই উল্লেখ করেছি। আজ এখন আমি সেই মানুষটির নিথর দেহের সামনে দাঁড়ানো, যাঁর মুক্তির জন্য এই বাঙালিরা রোজাও রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু মানুষ হিসেবে ছিলেন মহান ও বিশাল হৃদয়ের। মাত্র মাসখানেক আগেই এই মহান ব্যক্তিটির বিশাল হৃদয়ের পরিচয় পেয়েছিলাম আমি।

সেই মহান ব্যক্তিত্বের মৃতদেহের পাশে এখন আমি দাঁড়িয়ে। এক অস্বস্তিকর সময় অতিক্রম করছিলাম। বঙ্গবন্ধু, যাঁকে জাতির পিতা হিসেবেই জেনেছিলাম, তাঁর মৃতদেহ এভাবে অবহেলা আর অযত্নে পড়ে আছে, একটা চাদরও জুটল না তাঁর দেহটি ঢাকার জন্য! যেখানে উচিত ছিল তাঁর মৃতদেহ জাতীয় পতাকায় আবৃত করা। কী দুর্ভাগ্য তাঁর, দুর্ভাগ্য এ দেশের মানুষ আর আমাদের, যারা জাতীয় বীরদের সামান্যতম মর্যাদা দিতেও জানি না। (চলবে)

  • ড. এম সাখাওয়াত হোসেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার