জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: সরেজমিন কুতুবদিয়া
পাতাল ফুঁড়ে লবণ চাষ, বিপর্যস্ত কুতুবদিয়া
অবৈধ নলকূপের দৌরাত্ম্য। অন্তত দেড় হাজার নলকূপে দৈনিক ৫০ লাখ গ্যালনের বেশি ভূগর্ভস্থ লোনাপানি উত্তোলন করা হচ্ছে লবণ চাষের জন্য।
মানুষের জন্য লবণের গুরুত্ব কতটুকু তা বুঝতে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। লবণ ছাড়া কোনো খাবারই মুখে তোলা যায় না। রূপকথার সেই রাজা ও তাঁর তিন কন্যার গল্পে অমর হয়ে আছে লবণের গুরুত্ব। বুদ্ধির পরীক্ষা নেওয়ার জন্য রাজা তাঁর তিন মেয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বাবাকে কে কেমন ভালোবাসে? জবাবে বড় মেয়ে ‘মধুর মতো’ আর মেঝ মেয়ে ‘চিনির মতো’ বললেও ছোট মেয়ে বাবাকে ‘লবণের মতো’ ভালোবাসি বলে বিজয়ী হয়েছিলেন।
খাদ্যসহ বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহার ছাড়াও লবণ মানবদেহের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান; যার নির্দিষ্ট মাত্রায় হেরফের হলে মস্তিষ্ক, কিডনি, হৃদ্যন্ত্রের মতো অঙ্গ বিকলসহ জীবনসংশয় পর্যন্ত হতে পারে। তাই এই খনিজ বস্তুটি সস্তা হলেও এর ব্যবহারে থাকতে হয় অতি সতর্ক। অথচ নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসনের প্রায় নাকের ডগায় এই অতি জরুরি ও অতি বিপজ্জনক খনিজ পণ্যটির অপব্যবহার ঘটে চলেছে। ফলে মাটির ওপর ও নিচের প্রাণপ্রকৃতির সর্বনাশ হচ্ছে; পাশাপাশি লাখো মানুষের জীবন বিষিয়ে ওঠার উপক্রম হয়েছে।
এক মৌসুমে কুতুবদিয়ায় ৩ লাখ টন লবণ উৎপাদন করে যে লাভ হচ্ছে, পরিবেশ ধ্বংসের কারণে কৃষি, স্বাস্থ্যসহ নানা পেশার লাখো মানুষের ক্ষতি হচ্ছে দশ গুণ বেশিফজলুল কাদের চৌধুরী, সভাপতি, ধরা, কক্সবাজার
প্রথম আলোর দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানে এমনই এক ঘটনার আদ্যোপান্ত জানা গেছে কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলায়। প্রায় সাত বছর হলো এখানে ধুম পড়ে গেছে গভীর নলকূপ দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে লবণ উৎপাদনের। অথচ মাটির বাঁধ দিয়ে ঘেরা কুতুবদিয়ার চারদিকেই লোনাপানির অথই সাগর। সেখানে কেন মাটির গভীর থেকে পানি তুলে লবণ তৈরি করতে হবে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যায় এমন এক কাহিনি, যার পরতে পরতে ওত পেতে আছে অশনিসংকেত।
রোদে শুকিয়ে লবণ চাষ হয়ে আসছে দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোয়। কিন্তু কুতুবদিয়ায় গভীর নলকূপের পানি দিয়ে লবণ উৎপাদনের পদ্ধতি কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা উদ্ভাবনের মাধ্যমে হয়নি। এর ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানা যায় এক মজার ঘটনা।
২০১৭ সালেও সাগর চ্যানেল থেকে সৃষ্ট খালের পানি দিয়ে লবণ উৎপাদন করতেন কুতুবদিয়ার দক্ষিণ ধুরং ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সিকদারপাড়ার দরবারঘাটের সাদেকুল ইসলাম। সরকারের কাছ থেকে এসব খাল ইজারা নিয়ে লবণচাষিদের লোনাপানি সরবরাহ করতেন এলাকার কিছু মানুষ। নওশাদ নামে এ রকমই একজনের কাছ থেকে লোনাপানি কিনে লবণ চাষ করে আসছিলেন সাদেকুল ইসলাম। প্রতি কানি (৪০ শতক) জমিতে লোনাপানি নিতে তাঁকে দিতে হতো ৪ হাজার টাকা হিসাবে ৮ কানিতে ৩২ হাজার টাকা।
কিন্তু মাঝেমধ্যেই নানা অজুহাতে পানি সরবরাহ বন্ধ রাখা হতো। এতে লবণ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় দুজনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াবিবাদ লেগে থাকত। ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর এ রকম এক ঝগড়ার পর রাগ করে নিজের জমিতে একটি নলকূপ বসিয়ে ফেলেন সাদেকুল। ১৭০ ফুট গভীরেই পাওয়া যায় লোনাপানি। তারপর সেই পানি তুলে নিজের ৮ কানি জমিতে শুরু করেন লবণ চাষ। এক সপ্তাহের মধ্যে ফলাফল দেখে নিজেই অবাক হন সাদেকুল। আগে খালের পানি দিয়ে এক কানি জমি থেকে যেখানে লবণ পেতেন ২৫০ থেকে ৩০০ মণ, সেখানে ভূগর্ভের লোনাপানিতে মিলছে ৫০০ থেকে ৬০০ মণ, মানে প্রায় দ্বিগুণ! নলকূপটি বসাতে সাদেকুলের খরচ হয় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। কূপটি বসান স্থানীয় কারিগর সোনা মিয়া মিস্ত্রি।
গত ১১, ১২ ও ১৩ নভেম্বর কুতুবদিয়ায় ঘুরে শতাধিক লবণচাষির সঙ্গে কথা বলে এই ঘটনা জানার পর খুঁজে বের করা হয় সেই সাদেকুল ইসলামকে। অনেকটা গর্বের সঙ্গেই প্রথম আলোকে সাদেকুল বলেন, ভূগর্ভের পানিতে দুই গুণ লবণ উৎপাদনের খবর মুহূর্তে চাউর হয়ে যায়। চারদিক থেকে লোকজন এসে দেখেন নলকূপটি। আশপাশের লবণচাষিরা দেনদরবার শুরু করেন এই পানির জন্য। ৮ দিন পর থেকে ২০ জন চাষিকে তিনি তাঁর নলকূপের পানি সরবরাহ শুরু করেন। ২০ জনের কাছ থেকে ৫ মাসের এক মৌসুমেই আদায় করেন প্রতি কানিতে ৭ হাজার টাকা করে ৬০ কানিতে মোট ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। এক মৌসুমেই সাদেকুলের নলকূপের টাকা উশুল হয়ে লাভের খাতায় যোগ হলো আরও ৩ লাখ টাকা। ওদিকে চাষিরাও প্রায় দ্বিগুণ লবণ পেয়ে মহাখুশি।
সব মিলিয়ে এখন সাদেকুলের ৮টি নলকূপ থেকে লোনাপানি কিনে নিয়ে ৮০ কানি জমিতে লবণ উৎপাদন করছেন ৪০ জন চাষি। চাহিদা বাড়তে থাকায় দামও বাড়তে থাকে। চলতি মৌসুমে তিনি নিচ্ছেন কানিতে ১১ হাজার টাকা করে।
সাদেকুলের নলকূপের পানি নিয়ে ১০ কানি জমিতে লবণ চাষ করছেন মীর কাশেম। আগের ১৫ বছর তিনি খালের পানি দিয়ে লবণ পেতেন ৩০০ মণ; এখন পাচ্ছেন ৬০০ মণ। লবণচাষি মো. জাবের আহমদ (৪০) ও আজিজুল হকও (৩০) তা–ই করছেন।
এক উপজেলায় ১৫৫০ নলকূপ
সাদেকুল ইসলামের ভাষ্য, তাঁর বাবার আমলে সমুদ্রের লোনাপানি তুলে এনে ঘরের চুলায় সেদ্ধ করে লবণ তৈরি করা হতো। তখন শতভাগ
মানুষের প্রধান পেশা ছিল কৃষি। ঘরে ঘরে ছিল ধানের গোলা। ৬০-৭০ বছর আগে সমুদ্রের লোনাপানি দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় লবণ চাষ। তখন খালে পা-চাপা কাঠকল বসিয়ে শ্রমিকেরা মাঠে লোনাপানি সরবরাহ করতেন। একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়ের পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যায়। ধান চাষ কমতে থাকে। ১৯৯৬ সালের দিকে সিকদারপাড়া, হাজারীয়াপাড়া, নুইন্যাছড়িসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের দুই হাজার একরের ধান চাষের জমি লবণের পেটে চলে যায়।
এই গল্প করতে করতে সাদেকুল ইসলাম বলেন, ২০০০ সাল পর্যন্ত উপজেলার প্রায় ৬ হাজার একর মাঠে সনাতন পদ্ধতিতে কালো লবণ উৎপাদিত হতো। ২০০১ সালের দিকে মাঠে কালো পলিথিন বিছিয়ে শুরু হয় বিসিকের পলিথিন পদ্ধতির লবণ চাষ। প্রথমে মাঠে ছোট ছোট বাঁধ দিয়ে চার কক্ষবিশিষ্ট ঘর তৈরি করা হয়। গাছের গদা দিয়ে মাটিচাপা দিয়ে তলা সমতল করা হয়। তারপর সেই কক্ষে কালো পলিথিন বিছিয়ে সেখানে লোনাপানি জমিয়ে রাখা হয়। সূর্যের তাপে সেই পানি শুকিয়ে তৈরি হয় লবণের আস্তর। বিকেলেই তুলে ফেলা হয় লবণ।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উষ্ণতা বৃদ্ধি, পলি জমে ভরাট এবং দখলের কারণে কুতুবদিয়ায় লোনাপানি সরবরাহের সাতটি খাল শুকিয়ে যায়। ২০১৭ সাল থেকে নলকূপ বসিয়ে ভূগর্ভের লোনাপানি তুলে লবণ উৎপাদন শুরু হয়। তাতে লবণ উৎপাদন ও জমির পরিমাণ বাড়তে থাকে। গত মৌসুমে প্রায় ৭ হাজার একর জমিতে উৎপাদিত হয়েছিল ৩ লাখ মেট্রিক টনের বেশি লবণ।
কুতুবদিয়ায় এ পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ লোনাপানি তোলার জন্য কতগুলো নলকূপ বসানো হয়েছে, সেগুলো থেকে দৈনিক কত গ্যালন লোনাপানি তোলা হচ্ছে, তার হিসাব সরকারি-বেসরকারি কোনো দপ্তরেই নেই।
তবে চার বছর ধরে ভূগর্ভস্থ লোনাপানি দিয়ে কুতুবদিয়ায় লবণ উৎপাদনের সর্বনাশা কার্যক্রম নজরদারিতে রাখছিলেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার বছরে (নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাস লবণ উৎপাদন মৌসুম) এই প্রতিবেদক অন্তত ১২ বার কুতুবদিয়া গিয়ে লবণচাষি, শ্রমিক, জমির মালিক, লবণ ব্যবসায়ী-দালাল, নলকূপ বসানোর কারিগর, লবণ মিল মালিক, পরিবেশবিষয়ক সংগঠনের নেতা, বিসিক, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, কৃষি বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, উপজেলা প্রশাসনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরের অন্তত ৫০০ জনের সঙ্গে কথা বলে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের চেষ্টা চালান।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে কুতুবদিয়ায় ভূগর্ভের লোনাপানি তোলার জন্য নলকূপ বসানো হয় ২৩টি। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয় ৪৫, ২০১৯ সালে হয় ১৩৫, ২০২০ সালে ৩০৯, ২০২১ সালে ৪৫০, ২০২৩ সালে ৭৫৪ ও ২০২৪ সালে নলকূপের সংখ্যা বেড়ে হয় ৯৬০। আর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নলকূপের সংখ্যা হয়েছে ১ হাজার ৫৫০–এর বেশি। বিভিন্ন সূত্রের অনুমান বলছে, নলকূপগুলো দিয়ে দৈনিক ৫০ লাখ গ্যালন লোনাপানি তোলা হচ্ছে এবং তা ক্রমে বাড়ছে। এর মধ্যে প্রায় দেড় হাজার নলকূপ বসানো হয়েছে অবৈধ প্রক্রিয়ায়। একটি নলকূপও উচ্ছেদ হয়েছে বলে জানা যায়নি।
২০১৭ সালে সাদেকুলের প্রথম নলকূপটি বসিয়েছিলেন যে সোনা মিয়া মিস্ত্রি, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় বছরে তিনি একাই বসিয়েছেন ২৩০টির বেশি নলকূপ। তাঁর ভাষ্য, এই উপজেলায় নলকূপ বসানোর কারিগর (মিস্ত্রি) আছেন আরও ৪০-৪৫ জন। তাঁরাও একেকজন অনেকগুলো করে নলকূপ বসিয়েছেন। নলকূপগুলোর গভীরতা ১৮০ থেকে ২২৩ ফুট।
সোনা মিয়া (৪৮) প্রথম আলোকে বলেন, শুরুর দিকে ১২০-১৭০ ফুট নিচেই লোনাপানির স্তর পাওয়া যেত। এখন লোনাপানির জন্য ২৩০-৪৭০ ফুট বসাতে হচ্ছে। আর খাওয়ার পানির জন্য বসানো হচ্ছে ৮০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ ফুট গভীরতার নলকূপ।
উপজেলায় দালাল (লবণ ব্যবসায়ী) আছেন পাঁচ হাজারের মতো। দালালদের কেউ ৫টি, কেউ ১০টি, কেউ ১৫টি করে নলকূপ বসিয়ে লোনাপানির ব্যবসা করছেন। জমির মালিকেরাও নলকূপ বসিয়ে নিজেরাই লবণ উৎপাদন করছেন।
এমন একজন জমির মালিক ও লবণ ব্যবসায়ী হলেন ধুরুং বাজারের ইজারাদার কামরুল হাসান সিকদার। গত ৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ধুরুং বাজারের দোতলা ভবনের নিজ কার্যালয়ে বসে কামরুল হাসানের সঙ্গে কথা হয়। এর আগে ২০২৪ সালের ১২ নভেম্বরও কথা হয় তাঁর সঙ্গে। দুবারই তিনি লবণ চাষের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘ভূগর্ভস্থ লোনাপানি দিয়ে কুতুবদিয়ায় লবণ উৎপাদন বাড়লেও স্থানীয় চাষি ও ব্যবসায়ীদের কেউ লাভবান হচ্ছে না। তারপরও এখানে দেড় থেকে দুই হাজার নলকূপ বসে গেছে। একসময় দেখা যাবে নলকূপে পানি আসছে না। তখন লবণ চাষ বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট আরও বাড়বে। দেখা দেবে পরিবেশ বিপর্যয়।’
কামরুল হাসান এবার নিজের ৫০ কানি জমিতে লবণ চাষ করছেন। ভূগর্ভস্থ লোনাপানি তোলার জন্য মাঠে বসিয়েছেন ১০টি নলকূপ। নিজের জমিতে পানি সরবরাহের পাশাপাশি আশপাশের ৪০ জন চাষির ৬০ কানিতে লোনাপানি সরবরাহ দিয়ে কামাই করছেন মৌসুমে ৮ লাখ টাকার বেশি।
উপজেলার শতবর্ষী-প্রাচীন এই ধুরুং বাজারটি দিনের বেলায় ফাঁকা পড়ে থাকে। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে জমে ওঠে বাজারটি। ১ হাজারের বেশি দোকানপাটে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা থাকে। ক্রেতাদের ৯৫ ভাগ লবণশ্রমিক, অন্যরা ব্যবসায়ী।
ধুরুং বাজার ব্যবসায়ী মালিক-সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিছবাহুল হক সিকদার লবণ উৎপাদন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ১২ বছর ধরে। এবারও তিনি নিজের মালিকানাধীন ৬০ কানি জমিতে লবণ চাষ করছেন। সেখানে ১০টির বেশি নলকূপ বসানো হয়েছে। মিছবাহুল বলেন, অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলার ফলে কুতুবদিয়ার ঘরে ঘরে খাওয়ার পানির সংকট চলছে।
প্রথম আলোর উদ্যোগে পরীক্ষা
ভূগর্ভের লোনাপানি দিয়ে দুই গুণ লবণ উৎপাদিত হলেও পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা ঠিক কত—এই তথ্য কারও কাছে নেই। সরকারি বিভিন্ন দপ্তর থেকে একেক সময় একেক তথ্য পাওয়া যায়। কেউ বলেন, ভূগর্ভস্থ লোনাপানিতে লবণাক্ততার মাত্রা ৬০ পিপিটি; কেউ বলেন ৩০ পিপিটি; যা সাগরের লোনাপানির চেয়ে দেড় থেকে চার গুণ বেশি। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কোনো গবেষণার তথ্যও মেলে না।
শেষমেশ প্রথম আলোর উদ্যোগেই লবণাক্ততা পরীক্ষা করা হয়। নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু হয় গত ৫ ফেব্রুয়ারি। সঙ্গে রাখা হয় কুতুবদিয়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মেকানিক সোহেল রানাকে। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে দ্বীপের বিভিন্ন নলকূপের পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ সামলান তিনি। বেলা ১১টার দিকে ‘বড়ঘোপ জেটি’সংলগ্ন সাগর চ্যানেলে গিয়ে পরীক্ষার জন্য আধা লিটার লোনাপানি সংগ্রহ করা হয়। দুপুর ১২টার দিকে ৭ কিলোমিটার দূরে লেমশীখালীর হাজারীপাড়ায় গিয়ে একটি খাল থেকে আরেক বোতল লোনাপানি নেওয়া হয়। পরে সেখানকার লবণচাষি সিরাজুল ইসলামের নলকূপ থেকে আরেক বোতল ভূগর্ভের লোনাপানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
ঘটনাস্থলে দেখা হয় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুতুবদিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভূগর্ভের লোনাপানি দিয়ে এখানে দুই গুণ লবণ উৎপাদিত হলেও বিপর্যয় ডেকে আনছে পরিবেশের। এর হাত থেকে কুতুবদিয়াকে বাঁচাতে ইউএনওর মাধ্যমে আমরা ঊর্ধ্বতন মহলে অভিযোগ পাঠিয়েছিলাম। কাজ হয়নি। উল্টো নলকূপের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মিঠাপানিও নাই হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দু-তিন বছরের মধ্যে কুতুবদিয়ার লবণ, পরিবেশ এবং জীবন-জীবিকা সবই ধ্বংস হয়ে যাবে।’
কক্সবাজার শহরের মোহাজেরপাড়ার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ল্যাব থেকে গত ১০ ফেব্রুয়ারি দুপুরে প্রথম আলোর হাতে আসে নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন। প্রতিবেদন অনুযায়ী সাগর চ্যানেলের পানিতে লবণাক্ততা পাওয়া গেছে ২২ দশমিক ৮ পিপিটি (এক ট্রিলিয়নের এক ভাগ)। তাতে ক্লোরাইড পাওয়া গেছে ১৬,৩০০ মিলিগ্রাম। আর হাজারিয়াপাড়ার খালের পানিতে লবণাক্ততা পাওয়া গেছে ২৬ দশমিক ৪ পিপিটি এবং ক্লোরাইড ১৯,১০০ মিলিগ্রাম। অন্যদিকে নলকূপের ভূগর্ভস্থ লোনাপানিতে লবণাক্ততা পাওয়া গেছে ২৯ দশমিক ৭ পিপিটি এবং ক্লোরাইড ২১,০০০ মিলিগ্রাম।
জানতে চাইলে ল্যাবের দুই বিশেষজ্ঞ প্রথম আলোকে বলেন, লোনাপানিতে সর্বোচ্চ ৩৪ পিপিটি পাওয়ার নজির আছে। এলাকা ভেদে একেক পানির একেক রকম স্যালাইনিটি আসে। যে এলাকার পানিতে স্যালাইনিটি বেশি, সে এলাকার পরিবেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়।
তবে বিসিকের কক্সবাজার লবণশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপমহাব্যবস্থাপক জাফর ইকবাল ভুঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, কুতুবদিয়ার লেমশীখালী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের রাজাখালী এলাকার একটি নলকূপ থেকে ভূগর্ভস্থ লোনাপানি সংগ্রহ করে কক্সবাজার সদরের ইসলামপুরের একটি ল্যাবে পরীক্ষা করে লবণাক্ততার মাত্র পাওয়া গেছে ৬০ পিপিটি। আবার চট্টগ্রামের বাঁশখালীর একটি নলকূপের পানিতে ৪০ পিপিটি পাওয়া গেছে।
জাফর ইকবাল ভুঁইয়া আরও বলেন, এলাকাভেদে লবণাক্ততার মাত্রা ভিন্ন হতে পারে। সাগর কিংবা খালের পানির তুলনায় ভূগর্ভস্থ লোনাপানিতে দুই গুণ লবণ উৎপাদন হলেও এই লবণে দানা শক্ত হয় না। এ কারণে লবণের দাম কম পাওয়া যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানিতে কষ নিয়ে সমস্যা থাকতে পারে। লবণে কেন দানা বাঁধছে না, তার কারণ অনুসন্ধানে নতুন করে ভূগর্ভস্থ লোনাপানি সংগ্রহ করে ভিন্ন ল্যাবে পরীক্ষার চেষ্টা চলছে।
মাঠে মাঠে লবণের স্তূপ
৫ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টা। সাগর চ্যানেল পেরিয়ে কুতুবদিয়া দ্বীপে ওঠানামার প্রধান ঘাট বড়ঘোপ জেটিঘাটের উত্তর-দক্ষিণ অংশে দেখা গেল ৫০-৬০ একরের প্যারাবন। প্যারাবনের পেছনে খালি মাঠে চলছে লবণ উৎপাদন। জেটিঘাট থেকে উপকূলীয় বন বিভাগের কার্যালয় পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে ৫০০-৬০০ একর জমিতে চলছে লবণ চাষ। অধিকাংশই খাসজমি। উপজেলা প্রশাসন থেকে চিংড়ি চাষের জন্য একসনা ইজারা নিয়ে লবণ উৎপাদন করছেন প্রভাবশালীরা। শওকত নামের একজন চাষি বললেন, ‘এক কানি জমিতে প্রতিবছর সরকার ইজারা পায় ৫০০-৬০০ টাকা। আর সেই জমি লবণচাষিদের লাগিয়ত করে (বর্গা দিয়ে) নেওয়া হচ্ছে ৮০ হাজার টাকা।’
চলার পথে যাঁর সঙ্গেই দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে—সবার মুখে একই হতাশার সুর, কুতুবদিয়াকে বাঁচানোর তাগিদ। কিন্তু উপায় জানা নেই কারও।
উপজেলা কার্যালয় থেকে উত্তর দিকে উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের আলী আকবর বলীঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত ১৭ কিলোমিটারের আজম রোড (প্রধান সড়ক)। ইজিবাইকে চড়ে যাওয়ার সময় দুই পাশে যত দূর চোখ যায় শুধুই মাঠ। আর মাঠে পড়ে আছে অসংখ্য লবণের স্তূপ। এসব মাঠের যত্রতত্র দাঁড়িয়ে আছে শত শত নলকূপ। দিন-রাত সমানে পাম্প মেশিনের সাহায্যে নলকূপ থেকে তোলা হচ্ছে ভূগর্ভের লোনাপানি। শত শত পাম্প মেশিনের ভটভট শব্দে কান ঝালাপালা অবস্থা। আজম সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন ইউনিয়নে যাতায়াতের অভ্যন্তরীণ রাস্তা আছে আরও ৭৬ কিলোমিটার। সেখানেও শত শত পাম্প মেশিনের ভটভট শব্দ। লবণ পরিবহনের তিন শতাধিক লরি-টেম্পো নামের যানবাহনের ইঞ্জিনেরও বিকট শব্দ। পুরো উপজেলার যেদিকেই পা বাড়ানো যাবে, কেবলই ভটভট আওয়াজ। রাতে ঘুমাতেও হয় ভটভট শব্দে।
গত বছর জানুয়ারি মাসে দ্বীপ ঘুরে লবণ বিক্রির ধুম দেখা গিয়েছিল। তখন প্রতি মণ লবণ ৩৫০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এবার তার উল্টো চিত্র দেখা গেল। উৎপাদিত লবণ বিক্রি না করে মাঠে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে।
৫ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা তিন দিন উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের অন্তত ৪৫টি গ্রাম ঘুরে ২ হাজারের বেশি লবণের স্তূপ চোখে পড়ে। লোকসানে বিক্রি করতে হচ্ছে বলে চাষিরা উৎপাদিত লবণ স্তূপ করে ফেলে রেখেছেন। অনেকে পুকুরের আদলে খনন করা গর্তে সেই লবণ মজুত (সংরক্ষণ) করে রাখছেন। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে লবণ সংরক্ষণের গুদাম সেখানে নেই। বড়ঘোপ এলাকার চাষি আমজাদ হোসেন (৫৫) বলেন, প্রতি মণ লবণ উৎপাদন করতে তাঁর খরচ হচ্ছে ৩৫০ টাকা। সেই লবণ বিক্রি করতে হচ্ছে ১৮০ টাকায়। ন্যায্য মূল্যে লবণ বেচাবিক্রি কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের পক্ষে কথা বলার লোক দ্বীপে নেই।
দায়িত্বপ্রাপ্তরা গা-ছাড়া
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কুতুবদিয়া চরম ঝুঁকিতে উল্লেখ করে কোস্ট ফাউন্ডেশনের প্রধান রেজাউল করিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কুতুবদিয়ার এখন সবচেয়ে বড় বিপদ লবণ। শ্যালো মেশিনে মাত্রাতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ লোনাপানি তুলে লবণ উৎপাদন চলছে। লবণমাঠ বাড়ানোর জন্য উপকূল রক্ষার প্যারাবন ধ্বংস করা হচ্ছে। কুতুবদিয়ার মানুষকে বাঁচাতে হলে খাওয়ার পানি দরকার। মিষ্টিপানি দরকার সবজি চাষের জন্য। কিন্তু কুতুবদিয়ায় ঘরে ঘরে মিষ্টিপানির হাহাকার চলছে।
উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে নলকূপ আছে ২১ হাজারের বেশি। এর মধ্যে অন্তত ১২ হাজার নলকূপের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। কয়েকটি ইউনিয়নে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এতই নিচে নেমে গেছে যে, ১ হাজার ২০০ ফুট গভীরে গিয়েও সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ২০২৩ সালের ১৮ নভেম্বর কুতুবদিয়া উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কার্লযায়ে বসে উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আল আমিন এই কথা বলেছিলেন। পরিস্থিতি এখন আরও জটিল।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি একই কার্যালয়ে উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. ফরহাদ ভূঁইয়া বলেন, বড়ঘোপ ইউনিয়নের ৪ ও ৭নং ওয়ার্ড, কৈয়ারবিল ইউনিয়নের মলমচরসহ কয়েকটি গ্রামে ১ হাজার ৪০০ ফুট নিচে গিয়েও সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। খাবার পানির সংকট দূর করতে শহরের সুবিধা গ্রামে—এই প্রকল্পের আওতায় পাইপ লাইনের মাধ্যমে কৈয়ারবিল ইউনিয়নে ১৩ কিলোমিটার, বড়ঘোপ ইউনিয়নে ১০ কিলোমিটার, লেমশিখালীতে ১২ কিলোমিটার, দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নে ৭ কিলোমিটার পাইপ লাইন স্থাপনের মাধ্যমে অন্তত ২ হাজার পরিবারে খাবার পানি সরবরাহ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
ভূগর্ভস্থ লোনাপানি দিয়ে কুতুবদিয়ায় লবণ চাষের কারণ অনুসন্ধান এবং নলকূপের সংখ্যা গণনাসহ উৎপাদিত লবণের গুণমান কেমন, তা যাচাইয়ে সম্প্রতি একটি জরিপ কমিটি গঠন করা হয়েছে।
লবণ উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়া দেখভাল করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। জেলার কোথায় কত একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে, তাতে কোন সময় কী পরিমাণ লবণ উৎপাদিত হয়, কতজন চাষি লবণ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত—এমন তথ্য বছর বছর হালনাগাদ করা হলেও বিসিক কর্মকর্তারা ভূগর্ভস্থ লোনাপানি তুলে লবণ উৎপাদনে ব্যবহৃত নলকূপের সংখ্যা বা তথ্য জানেন না। লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত লবণ উৎপাদন দেখিয়ে বিসিকের কর্মকর্তা সরকারের বাহবা কুড়ালেও ভূগর্ভের লোনাপানি দিয়ে লবণ উৎপাদনের কারণে পরিবেশ-প্রতিবেশের কতটুকু ক্ষতি হচ্ছে, তা শনাক্তকরণ বা অনুসন্ধানের কোনো উদ্যোগ নেই।
বিসিক কক্সবাজার লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভুঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ভূগর্ভস্থ লোনাপানি দিয়ে কুতুবদিয়ায় লবণ চাষের কারণ অনুসন্ধান এবং নলকূপের সংখ্যা গণনাসহ উৎপাদিত লবণের গুণমান কেমন, তা যাচাইয়ে সম্প্রতি একটি জরিপ কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তবে বিসিকের কক্সবাজার লবণ উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয়ের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, কুতুবদিয়ায় ভূগর্ভস্থ লোনাপানি উত্তোলনের নলকূপের সংখ্যা ১ হাজার ছাড়িয়েছে। কোনোটির অনুমোদন নেই।
সরকারি হিসাবে ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকে ১০০ থেকে ২০০ মিলিমিটার ব্যাসের নল দিয়ে পানি উত্তোলনের নলকূপকে (টিউবওয়েল) গভীর ও অগভীর—দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২৫০ ফুটের কম গভীরতার কলকে অগভীর এবং ২৫০ ফুটের বেশি গভীরতার কলকে গভীর নলকূপ বলা হয়।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, নলকূপ স্থাপন করতে হলে প্রথমে আগ্রহী ব্যক্তিকে উপজেলা চেয়ারম্যান কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হয়। জনস্বাস্থ্যের সহকারী কিংবা উপসহকারী প্রকৌশলী সরেজমিন যাচাই-বাছাইয়ের পর আবেদনের খসড়া তালিকা ‘স্থান নির্বাচন কমিটির’ কাছে উপস্থাপন করেন। তারপর উপজেলা ওয়াটশন কমিটি নলকূপ স্থাপনের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে থাকে। অন্যদিকে কৃষিকাজে সেচ পানি সরবরাহের নলকূপ স্থাপনের জন্য উপজেলা পর্যায়ে গঠন করা হয় কৃষি ও সেচ কমিটি। কমিটির সভাপতি থাকেন ইউএনও এবং সদস্যসচিব থাকেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ পানি আইন-২০১৩ অনুযায়ী নদী, হ্রদ, মোহনা, উপকূলীয় জল ও ভূগর্ভস্থ জলের সুরক্ষা, উন্নতি এবং টেকসই ব্যবহারের জন্য সমন্বিত পদ্ধতি রয়েছে। দেশের ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে সব ধরনের পানির মালিকানা (যেমন ভূপৃষ্ঠের পানি, ভূগর্ভস্থ পানি, সমুদ্রের পানি, বৃষ্টির পানি এবং বায়ুমণ্ডলীয় পানি) জনগণের পক্ষে সরকারের। পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা সংস্থাকে জলসম্পদ আহরণ, বিতরণ, ব্যবহার, উন্নয়ন, সুরক্ষা এবং সংরক্ষণের অনুমতি দেওয়া হয় না। নদী ও খাঁড়িগুলোর প্রাকৃতিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কোনো কাঠামো নির্মাণের অনুমতি দেওয়াও হয় না। কিন্তু কুতুবদিয়ার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। অনুমোদন ছাড়াই দেড় হাজারের বেশি নলকূপ পুঁতে লাখ লাখ গ্যালন লোনাপানি তুলে সর্বনাশ ডেকে আনলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নীরব থাকছেন।
প্রশ্ন করলে কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ক্য থোয়াই প্রু মারমা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই উপজেলায় ভূগর্ভস্থ লোনাপানি উত্তোলনের নলকূপগুলো বসানো হয়েছিল। তিনি যোগদানের পর গত সাত মাসে দ্বীপের কোথাও নতুন করে নলকূপ বসানো হয়নি। আগে কতগুলো নলকূপ বসানো হয়েছে, সেই তালিকা তাঁর কাছে নেই; তবে বিসিকের কাছে থাকতে পারে।
উপজেলা কৃষি ও সেচ কমিটির সদস্যসচিব ও কুতুবদিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কৃষিতে সেচের জন্য যাচাই-বাছাই করে মিষ্টিপানি উত্তোলনের নলকূপ বসানোর অনুমতি দিতে পারে কমিটি। তবে লবণ চাষের জন্য ভূগর্ভস্থ নলকূপ বসানোর অনুমতি কমিটি দিতে পারে না।
কুতুবদিয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কেউ নেই জানিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. জমির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ লোনাপানি তুলে লবণ উৎপাদনের ঘটনা তাঁর জানা ছিল না। সরেজমিনে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’
পরিবেশবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এমনিতে সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া মারাত্মক ঝুঁকিতে। তার ওপর হাজারো গভীর নলকূপের মাধ্যমে দৈনিক ৫০ লাখ গ্যালনের বেশি ভূগর্ভস্থ লোনাপানি উত্তোলন হচ্ছে লবণ চাষের জন্য। এক মৌসুমে কুতুবদিয়ায় ৩ লাখ টন লবণ উৎপাদন করে যে লাভ হচ্ছে, পরিবেশ ধ্বংসের কারণে কৃষি, স্বাস্থ্যসহ নানা পেশার লাখো মানুষের ক্ষতি হচ্ছে দশ গুণ বেশি।