নদী উদ্ধারে কথা বেশি, সাফল্য কম

নদী রক্ষা কমিশনের তালিকা অনুযায়ী, ৩২ শতাংশ অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ হয়েছে। তবে অনেক জায়গা আবার বেদখল।

দখল–দূষণের বিরুদ্ধে থেমে গেছে অভিযান। কিন্তু প্রভাবশালীরা দেশের বিভিন্ন এলাকার নদ–নদী এখনো নতুন নতুন কায়দায় দখল চালিয়ে যাচ্ছেন। উচ্ছেদ হওয়া দখলদারও ফিরে আসছেন। বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর তীর একই কায়দায় দখল হচ্ছে। গতকাল দক্ষিণ চরাইচা এলাকার মেরিন একাডেমি–সংলগ্ন দপদপিয়া সেতু এলাকায়
ছবি: সাইয়ান

দেশে নদ-নদীর অবৈধ দখল নিয়ে গত কয়েক বছরে অনেক আলোচনা হয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উদ্যোগে ৬৪ জেলায় অবৈধ দখলদারের তালিকা করা হয়েছে। সেই তালিকা জেলায় জেলায় টানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। তবে নানা তৎপরতার পরও সাফল্য কম। মোট দখলদারের ৬৮ শতাংশকেই উচ্ছেদ করতে পারেনি সরকার। দখলমুক্ত করার পর আবার অনেক জমি দখল করে নিয়েছেন প্রভাবশালীরা।

২০১৮ ও ২০১৯ সালের দিকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উদ্যোগে ৬৪ জেলায় ৫৭ হাজার ৩৯০ অবৈধ দখলদারের তালিকা করা হয়। এই দখলদারদের মধ্যে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, সরকারি সংস্থা রয়েছে। ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ ১৮ হাজার ৫৭৯ জন বা ৩২ শতাংশ অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়। করোনা মহামারি শুরুর পর এতে ভাটা পড়ে।

নদী রক্ষার দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগসাজশে নদী দখল হচ্ছে। এতে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ শোনা গেছে। এ কারণে উচ্ছেদ অভিযানে লাভ হচ্ছে না।
মনজুর আহমেদ চৌধুরী, চেয়ারম্যান, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নদ–নদী দখলমুক্ত করার কাজ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। দখলমুক্ত জায়গা যাতে আবার বেদখল না হয়, সে জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নদী রক্ষা কমিশন দখলদারদের যে তালিকা করেছে, আরও তথ্যপ্রমাণ নিয়ে তা চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। চূড়ান্ত তালিকা অনুযায়ী আবার উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ মানুষ ও নীতিনির্ধারকদের একটি অংশের কাছে নদীর গুরুত্ব নেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অনেকেই নদীসংক্রান্ত আইন জানেন না, অনেকে আইন প্রয়োগে আন্তরিক নন। প্রভাবশালী দখলদারদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে অনেকে ভয় পান। আছে দুর্নীতি। এসব কারণে নদী উদ্ধারে সাফল্য কম।

এ পরিস্থিতিতে আজ রোববার বিশ্ব নদী দিবস পালিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনসহ বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি সংস্থা নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এবার নদী দিবসের প্রতিপাদ্য—‘নদীর অধিকার’।

দায়িত্বে অবহেলা

সারা দেশে উচ্ছেদ অভিযান চালায় মূলত স্থানীয় প্রশাসন। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০১৯) বলা হয়েছে, এসব অভিযানে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), পানিসম্পদ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় আশানুরূপ সহযোগিতা করেনি। নদীর জায়গা উদ্ধারে আইন প্রয়োগে অবহেলা, অমনোযোগিতা, গড়িমসি, দায়িত্বহীনতা, গুরুত্বহীনতা বা অযোগ্যতা ও অদক্ষতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশের প্রতিটি বিভাগে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সরকারি প্রতিষ্ঠান নদীর মধ্যে বা নদীর তীরে বড় বড় অবৈধ স্থাপনা তৈরি করেছে। সেগুলো উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত, সরকারের যেসব সংস্থা, বোর্ড, প্রশাসন বা কমিটি এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের দায়িত্বে ছিল, তারা দায়িত্ব পালনে গড়িমসি করেছে, কালক্ষেপণ করেছে। কমিশন নদী উদ্ধারে যেসব পরামর্শ, সুপারিশ বা অনুরোধ করেছে, এসব সংস্থা তা এড়িয়ে যাওয়ার বা অপব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

কমিশন মনে করে, আরেকটি কারণে উচ্ছেদ অভিযান সফল হয়নি। অভিযান চালাতে স্থানীয় প্রশাসন যে অর্থ চেয়েছিল, অর্থ বিভাগ তার সামান্যই দিয়েছিল। উচ্ছেদ ও সীমানা নির্ধারণে অর্থ ও লজিস্টিক স্বল্পতার কারণে অনেক জেলায় ঠিকমতো কাজ হয়নি।

আবার বেদখল

নদীর জমি উদ্ধার অভিযান ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরুর পর অনেকটা থেমে যায়। তবে ওই সময় পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া জমি আবার দখল হয়েছে। রাজধানীর আশপাশসহ দেশের অন্যান্য জেলায় এই চিত্র দেখা গেছে।

বিআইডব্লিইউটিএর নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দুই বছর আগে রাজধানীর আশপাশে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। এসব এলাকায় দখলদারদের আবার ফিরে আসতে দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গিয়ে দেখা যায়, প্রভাবশালী দখলদারেরা আবার নদীর সীমানায় অবকাঠামো নির্মাণ ও ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

পুরান ঢাকার লালবাগ কেল্লার মোড় থেকে ডান দিক ধরে এগোলে শ্মশানঘাট। ঘাটের উল্টো পাশে বেড়িবাঁধে আবারও সারি সারি দোকান উঠেছে। দোকানের সারির মধ্যে নির্মাণ শ্রমিক লীগের কার্যালয় চোখে পড়ল। আরেকটু সামনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সাইনবোর্ড। তার পেছনেই বাঁশের বড় হাট। এর উল্টো দিকে র্যাব-১০–এর কার্যালয়। তার পাশেই স্থানীয় সংসদ সদস্য হাজি সেলিমের প্রতিষ্ঠান মদিনা এন্টারপ্রাইজের সিমেন্ট ও রডের দোকান। তার পাশে দখলমুক্ত খালি জায়গায় বালু, ইট ও রড ফেলে রাখা হয়েছে।

২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বিআইডব্লিউটিএ লালবাগ কেল্লার মোড়, শ্মশানঘাট ও বেড়িবাঁধ এলাকায় হাজি সেলিমের মালিকানাধীন মদিনা এন্টারপ্রাইজের রড ও সিমেন্টের দোকান ও গোডাউনের সামনের অংশ উচ্ছেদ করে। পাউবো সেখানে সাইনবোর্ড টানানোসহ সীমানা পিলার স্থাপন করে।

এ ছাড়া ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর কেল্লার মোড়, শ্মশানঘাট ও বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে আমলীগোলা, বালুঘাট পর্যন্ত দোকান, কারখানা ও বসতবাড়ির বর্ধিত অংশসহ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে। বছর যেতে না যেতেই এসব এলাকা আবার দখল হয়ে গেছে।

কেরানীগঞ্জের আগানগর, তাওয়াপট্টি, পটকাজোর, খাগাইল, খোলামোড়া ও কামরাঙ্গীরচর থানার হুজুরপাড়া, কামরাঙ্গীরচর খেয়াঘাটসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় আবার অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে।

অন্যান্য জেলায়ও একই চিত্র

ভৈরব নদের যশোর সদর উপজেলার আফ্রা থেকে অভয়নগর উপজেলার মজুদখালী খাল পর্যন্ত নওয়াপাড়া নদীবন্দর এলাকায় ৪৬টি অবৈধ স্থাপনা ছিল। ২০২০ সালে দুই দফা অভিযান চালিয়ে ২৫টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এখন সেগুলো আবার দখল হয়ে গেছে।

বিআইডব্লিউটিএ ৮৬টি অবৈধ স্থাপনার তালিকা তৈরি করে। এর মধ্যে গত বছরের (২০২১) ২৯ ডিসেম্বর খুলনার ফুলতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এলাকা থেকে ফুলতলা বাজার পর্যন্ত ভৈরব নদের পাড়ে ১০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। গত ১০ থেকে ১৪ আগস্ট ৪ দফায় অভিযান চালিয়ে নওয়াপাড়ায় আরও ৬৫টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়।

যশোর শহরের দোড়াটানা মোড় এলাকায় ভৈরব নদের পাড়ে আবার দোকান বসিয়েছেন প্রভাবশালীরা।

নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নদী রক্ষার দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগসাজশে নদী দখল হচ্ছে। এতে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ শোনা গেছে। এ কারণে উচ্ছেদ অভিযানে লাভ হচ্ছে না।

মনজুর আহমেদ আরও বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা নদী দখলমুক্ত করতে নামছেন, তাঁরা উল্টো বিপদে পড়ছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশকে বদলির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, বালুখেকো ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে তিনি ঝামেলায় পড়েছেন।

কম হলেও সাফল্য আছে

কুড়িগ্রামের ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বুড়িতিস্তা নদীর মুখে স্লুইসগেট নির্মাণ করায় এর প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। এতে নদীতে বাঁধ দিয়ে অনেকে মাছ চাষ শুরু করেন। দখলদারদের উচ্ছেদ করে পানিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনার দাবিতে স্থানীয় মানুষ আন্দোলন করেন। বিষয়টি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনেরও নজরে আসে।

এরপর জেলা প্রশাসন অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে নদী খনন করলে বুড়িতিস্তায় পানিপ্রবাহ ফিরে আসে। একইভাবে নীলফামারীর দেওনাই নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এই নদীতে বাঁধ দিয়ে জলমহাল ইজারা দেওয়া হতো।

নদী রক্ষা কমিশনের দাবি, তাদের এমন আরও কিছু সাফল্য আছে। যেমন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে মাইশা বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে দেওয়া হয়নি। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় তিস্তা নদীর তীরে এক হাজার একর জমির ওপর সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা ও ৪৫ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় শীতলক্ষ্যা ও মেঘনা পয়েন্টে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা আনলিমা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা হয়।

কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও স্থানীয় প্রশাসনের আন্তরিকতা থাকলে নদীর জমি দখলমুক্ত করা সম্ভব। জমি বেদখল হওয়ার তুলনায় উদ্ধার সামান্যই।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন প্রণব বল, চট্টগ্রাম, মাসুদ আলম, যশোর, সফি খান, কুড়িগ্রাম, ইকবাল হোসেন, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)]