হলের বারান্দা থেকে পড়ে নিহত শিক্ষার্থী ফিরোজের টেবিলে ছিল একটি চিঠি

মো. ফিরোজ কাজী
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের একটি ভবনের বারান্দা থেকে পড়ে মারা যাওয়া শিক্ষার্থী মো. ফিরোজ কাজীর (২২) পড়ার টেবিলে পাওয়া গেছে একটি চিঠি। প্যাড খাতায় এক পৃষ্ঠায় সেই চিঠির নিচের দিকে ফিরোজের নাম লেখা রয়েছে। চিঠির হাতের লেখাটি ফিরোজের লেখার সঙ্গে মিল আছে বলে রুমমেটরা মনে করলেও ফিরোজের ভাই এতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাতে ১১ তলা বিশিষ্ট বিজয় একাত্তর হলের একটি ভবনের ওপরের দিককার একটি তলার বারান্দা থেকে নিচে পড়ে যান ফিরোজ। তখন অন্য শিক্ষার্থীরা তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ফিরোজের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরের পুখরিয়া গ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। জিয়াউর রহমান হলের ২০৩ নম্বর কক্ষে থাকতেন।

চিঠিতে যা লেখা

ফিরোজের পড়ার টেবিলে পাওয়া ওই চিঠির ওপর ১৯০৯/২৩ তারিখ লেখা রয়েছে। এরপর লেখা হয়েছে, ‘মানুষ বাঁচে তার সম্মানে। আজ মানুষের সামনে আমার যেহেতু সম্মান নাই, এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আমার কোনো অধিকার নাই। আমার মৃত্যুর দায়ভার একান্ত আমার। স্যরি মা! বাড়ি থেকে তোমাকে দিয়ে আসা কথা রাখতে পারলাম না। আমার জীবন নিয়ে হতাশ।’ এরপর পৃষ্ঠার কিছুটা জায়গা পরে লেখা হয়েছে—‘ফিরোজ’। এর ঠিক নিচে সময় লেখা হয়েছে—‘রাত: ১১টা ৩’।

পৃষ্ঠার নিচের অংশে লেখা হয়েছে, ‘আমার ওয়ালেটের কার্ডে কিছু টাকা আছে। বন্ধুদের কাছে অনুরোধ রইল মায়ের হাতে দিতে৷ কার্ডের পাসওয়ার্ড ৮০৭৯ আর ফোনের লক খুলে দিয়ে গেলাম। আমার লাশের পোস্টমর্টেম না করে যেন বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কোনোরূপ আইনি ঝামেলায় কাউকে যেন জড়ানো না হয়। সবাই বাঁচুক। শুধু শুধু পৃথিবীর অক্সিজেন আর নষ্ট করতে চাই না।’ লেখার এই অংশের নিচে লেখা হয়েছে ‘ফিরোজ, রাত ১১টা ৫।’

ফিরোজের টেবিলে পাওয়া গেছে এই চিঠি
ছবি: সংগৃহীত

এই লেখার সঙ্গে ফিরোজের হাতের লেখার সাদৃশ্য আছে বলে জানিয়েছেন তাঁর রুমমেটরা। জিয়াউর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেনেরও ধারণা, এই লেখাটি একটি ‘সুইসাইড নোট’৷ তিনি বলেছেন, ফিরোজ যখন কক্ষ থেকে বের হয়েছেন, তিনি তাঁর মুঠোফোন, মানিব্যাগ ও সুইসাইড নোট কক্ষে রেখে গেছেন। হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে কাজী ফিরোজের পরিবারকে সার্বিক সহায়তা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে ৬ সেপ্টেম্বর এক ফেসবুক পোস্টে ফিরোজ লিখেছিলেন, ‘মানুষ যেভাবে বাঁচতে চায়, তাকে সেভাবে বাঁচতে দেওয়া হোক। সবাই বাঁচুক, আপন প্রাণে আপন চাওয়াতে মানুষ বাঁচুক।’ এর কয়েক দিন পর আরেক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি সবই সুন্দর। আপনার কাছে যা ভালো লাগে না, সৃষ্টিকর্তা সেটাও সৃষ্টি করেছেন। যেমন মানুষ। সুতরাং কাউকে তাচ্ছিল্য করা উচিত নয়। প্রভুর প্রশংসা করুন।’

লেখা ফিরোজের কি না, সন্দেহ ভাইয়ের

ফিরোজের মৃত্যুর খবর পেয়ে ঢাকা মেডিকেলে ছুটে আসেন তাঁর বড় ভাই ফেরদৌস কাজী। তিনি গ্রামেই মুঠোফোন সার্ভিসিংয়ের ব্যবসা করেন। তিনিই ফিরোজের পড়াশোনার খরচ চালাতেন। বিকেলে ফোনে জানতে চাইলে চিঠির হাতের লেখা ফিরোজের কি না, তা নিয়ে তিনি প্রথম আলোর কাছে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে ফিরোজ ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁদের বাবা চুন্নু কাজী কৃষিকাজ করেন আর মা আনোয়ারা বেগম গৃহিণী।

এক প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য

বিজয় একাত্তর হলের ভবনের ওপর থেকে ফিরোজের পড়ে যাওয়ার ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের ছাত্র ওয়াহিদুল আলম। তাঁর ভাষ্য, গতকাল দিবাগত রাত ১২টা ৫০ থেকে ৫৫ মিনিটের মধ্যে কাজী ফিরোজ বিজয় একাত্তর হলের যমুনা ব্লক থেকে পড়ে যান। যেখানে তিনি পড়ে ছিলেন, সেই জায়গাটি ছিল মাটির। এর ঠিক পাশেই পাকা রাস্তা। ওই রাস্তার ওপর ছিল ফিরোজের হাত৷

ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘মঙ্গলবার (গতকাল) দিবাগত রাত ১২টা ৫০ থেকে ৫৫ মিনিটের মধ্যে আমি বিজয় একাত্তর হলের মাঠে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলাম। আমার চোখ যমুনা ব্লকের দিকে ছিল৷ হঠাৎ “আল্লাহ রে” বলে একটা চিৎকার শুনতে পাই৷ তখন যমুনা ব্লকের মাঝামাঝি অংশে তাকালে দেখতে পাই যে লুঙ্গির মতো কিছু একটা নিচে পড়ে যাচ্ছে। এরপর অনেক জোরে একটা শব্দ হয়। কেউ হয়তো লাফ দিয়েছে বা পড়ে গেছে বলে বুঝতে পারলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমি দৌড়ে সেখানে যাই এবং পাশের পাঠকক্ষ থেকে আরও কয়েকজন ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। কাজী ফিরোজের শরীর তখন ঘর্মাক্ত ছিল, তিনি সেন্সলেস (অচেতন) হয়ে পড়ে ছিলেন। কেউ একজন তাঁর মুখে পানি দিয়ে, বুকে পাঞ্চ করলে তিনি নিশ্বাস নেওয়া শুরু করেন। পরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’

কাজী ফিরোজের পরনে একটি লুঙ্গি এবং গলায় একটি গামছা ছিল বলে জানান ওয়াহিদুল আলম৷ বিজয় একাত্তর হলের ছাত্র শেখ রাব্বীসহ আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী কাজী ফিরোজকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যান বলেও জানান তিনি।

রুমমেটরা যা বললেন

কাজী ফিরোজের রুমমেট মাসুম বিল্লাহ (বেডমেট) বলেন, ‘মঙ্গলবার (গতকাল) রাতে আমি লাইব্রেরি থেকে যখন কক্ষে আসি, তার কিছুক্ষণ পর ফিরোজ কক্ষে আসে। সাড়ে ১০টার আগে-পরে ফিরোজ সবাইকে বলছিল, ‘তোরা কেউ আমার কাছ থেকে কোনো টাকা পাস কি না বল। দুই টাকা হলেও বল। আমি দিয়ে দিতে চাই। পেলে এখনই বল।’

ওই কক্ষের আরেক বাসিন্দা মো. মাসুদ বলেন, ‘গতকাল রাত ১২টার সময়ও ফিরোজ কক্ষেই ছিলেন।’ মাসুদের ভাষ্য, ‘ফিরোজ এদিক-সেদিক পায়চারি করছিল। আমাকে বলেছিল, ‘বন্ধু, তোর মোবাইলটা একটু দে। আমি একটা ফোন দিব।’ এরপর সে আমার মুঠোফোন নিয়ে কোনো একটা নম্বরে ফোন দেয়। একটু পরে আমার ফোন ফেরতও দিয়ে দেয়।

মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘রাত ১২টার পর সে মানিব্যাগ ও মুঠোফোন রেখে কক্ষ থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, কই যাচ্ছিস? তার উত্তর ছিল, “আমি একাত্তর হলে যাচ্ছি, একটু কাজে।” আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি। ফিরোজের জন্য রাখা রাতের খাবারটা সে অল্প একটু খেয়েছিল।’

বিষণ্ন ছিলেন ফিরোজ

ফিরোজের এক রুমমেট নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক ছাত্রীর সঙ্গে ফিরোজের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিছুদিন আগে তাঁদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এতে ফিরোজ বিষণ্ন হয়ে পড়েন। তাঁর পরিবারের সদস্যরাও নানাভাবে ফিরোজের সঙ্গে ওই ছাত্রীর সম্পর্ক ঠিক করার চেষ্টায় জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ওই ছাত্রী কোনোভাবেই সম্পর্ক ঠিক করতে রাজি হচ্ছিলেন না। এর ফলে ফিরোজ আরও বেশি বিষণ্ন হয়ে পড়েন।

এদিকে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ময়নাতদন্ত শেষে বেলা একটায় কাজী ফিরোজের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মরদেহ দাফনের জন্য গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।

আরও পড়ুন