প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্রের উদ্বোধন
আমার ধারণা, শেখ হাসিনার শেষ দিন ভারতেই কাটবে : আসিফ নজরুল
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নির্বিচারে মানুষ হত্যা প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রেও কিছু কাজ নিষেধ করা আছে। কেউ পালাচ্ছেন, নিরস্ত্র মানুষ, মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন—এমন মানুষকে যুদ্ধক্ষেত্রেও হত্যা করা যায় না। পৃথিবীর যেকোনো আইনে এটা যুদ্ধাপরাধ। কিন্তু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে দেখা গেছে, পালিয়ে যাচ্ছেন, এমন মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর একজন মানুষ হাতজোড় করছেন, তাঁকে কাছে থেকে গুলি করা হয়েছে। একটা মানুষ মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, তাঁর মাথায় গুলি করা হয়েছে। লাশ পুড়িয়ে দিয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে আজ মঙ্গলবার ‘রক্তাক্ত মহাসড়ক: যাত্রাবাড়ী হত্যাকাণ্ড’ শীর্ষক প্রথম আলোর নতুন অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্রের উদ্বোধনী প্রদর্শনী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ কথাগুলো বলেন আইন উপদেষ্টা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে এই অনুষ্ঠান হয়।
শেখ হাসিনার বিচার হলেও তাঁকে হয়তো দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না বলে ধারণা করেন আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি, প্রধান যে আসামি আছে, প্রধান অপরাধী আছে, আমার ধারণা, আমি জানি না এভাবে বলাটা ঠিক হচ্ছে কি না, আমার ধারণা, তার শেষ দিন ভারতেই কাটবে। তাকে বোধ হয় আমরা কখনো পাব না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মনে যে ঘৃণা নিয়ে সে বেঁচে থাকবে, সেটাও যদি আমাদের অর্জন হয়, সেটাও কম নয়। এত ঘৃণা মানুষের, এত কষ্ট, এত ক্ষোভ। এই ঘৃণা থেকে, ক্ষোভ থেকে, ক্রোধ থেকে আশা আছে, সংস্কারের মাধ্যমে এ রকম শাসক যেন এ দেশে আর তৈরি না হয়। আমরা চেষ্টা করছি, আমাদের চেষ্টার ত্রুটি নাই।’
অনুষ্ঠানে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করেন আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘পুলিশকে যে এ রকম একটা অমানুষ, বেপরোয়া, ভয়াবহ বাহিনীতে রূপান্তর করেছে, সে কত বড় অমানুষ। কত বড় অমানুষ হতে পারে সে। কোনো একটা পুলিশ বাহিনী, সম্ভবত ইসরায়েলিরা প্যালেস্টাইনের মানুষকে বোধ হয় এভাবে মারে।...একটা দেশের সুশৃঙ্খল বাহিনী, আমার ট্যাক্সের টাকায় চলা, তাকে (পুলিশ বাহিনী) ইসরায়েলি বাহিনীর মতো করে বাহিনী বানিয়েছে, যেটা এভাবে খুন করতে পারে।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে নির্বিচারে মানুষ হত্যার অসংখ্য ফুটেজ আছে বলে উল্লেখ করেন আইন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি শেখ হাসিনার স্ট্যান্ডার্ডে বিচার করতাম, তাহলে এই বিচার চার থেকে পাঁচ মাসে হয়ে যেত। আমরা সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক, জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য, ২০ বছর, ৩০ বছর পরও যেন বিচার নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে, এ জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে এবং আইন সংশোধন করে বিচার করছি। এখানে আপনার, মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবনের সবচেয়ে বড় শান্তির দিন বোধ হয় থাকবে—বিচার যখন শেষ হবে।’
আইন উপদেষ্টা বলেন, তিনি যখন আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন, তখন শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলেছেন, তিনি সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হবেন। কারণ, আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হলো সমালোচিত হওয়ার জায়গা। এই সরকার চলে যাওয়ার পর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকবেন তিনি।
আসিফ নজরুল বলেন, ‘আপনারা জানেন, কেন ঝুঁকিতে থাকব। দুঃখ নাই, আল্লাহ আমাকে এত বড় একটা সুযোগ দিয়েছেন দায়িত্ব পালনের জন্য। আমার জানা মতে, এই দায়িত্ব পালনে আমার ও টিমের একবিন্দু গাফিলতি নেই। একবিন্দু অবিচার করার ইচ্ছা নাই। সুবিচার করার মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক বিচার হওয়া উচিত। ইনশা আল্লাহ, আশা করি, আমাদের সরকারে থাকা অবস্থায় তার (শেখ হাসিনা) বিচার শেষ হবে।’
প্রদর্শনী শেষে সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান বলেন, এই প্রামাণ্যচিত্র সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় অনুসন্ধান। একটি গল্প কীভাবে মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, এটি এমনই একটি অনুসন্ধান।
প্রামাণ্যচিত্রটি দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এমন দৃশ্য দেখার পর কোনো কথা বের হয় না। গত স্বৈরাচারী আমলে দেখা গেছে, দেশের পতাকাকে ব্যবহার করে নানা প্রচারণা চালানো হয়েছে। প্রামাণ্যচিত্রের একটি অংশে দেখা গেছে, কপালে পতাকা নিয়ে ঘুরছেন—এমন একজনের কপালে গুলি করা হয়েছে। এটার চেয়ে ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। সেদিন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে কী ঘটেছিল, তা নিয়ে প্রথম আলো ৩৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছে। প্রামাণ্যচিত্রে উঠে এসেছে, সেদিন কীভাবে নির্বিচারে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আন্দোলনকারীদের ধারণ করা ভিডিও, সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ও তখনকার সময়ের ছবি প্রায় পাঁচ মাস ধরে সংগ্রহ করা হয়। পরে এগুলো বিশ্লেষণ করে প্রামাণ্যচিত্রটি তৈরি করা হয়। এটির নির্মাতা প্রথম আলোর সিনিয়র কনটেন্ট ক্রিয়েটর আব্দুল্লাহ আল হোসাইন।
অনুষ্ঠানে আব্দুল্লাহ আল হোসাইন বলেন, এটি তৈরির জন্য গত ফেব্রুয়ারি থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করা হয়। ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের প্রত্যেক পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য নেওয়া হয়। ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের পাশাপাশি প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান; গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ; শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা; লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা; কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী সঞ্জীব দ্রং; সাইটসেভার্সের অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন কো-অর্ডিনেটর খোন্দকার সোহেল রানা; বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক কল্লোল মোস্তফা; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তারিক মনজুর; জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের হেড অব কমিউনিকেশনস আবদুল কাইয়ুম প্রমুখ।