বহু কষ্টের দিন কাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা ক্যউপ্রু বাঁশির সুরে দেখছেন দিন বদলের আশা
দুই বছর বয়সে হারিয়েছিলেন বাবাকে। শৈশব-কৈশোরের একটা সময় কেটেছে অনাথালয়ে। কত কষ্টের দিন কেটেছে ক্যউপ্রু মারমার। তবে থেমে যাননি। এখন পড়াশোনা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। জীবনের এ পর্যায়ে এসে আলাদা একটি পরিচিতি পেয়েছেন। বাঁশি বাজিয়ে মানুষের প্রশংসা ও ভালোবাসা পাচ্ছেন ক্যউপ্রু। এই বাঁশি বাজিয়েই মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে চান তিনি।
ক্যউপ্রু মারমার মা একজন জুমচাষি। দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। ছেলেবেলা থেকেই মায়ের কষ্ট দেখে বড় হয়েছেন তিনি। কিন্তু সে কষ্টের কথা কাউকে বলা বা তা শোনার মতো কেউ ছিল না। এসব কষ্ট থেকে খানিকটা সময় দূরে থাকার জন্য গান ও বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে মিতালি করেছিলেন। সেই প্রচেষ্টার ফসল বাঁশিতে সুর তোলা। ফেসবুকে এই পরিবেশনা তুলে ধরে পরিচিতি পেয়েছেন ক্যউপ্রু।
বাঁশির পাশাপাশি হারমোনিয়াম, ঢোল, গিটার, মেলোডিকা বাজান ক্যউপ্রু মারমা। কখনো কখনো গান গেয়ে সেই ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করেন। গত বছর একদিন তাঁর কুয়াশার মধ্যে ঘোরার ইচ্ছা হয়। ভোরে মাকে নিয়ে বের হন। মা নৌকা চালান, আর ক্যউপ্রু মারমা বাজান বাঁশি। বাঁশি বাজানোর ওই ভিডিও ফেসবুকে খুব জনপ্রিয় হয়।
কখনো উঁচু পাহাড়ের কোনো জায়গায়, কখনো নদীর তীরে, কখনো আবার বাড়ির সামনে বসে বাঁশি বাজান ক্যউপ্রু মারমা। চারপাশে তখন শোনা যায় শুকনা পাতার শব্দ, মেঘের গর্জন, পাখির ডাক, বৃষ্টি পড়ার শব্দ কিংবা পাহাড়ি ঝিরির ঠান্ডা পানির বয়ে চলার কুলকুল শব্দ। কখনো বাড়ির কাছের বৌদ্ধবিহার থেকে ভেসে আসে ভোরের ত্রিপিটক পাঠ।
একটি স্ট্যান্ডে মুঠোফোন রেখে বাঁশি বাজানোর ভিডিও করেন ক্যউপ্রু মারমা। সামনে পরিচিত কেউ থাকলে তাঁরাও সহায়তা করেন। গত বছরের আগস্ট মাস থেকে মূলত তিনি ভিডিওগুলো ফেসবুকে পোস্ট করছেন। জীবনের এ পর্যায়ে আসতে ক্যউপ্রু মারমাকে উৎসাহ ও সহায়তা দিয়েছেন অনেকে। তাঁদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি বাঁশি ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ক্যউপ্রু মারমা তাঁর জুমচাষি মায়ের স্বপ্নও পূরণ করতে চান। তিনি বলেন, ‘আমার মনের সুরই মানুষ আমার বাঁশির মাধ্যমে শুনতে পান। অনেকেই তা পছন্দ করেন। এটাই আমার বড় প্রাপ্তি।’
মা-ছেলের সংগ্রাম
ক্যউপ্রু মারমার বয়স যখন মাত্র চার বছর তখন তাঁর মা মামুইনু মারমা তাঁকে কোয়ান্টাম শিশুকাননে (অনাথালয়) রেখে এসেছিলেন। সেখানেই দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষ সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছেন। থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই।
জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় এখন চলতে একটু কষ্ট হয় ক্যউপ্রু মারমার। টাকায় টান পড়লে মায়ের কাছ থেকে কিছু নেন। তিনি বললেন, টানাপোড়েনেই চলে মা ও ছেলের সংসার। মা থাকেন বান্দরবানের রুমায় ভাড়া বাসায়। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলেই ছেলে চলে যান মায়ের কাছে।
শুদ্ধ সংগীতপ্রেমী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন ক্যউপ্রু মারমা। জানালেন, তাঁর মা এক সময় গুনগুন করে আপন মনে গান গাইতেন। অভাব-অনটন ও নানা সংগ্রামের মধ্যে আস্তে আস্তে গান গাওয়া ছেড়ে দেন মা। তবে চান ছেলে গানবাজনার মাধ্যমে সুনাম অর্জন করুক। তাই ক্যউপ্রু মারমার শখের পথে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়াননি তিনি।
মামুইনু মারমার আয়েই মা-ছেলের সংসার চলে। ক্যউপ্রু মারমার দুই বছর বয়সে তাঁর বাবা উমিংমং মারমা ম্যালেরিয়ায় মারা যান। তিনিও জুমচাষি ছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর শ্বশুরবাড়িতে থাকতে পারেননি মা। স্বামীর ভাগের সম্পত্তিও পাননি।
ক্যউপ্রু মারমা বলেন, ‘মা আমার কথা চিন্তা করে আর কখনো বিয়ে করেননি। বাবা মারা যাওয়ার পর আমাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেন। তাই আমি মায়ের জন্য একটি বাড়ি বানিয়ে দিতে চাই। বাঁশি বা গানবাজনা নিয়ে স্বপ্ন দেখার পর মায়ের বাড়ি বানানো আমার আরেকটি স্বপ্ন।’
ক্যউপ্রু মারমার মা-বাবা পড়াশোনা করেননি। তবে মা চেয়েছেন—ছেলে উচ্চশিক্ষিত হবে। তাই কষ্ট সহ্য করেও ছেলেকে পড়াচ্ছেন। ক্যউপ্রু মারমা বলেন, ‘অনাথালয় থেকে চলে আসার পর বিভিন্ন সময় আমার পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বেঁচে থাকার তাগিদে নিজেও জুমচাষ করেছি। কাজটি খুবই কঠিন ও পরিশ্রমের। মা এই কাজ করেই আমাকে বড় করেছেন। এখনো পড়াশোনা করাচ্ছেন। আমি মায়ের কষ্টটা বুঝতে পারি।’
ফেসবুকে পরিচিতি বাড়ায় ক্যউপ্রু মারমা বর্তমানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও কনসার্টে বাঁশি বাজানোর আমন্ত্রণ পাচ্ছেন, সেই সঙ্গে সম্মানীও উঠছে তাঁর হাতে। তবে এটা নিয়মিত নয়। ফেসবুকে ভিডিও পোস্ট করে তিনি এখনো আয় করা শুরু করেননি। ক্যউপ্রু মারমা ‘ইনস্ট্রুমেন্টাল আর্টিস্ট’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান।
স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাওয়া
বাঁশির সুর প্রসঙ্গে ক্যউপ্রু মারমা বললেন, বাঁশির আলাদা একটা ভাষা আছে। বাঁশির সুর শুনলে একধরনের ভালো লাগা কাজ করে। চিন্তা, অবসাদ, ক্ষোভ থেকে মুক্তি মেলে। মানসিক স্বস্তি পাওয়া যায়। ফেসবুকে বাঁশির ভিডিওর নিচেও অনেকে মন্তব্যে এমন কথা জানান। এ থেকেও তিনি উৎসাহিত হন বাঁশি বাজাতে।
ছোটবেলা থেকেই অনেক কিছু না পাওয়া এবং অবহেলার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন ক্যউপ্রু মারমা। বাবা ও মায়ের পরিবারের মধ্যে তিনিই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। ফলাফলও ভালোই হচ্ছে। ক্যউপ্রু মারমা বাঁশি নিয়ে ভালো কাজ করা এবং নিজের চিন্তাভাবনাকে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।
চট্টগ্রামে ‘দরবার’ নামক একটি ব্যান্ডেও বাঁশি বাজান ক্যউপ্রু মারমা। বাঁশি বাজানোয় গুরু মানেন সুব্রত রায়কে। ক্যউপ্রু মারমা মুঠোফোনে হেসে জানালেন, স্বপ্ন পূরণে তিনি আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। তাঁর কাজের প্রশংসাও পাচ্ছেন।
ক্যউপ্রু মারমা বললেন, ‘একসময় আমার আর মায়ের পাশে দু-একজন ছাড়া কাউকে পাইনি। ঘরে দুই–তিনটি হাঁড়ি পাতিল ছাড়া কিছু ছিল না। ভালো কোনো কাপড় ছিল না। খেয়ে না–খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। পাহাড়ে মা একা সংগ্রাম করে আমাকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। ছেলেকে কেন অনাথালয়ে পাঠিয়েছেন তা নিয়েও মাকে বাজে মন্তব্য শুনতে হয়েছে। একসময় সবাই ধরেই নিয়েছিলেন আমার জীবনও কাটবে জুমচাষি হিসেবে। তবে সেই জায়গা থেকে আমরা মা-ছেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছি।’