‘১০ শতাংশ মানুষও বই কেনে না’

আকমল মিয়া দেয়াল টপকে মেলার সীমানায় ঢুকেছেন গতকাল। ধরা পড়ে একটু ঘাবড়ে গেলেও সামলে নিলেন নিজেকে। প্রশস্ত হাসি দিয়ে এই চা–বিক্রেতা জানালেন, ভিড়টা দেখছেন? মেলার সামনের জায়গায় বসতে পারলে তিন দিনের রোজগার। গতকাল শুক্রবার বিকেলে মেলায় প্রবেশ করতে হয়েছে টিএসসির সামনে থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে। মেলায় এত মানুষের উপস্থিতিতে বই বিক্রি নিয়ে সবারই প্রত্যাশা বাড়ে।

বইয়ের খবর নিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একেবারে অন্য প্রান্তে উঁকি দিয়ে দেখা গেল কথাপ্রকাশে উপস্থিত কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস। প্রথম আলোকে বললেন, ‘ভিড়টা অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে। যত মানুষ আসছে, এর ২৫ শতাংশ যদি বই কিনত, বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করত। মেলায় আসা ১০ শতাংশ মানুষও বই কেনে না। মা–বাবাকে সন্তানের হাতে বই তুলে দেওয়ার অভ্যাস করতে হবে।’

পাশেই অন্যপ্রকাশের বইয়ের রাজ্যে তখন বিপণনকর্মীসহ সবাই সাদা টি–শার্ট গায়ে দিয়ে পাঠকের জন্য বই খুঁজছেন। তাঁদের টি–শার্টে লেখা ‘শঙ্খচূড়’। এবারের মেলায় প্রকাশিত উপন্যাসের নাম। লেখক আসবেন কি না, খবরটি জানা সম্ভব হলো না ভিড়ের জন্যই। অনন্যায় দেখা গেল পাঠক ঘিরে রেখেছেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনকে।

শুক্রবারের এই জনসমাগমের আরেকটি কারণ দিনভর মেলায় নানা আয়োজন। সকাল থেকে শুরু হওয়া মেলায় হয়েছে শিশু–কিশোরদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। বিকেলে মেলায় প্রবেশ করে দেখা গেল, অনেকেই তখনো অভিভাবকের সঙ্গে উপস্থিত। সিসিমপুরের হালুম, টুকটুকিরাও গতকাল শিশুপ্রহরসহ তিনবার উপস্থিত হয়েছে। বিকেলে সিসিমপুরের মঞ্চে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদার দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। গতকাল নতুন বই এসেছে আগের দুই দিনের তুলনায় অনেক বেশি। ২৩৯টি নতুন বই জমা হয়েছে গতকাল।

তবে মেলা প্রায় শেষ হতে চললেও এবার কোনো কোনো প্রকাশনীতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বই আসেনি। গবেষণামূলক বই করে সংহতি। এবারের মেলায় তাদের নতুন বই এখন পর্যন্ত দুটি। সর্বজনের শিক্ষা, অ এ শিখি এবং খেরোখাতার স্মৃতিকথা এসেছে। দু–এক দিনের মধ্যে প্রকাশিত হবে আনু মুহাম্মদের পুঁজির বিশ্বযাত্রা এবং কাজী মসিউর রহমানের অনুবাদে হেলেনা নরবার্গ হজের বই সুখের অর্থনীতি। তবে সংহতি থেকে আগে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর পাঠক সব সময়ই আছে। বদরুদ্দীন উমরের আমার জীবন–এর ৫টি খণ্ড অথবা ভাষাসৈনিক, সাম্যবাদী নেতা মোহাম্মদ তোয়াহার স্মৃতিকথার মতো বই আছে বাঙ্গালা গবেষণায়। চৈতন্য বই এনেছে বাছাই করা কয়েকটি।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খাবারের দোকানের সামনের সারিতে ৭৯ বছরের পুরোনো প্রকাশনা নওরোজ কিতাবিস্তানের বইয়ের স্টলেও নতুন বই কম।

ছুটির দিনের মেলায় পাঠক, দর্শকের ভিড় মিলেমিশে গেল দুটি বাক্যে, ‘তাঁর সাথে দেখা হওয়ার পর আমূল বদলে ফেলেছি আমার পাণ্ডুলিপি/ লেখার উঠানে আজ উড়ে এসে বসেছে একঝাঁক সাদা পায়রা।’ জাগতিক প্রকাশনের প্রদর্শনী টেবিলে আছে কাজী আলিম-উজ-জামানের কবিতার বই হে প্রেমময়ী নিষ্ঠুর হেমন্ত। ‘বোধ’ কবিতার পঙ্‌ক্তি দুটি বইমেলা নিয়ে আমাদেরও প্রত্যাশা বাড়ায়।

মানুষের এই সমুদ্র ঠেলে মেলার আরেক প্রান্তে পৌঁছানো কঠিন। পুঁথিনিলয়ে মাইকেল মধুসূদনের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে তখন ছবি তুলছেন এক দম্পতি। জটলা আছে এখানে। প্রথমার প্যাভিলিয়নে তখন পাঠক সামলাচ্ছেন জার্মানি থেকে আসা লেখক সরাফ আহমেদ আর প্রথমার ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন। অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। নিজের বই, এমনকি অন্য লেখকের বইয়েও তাঁকে অটোগ্রাফ দিতে হচ্ছে হাসিমুখে। বললেন, এসবই আনন্দের ব্যাপার।

সেই আনন্দের ভেতর দেখা গেল এক খুদে পাঠক চাইছে, ‘প্রতি মঙ্গলবার আমরা বই ছাড়া স্কুলে যাই বইটা আছে আপনাদের কাছে?’

ঘরে বসে বইমেলার যেকোনো বই পেতে: þ www.prothoma.com Å ০১৭৩০০০০৬১৯