‘বিচারক নিজেকে স্বাধীন মনে না করলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুদূরপরাহত’

বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ
ফাইল ছবি

বিদায়ী সংবর্ধনায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ বলেছেন, একজন বিচারক যদি তাঁর মননে-চলনে-বিশ্বাসে নিজেকে স্বাধীন মনে না করেন, তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুদূরপরাহত।

আপিল বিভাগের ১ নম্বর বিচারকক্ষে (প্রধান বিচারপতির এজলাস) আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে এই বিদায়ী সংবর্ধনা হয়। এ সময় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও আপিল বিভাগের অপর তিন বিচারপতি বেঞ্চে ছিলেন। বিদায়ী সংবর্ধনাকালে বিচারকক্ষটি আইনজীবী ও আগত ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে পরিপূর্ণ ছিল।

কৃষ্ণা দেবনাথ আপিল বিভাগে নিয়োগ পাওয়া তৃতীয় নারী বিচারপতি। ১৯৫৫ সালের ১০ অক্টোবর জন্ম নেওয়া এই বিচারপতির ৬৭ বছর বয়স পূর্ণ হচ্ছে ৯ অক্টোবর। তবে সে সময় অবকাশ থাকায় আজ তাঁর শেষ কর্মদিবস। এর মধ্য দিয়ে এই বিচারপতির ৪১ বছরের বেশি সময়ের বিচারিক জীবনের ইতি ঘটতে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

প্রথা অনুসারে, আজ এই বিচারপতিকে বিদায়ী সংবর্ধনা জানানো হয়। সংবর্ধনায় প্রথমে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, পরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ফকির বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের কর্মময় জীবন নিয়ে বক্তব্য দেন।

বিদায়ী সংবর্ধনায় বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ বলেন, তাঁর ৪১ বছরের বিচারিক জীবন। এই সময়ে তিনি এ বিশ্বাসে উপনীত হয়েছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কাগজে-কলমে নিরঙ্কুশভাবে বাস্তবায়ন হলেও একজন বিচারক যদি তাঁর মননে-চলনে-বিশ্বাসে নিজেকে স্বাধীন মনে না করেন, তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুদূরপরাহত।

বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ আরও বলেন, ‘আজকের এই শেষ দিনে এ আশা নিয়ে বিচার অঙ্গন থেকে বিদায় নিতে চাই যে একজন বিচারক বিচারকাজে সম্পূর্ণ স্বাধীন—এই মূলমন্ত্র ধারণ করেই বিচারকাজ সম্পন্ন করবেন। আর বিজ্ঞ আইনজীবীরা তাঁদের সহযোগিতা করবেন এ প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে।’

৪১ বছরের বিচারিক জীবন
১৯৮১ সালের ৮ ডিসেম্বর জুডিশিয়াল সার্ভিসে মুনসেফ (বর্তমান সহকারী জজ) হিসেবে নিয়োগ পান কৃষ্ণা দেবনাথ। ১৯৯২ সালে তৎকালীন সরকারের আমলে সাবজজ থেকে অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে তাঁর পদোন্নতি আটকে দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভায় পরপর তিনবার তাঁকে পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। পদোন্নতির তালিকার শীর্ষে ছিল তাঁর নাম। তারপরও তাঁকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।

এ সময় এগিয়ে আসেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, ড. কামাল হোসেন ও আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম। আর পাশে থেকে সাহস জোগান তখনকার অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক। তাঁদের পরামর্শে প্রায় প্রতিটি জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা রিট করেন।

রিটে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে ‘পরামর্শ’ শব্দটি সরকারের জন্য মানা বাধ্যতামূলক—মর্মে নির্দেশনা চাওয়া হয়। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ১৯৯৪ সালে রুল দেন। রুল নিষ্পত্তির আগেই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের হস্তক্ষেপে সে বছরই কৃষ্ণা দেবনাথকে অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ১৯৯৮ সালে জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি।

বিভিন্ন জেলায় জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকার জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব পান কৃষ্ণা দেবনাথ। তিনিই ঢাকা জেলার প্রথম নারী জেলা জজ। এ দায়িত্ব পালনকালে ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।

হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল কৃষ্ণা দেবনাথের নিয়োগ স্থায়ী হয়। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন কৃষ্ণা দেবনাথ।