নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর সহায়তায় জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টারের নম্বর ১০৯–এ কল করে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগী মানুষেরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু তথ্য দিয়ে সহায়তা করা হচ্ছে। চিকিৎসার সুবিধা, কাউন্সেলিং (ব্যক্তিগত বা মানসিক সমস্যায় পরামর্শ), আইনি ও পুলিশের সহায়তা পাচ্ছেন খুব কমসংখ্যক নারী।
২০২২ সালে ১০৯–এ আসা প্রায় সোয়া ৭ লাখ কল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কল করা ব্যক্তিদের ৯৫ শতাংশকে শুধু তথ্য দিয়ে সহায়তা করা হয়েছে। এ ছাড়া হেল্পলাইন সেন্টারটি প্রতিষ্ঠার পর বিগত ১০ বছরের মোট কল বিশ্লেষণ করেও দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ কলের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের শুধু তথ্যসেবা দেওয়া হয়েছে।
হেল্পলাইন সেন্টারটির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা জানান, সীমিত জনবল এবং সরাসরি সহায়তা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা না থাকায় ভুক্তভোগীদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করা ছাড়া তাঁদের কোনো উপায় থাকছে না। সরাসরি সহায়তা দেওয়ার হার কম হওয়ায় জনপ্রিয় হচ্ছে না ১০৯। অনেকে নম্বরটির বিষয়ে জানেনও না।
এ নিয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম প্রথম আলোকে বলেন, ১০৯ হেল্পলাইন নম্বরটিকে আরও কার্যকর করতে শুধু তথ্য বা পরামর্শ দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, সরাসরি সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগও বাড়াতে হবে। আর ভুক্তভোগীদের দিতে হবে সামাজিক ও মনোসামাজিক সহায়তা। এর জন্য মন্ত্রণালয়ের এ–সংক্রান্ত কর্মসূচির সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। সরাসরি সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা বাড়ালে আরও বেশিসংখ্যক ভুক্তভোগী কল করতে আগ্রহী হবেন।
সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন
গত ৩১ জানুয়ারি রাজধানীর মহাখালী এলাকার বাসিন্দা এক নারী এই প্রতিবেদককে বলেন, তাঁর ছোট সন্তানের বয়স চার মাস। তিনি অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থায় তাঁর স্বামী মো. এনামুল তাঁকে মারধর করে জখম করেন এবং বাড়ি থেকে বের করে দেন। এখন তাঁর ও সন্তানের ভরণপোষণ দিচ্ছেন না স্বামী। তিনি স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। কিন্তু এতেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। ঢাকায় তাঁর স্বামীর নিজের বাড়ি থাকলেও তিনি দুই সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে দিনযাপন করছেন। কখনো ১০৯–এ কল করে সাহায্য চেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯ সম্পর্কে জানলেও ১০৯ সম্পর্কে জানেন না।
এর দুই দিন পর ওই নারীর সঙ্গে আবার কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তখন ওই নারী জানান, তিনি ১০৯–এ কল করে তাঁর সমস্যার কথা জানিয়েছেন। যাঁর সঙ্গে তিনি কথা বলেছিলেন (সার্ভিস প্রোভাইডার) তিনি তাঁর সমস্যার বিষয়গুলো শুনেছেন এবং তাঁকে রাজধানীর সদরঘাটের কাছে এক আদালতে (পুরান ঢাকায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল) গিয়ে আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছেন। কিন্তু কোথায়, কীভাবে, কী করতে হবে তা তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না।
নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে বহুমুখী কর্মসূচি’র আওতায় ৯টি প্রকল্প চলমান। এর একটি হচ্ছে, ১০৯–এর মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের সেবা দেওয়া। ২০১২ সালের শুরুতে ১০৯২১ নম্বরের মাধ্যমে এই হেল্পলাইন চালু করা হয়। ২০১৭ সালে নম্বরটি পরিবর্তন করে করা হয় ১০৯। ২০১৪ সাল থেকে এটি ‘টোল ফ্রি’ অর্থাৎ বিনা মূল্যে কল করা যায়। তবে খুদে বার্তা পাঠালে গুনতে হয় অর্থ।
অ্যাসিডদদ্ধ নারীর বিষয়ে কীভাবে সাহায্য পাওয়া যাবে জানতে এই প্রতিবেদক ৩ ফেব্রুয়ারি ১০৯–এ কল করলে স্বয়ংক্রিয় কণ্ঠ জানায়, সব লাইন ব্যস্ত রয়েছে। এসএমএস (খুদে বার্তা) পাঠিয়ে সমস্যার কথা লিখে ফোন নম্বর দিয়ে রাখলে সেবা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা পরে যোগাযোগ করবেন। খুদে বার্তা পাঠানোর সময় জানানো হয়, খুদে বার্তা পাঠানোর জন্য টাকা নেওয়া হতে পারে। পরে খুদে বার্তা পাঠালেও ১০৯–নম্বর থেকে এখনো কোনো জবাব আসেনি।
কল বেড়েছে, বাড়েনি সেবা
২০১২ সালে ১০৯–এ প্রায় ৫ হাজার কল এলেও ২০২২ সালে এই সংখ্যা ৭ লাখ ২৪ হাজারে দাঁড়িয়েছিল। গত ১০ বছরে চিকিৎসা, কাউন্সেলিং, পুলিশ, আইনি, তথ্য ও অন্যান্য—মোট ছয়টি শ্রেণিতে কল এসেছে ৫৮ লাখ ৪০ হাজার ৮০০টি। এসব কল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১২ সালে মোট কলের মধ্যে চিকিৎসাসেবা ২ শতাংশের বেশি, আইনি সহায়তা ৩৩ শতাংশ, কাউন্সেলিং ৪ শতাংশ, পুলিশের সহায়তা ৬ শতাংশ, তথ্য সহায়তা ৩৭ শতাংশ ও অন্যান্য সহায়তা ছিল ১৮ শতাংশের বেশি।
২০২২ সালের কলের মধ্যে চিকিৎসাসেবা ১ শতাংশের কম, আইনি সহায়তা ৩ শতাংশের বেশি, কাউন্সেলিং সহায়তা দশমিক ৩৩, পুলিশি সহায়তা ১ শতাংশের বেশি, তথ্য সহায়তা ৯৫ শতাংশ ও অন্যান্য সহায়তা ছিল ১ শতাংশের কম। অর্থাৎ ২০১২–এর তুলনায় ২০২২ সালে তথ্য সহায়তা ছাড়া সব ক্ষেত্রে সেবা কমেছে।
২০২০ সাল পর্যন্ত ১০৯–এ কল গ্রহীতা ৪০ জনের পাশাপাশি ২০ জন আউটসোর্সিং আর সার্ক উন্নয়ন তহবিল প্রকল্প থেকে ১৮ জনসহ ৭৮ জন জনবল ছিল। তবে কোভিডকালে ছাঁটাইয়ের পর এখন ৪০ জন তিন পালায় (শিফট) কাজ করেন। প্রতি আট ঘণ্টায় পাঁচজন সার্ভিস প্রোভাইডার সারা দেশ থেকে আসা কল গ্রহণ করছেন।
কল করা ব্যক্তিদের চিকিৎসা, পুলিশ ও আইনি সহায়তা দেওয়ায় যতটা দরকার, ততটা সামর্থ্য নেই ১০৯–এর, যেটা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এর আছে। ৯৯৯ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। জরুরি সহায়তা চাওয়া ব্যক্তিদের কাছে পুলিশ সরাসরি পৌঁছায়। ৯৯৯–এ ভুক্তভোগীদের করা কলের তথ্য ‘অনুসন্ধান’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত হয়।
ওসিসিরও একই হাল
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে বহুমুখী কর্মসূচি’র আওতায় ১০৯–এ কল করে সহায়তা চাওয়া নারী–শিশুদের দেশের ১৪টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের’ (ওসিসি) মাধ্যমে চিকিৎসা, কাউন্সেলিং, পুলিশ, আইনি সহায়তা দেওয়া হয়।
এ ছাড়া ভুক্তভোগী নারী ও শিশুদের চিকিৎসা ছাড়া বাকি সেবাগুলো সরাসরি দেওয়ার ব্যবস্থা নেয় জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থাকা ৬৭টি ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল (ওসিসি)। দেশজুড়ে সব জায়গায় এই সুবিধা না থাকায় ১০৯–এ কল করে সাহায্য চাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগকেই শুধু তথ্য দিয়ে সহায়তা করা হয়।
এসব বিষয়ে কথা বলতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে বহুমুখী কর্মসূচি’র প্রকল্প পরিচালক নাহিদ মঞ্জুরা আফরোজ ও ১০৯–এর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ইনচার্জ) রাইসুল ইসলামের কার্যালয়ে যান এই প্রতিবেদক। তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত এই দুই কর্মকর্তা এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ওই প্রকল্পের সাবেক প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যেসব নারী ও শিশু সরাসরি সহায়তা চাওয়ার জন্য আসতে পারে না, তাঁদের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যে ১০৯ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। প্রতিটি কল ধরার জন্য যত জনবল প্রয়োজন, ততটা নেই। প্রতিটি কল না ধরলে লোকজন কল করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। এ জন্য জনবল বাড়ানো দরকার। ওসিসি (সেল ও সেন্টার) কম থাকায় কল পেয়ে সরাসরি সহায়তা দেওয়ার হার তুলনামূলক কম। প্রকল্পটিকে এই অর্থবছরে (২০২২–২৩) ‘বি’ শ্রেণিতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই বাজেটও ২৫ শতাংশ কমে গেছে। প্রকল্পটির গুরুত্ব থাকায় এর সময়সীমা ও বাজেট বাড়ানো জরুরি।