খাদ্যে ক্ষতিকর ভারী ধাতু জনস্বাস্থ্যের জরুরি বিষয় 

জাকির হোসেন

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. জাকির হোসেনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি গবেষক দল জামালপুরে উৎপাদিত বেগুনে ভারী ধাতুর অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণা করেছে। তাদের গবেষণা নিবন্ধটি সম্প্রতি বিশ্বের খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্টিফিক রিপোর্ট–এ প্রকাশিত হয়। জাপানের কেইয়ো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা জাকির হোসেনের ৯৮টি গবেষণা প্রবন্ধ গত ১৫ বছরে প্রকাশিত হয়েছে, যার ৭০টি প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে। বেগুন নিয়ে করা গবেষণা প্রসঙ্গে অধ্যাপক জাকির হোসেনের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বেগুন নিয়ে গবেষণায় কী পেলেন?

জাকির হোসেন: আমরা যে বেগুনগুলো পরীক্ষা করেছি, তার ৭৫ শতাংশে সহনীয় মাত্রার দ্বিগুণের বেশি সিসা পেয়েছি। ১০ শতাংশ বেগুনে আরেক ভারী ধাতু ক্যাডমিয়াম সহনীয় মাত্রার চেয়ে চার গুণ বেশি পাওয়া গেছে। ওই বেগুন যেখানে উৎপাদিত হয়েছে, সেখানকার মাটিতে সিসা, ক্যাডমিয়াম, তামা ও দস্তা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রয়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগল, এসব ভারী ধাতু কোথা থেকে এসেছে? প্রাথমিকভাবে আমাদের মনে হয়েছে, বেগুন উৎপাদন করতে গিয়ে সার, কীটনাশক বা বালাইনাশক ও পানির মতো যেসব উপাদান ব্যবহৃত হয়, তা থেকে ভারী ধাতু বেগুনে চলে আসছে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: গবেষণা তো হয়েছে জামালপুরে। 

জাকির হোসেন: জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলায়। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বেগুন উৎপাদিত হয় জামালপুরে। তাই আমরা ওই এলাকা থেকে বেগুন সংগ্রহ করেছি। ইসলামপুর উপজেলার নির্দিষ্টসংখ্যক কৃষকের জমি থেকে সরাসরি বেগুন ও মাটি সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে। মাটি পরীক্ষা হয়েছে বেগুনে ভারী ধাতু কোথা থেকে আসছে, তা বোঝার জন্য। ইসলামপুর এলাকাটির আশপাশে কোনো বড় শিল্পকারখানা নেই যে সেখান থেকে রাসায়নিক বর্জ্য আসবে। ফলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, মূলত কীটনাশক থেকেই এসব ভারী ধাতু বেগুনে আসছে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ভারী ধাতুর ক্ষতি কতটুকু?

জাকির হোসেন: মানবদেহের জন্য ভারী ধাতু সবচেয়ে ক্ষতিকর। কারণ, সবজি সেদ্ধ করলে বা পানিতে অনেকবার ধোয়ার পরও ভারী ধাতু থেকে যায়। খাদ্য হয়ে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ক্ষতিকর ভারী ধাতু অসহনীয় মাত্রায় শরীরে প্রবেশ করলে বিভিন্ন রোগবালাই হয়। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে। তবে ক্ষতির মাত্রা কী হবে, তা আরও অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। 

ভারী ধাতু থাকা খাবার শিশুদের ও গর্ভবতী নারীদের বেশি ক্ষতি করে। এটি শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে। ক্ষতিকর ভারী ধাতু মানবদেহে ক্যানসারও সৃষ্টি করতে পারে।

সবজির মধ্যে আলুর পরেই জনপ্রিয়তায় এগিয়ে বেগুন। এটি সারা বছর পাওয়া যায়। আর বেগুনে ছিদ্রকারী পোকাসহ নানা কীটপতঙ্গের আক্রমণ বেশি হয়। যে কারণে এতে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহৃত হয়, যা ভারী ধাতুর উপস্থিতির আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এ ধরনের গবেষণা কি এই প্রথম হলো?

জাকির হোসেন: সবজিতে ভারী ধাতুর অস্তিত্ব নিয়ে এর আগেও অনেকে গবেষণা করেছেন, আমরাও করেছি, ভবিষ্যতে আরও করব। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়ে খাদ্যনিরাপত্তার পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করার জন্য পরিকল্পনা করেছে। নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি পুষ্টিনিরাপত্তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বেগুন খেলে ক্যানসার হয়, এটা প্রমাণের জন্য গবেষণাটি করা হয়নি। সবজিতে ভারী ধাতু ও কীটনাশকের অস্তিত্ব থেকে যায় কি না, তা জানার জন্যই এ গবেষণা। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কীটনাশক ও সারের মধ্যে ভারী ধাতু তো থাকার কথা নয়। 

জাকির হোসেন: এই প্রশ্ন আমাদের মনেও জেগেছে। দেশে সারের মান ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা রয়েছে, যা উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু সার আমদানির পর তা ঠিকমতো পরীক্ষা করা হয় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, দেশে আমরা প্রায়ই ভেজাল সার পাওয়ার কথা শুনি। একই সঙ্গে সারের মান সঠিকভাবে পরীক্ষা করা হয় কি না, তাতে ভারী ধাতুসহ অন্যান্য উপাদান আছে কি না, তা ঠিকমতো পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই।   

কীটনাশকের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও জটিল। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, সারের ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা থাকলেও কীটনাশকের ক্ষেত্রে তা নেই। দেশে প্রায় সব কীটনাশক বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। আর এসব কীটনাশক পরীক্ষা করার সময় সাধারণত তাতে ঘোষিত উপাদানগুলো সঠিক পরিমাণে আছে কি না, তা দেখা হয়। কিন্তু এর বাইরে কীটনাশকের মধ্যে ভারী ধাতুসহ ক্ষতিকর উপাদান থাকতে পারে, যার কোনো পরীক্ষা হয় না। গবেষণার ফলাফলের সঙ্গে আমরা কিছু সুপারিশ করেছি। তার মধ্যে সারের মান আরও কার্যকরভাবে পরীক্ষা করা এবং কীটনাশকের জন্য নীতিমালা তৈরি করার বিষয়টি রয়েছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: জামালপুর একটি বন্যাপ্রবণ এলাকা। বন্যার সময় তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি একত্রে সেখানে যায়। ময়মনসিংহ ও গাজীপুরে প্রচুর শিল্পকারখানা রয়েছে। শিল্পের বর্জ্যে থাকা ভারী ধাতু বন্যার পানির সঙ্গে জামালপুরের কৃষিজমিতে যেতে পারে কি?

জাকির হোসেন: উজান থেকে বন্যার পানির সঙ্গে ভারী ধাতু আসতে পারে, এটা ঠিক। তবে মাটিতে তা জমে থাকার আশঙ্কা কম। সামগ্রিকভাবে যদি বলি, তাহলে বলা যায়, নদীর দূষিত পানি সেচের মাধ্যমে কৃষিজমিতে আসতে পারে। তবে কীটনাশক ও সার থেকে ভারী ধাতু বেগুনে আসার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি বলে আমাদের মনে হয়েছে। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনারা কোন জাতের বেগুন নিয়ে গবেষণা করেছেন? 

জাকির হোসেন: আমরা মূলত দেশি জাতের বেগুন নিয়ে গবেষণাটি করেছি। ইসলামপুরে অনেক ধরনের দেশি জাতের বেগুনের চাষ হয়। বিটি বেগুন (জিনগতভাবে পরিবর্তিত) নিয়ে আমরা কাজ করিনি। এই বেগুন নিয়ে কাজের পরিকল্পনা আমাদের আছে। বিটি বেগুনের যে জাতটি আমাদের এখানে চাষ হয়, তা মূলত ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী। অন্য অনেক পোকার আক্রমণ তা ঠেকাতে পারে না। ফলে ওই বেগুনেও কৃষকেরা কীটনাশকের ব্যবহার করে থাকেন। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: তাহলে কী শুধু বেগুনেই ভারী ধাতু রয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে, অন্য সবজি ও খাদ্য কি নিরাপদ?

জাকির হোসেন: আমরা এর আগে পালংশাক ও চাল নিয়ে গবেষণা করেছি। সেখানে আমরা ভারী ধাতুর অস্তিত্ব পেয়েছি। তবে ওই কৃষিপণ্য দুটি মূলত বাজার থেকে সংগ্রহ করে আমরা পরীক্ষা করেছি। পালংশাক ও চালের মধ্যে ভারী ধাতুর উৎস হিসেবে আমাদের কীটনাশকের কথা বেশি মনে হয়েছে। ওই গবেষণায় আমরা ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছিলাম। ময়মনসিংহের চেয়ে চট্টগ্রামের চালে ভারী ধাতু কম পাওয়া গিয়েছিল। তার মানে, এখানে মাটি ও পানির ভূমিকা আছে। ময়মনসিংহের ভালুকা এলাকায় আমরা আরেকটি গবেষণা করেছি। সেখানে দূষিত পানি ও ধানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেছি। ওই গবেষণায় ভালুকার ধানে ভারী ধাতু বেশি পাওয়া যায়। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনাদের গবেষণাটির বাজেট কত ছিল? 

জাকির হোসেন: বেগুন নিয়ে এক বছর ধরে গবেষণার জন্য দুই দফায় সরকার থেকে প্রায় চার লাখ টাকা দেওয়া হয়। গবেষক দলের প্রধান হিসেবে আমার জন্য মোট ৩০ হাজার টাকা ও অন্যদের জন্য ১০ হাজার টাকা করে রাখা হয়েছিল। আমরা ওই অর্থ নিইনি। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এখন তো বিশ্বজুড়ে উন্নত মানের তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের কীটনাশক বাজারে এসেছে। সেগুলো ফসলে ব্যবহারের পর দু–এক দিন পরই ফসলে অবশিষ্টাংশ (রেসিডিউ) থাকার ঝুঁকি কমে যায়। দেশে কি তাহলে উন্নত কীটনাশক আসছে না?

জাকির হোসেন: হ্যাঁ, এটা ঠিক যে কীটনাশকের মান উন্নত হয়েছে। তবে আমাদের এখানে যেসব কীটনাশক আমদানি করা হয়, কৃষকের কাছে বিক্রি করা হয়, তাতে ক্ষতিকর ভারী ধাতুর পরিমাণ বেশি থাকার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে কয়েক মাস আগে মুড়ি ও চিনিগুঁড়া চালের একটি চালান সুইডেনে রপ্তানি করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানকার কৃষি বিভাগ তা পরীক্ষা করে দুটি ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান পেয়েছে, যার উৎস হচ্ছে কীটনাশক। তারপর তারা চালানটি বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে। এই চাল ও মুড়ি উৎপাদন এবং নানা প্রক্রিয়া শেষ করে সুইডেন পর্যন্ত যেতে কমপক্ষে মাস দুয়েক সময় লাগবে। রপ্তানির আগে তা দেশে পরীক্ষাও হয়েছে। সেখানে এই রাসায়নিক শনাক্ত হয়নি। তার মানে, আমরা দেশের ভেতরে যেসব খাদ্যপণ্য খাচ্ছি, তাতে ক্ষতিকর উপাদান থেকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। 

সব মিলিয়ে সবজি অথবা খাদ্যে ভারী ধাতু থেকে যাওয়া খুবই জরুরি জনস্বাস্থ্যের বিষয়। নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করতে হলে আমাদের এ নিয়ে আরও গবেষণা এবং তদারকি বাড়াতে হবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এটা দেখার দায়িত্ব কার?

জাকির হোসেন: কৃষক পর্যায়ে এটা দেখার দায়িত্ব কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। কৃষকেরা কী পরিমাণে কোন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করছেন, সেগুলোর মান কী, তা দেখার জন্য দ্রুত একটি নীতিমালা করতে হবে। মাঠপর্যায়ে তদারকি বাড়াতে হবে। অন্যদিকে ভোক্তা পর্যায়ে পাইকারি ও খুচরা দোকানে যেসব খাদ্যপণ্য বিক্রি হচ্ছে, তাতে ভারী ধাতুসহ ক্ষতিকর কিছু আছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের। সঠিকভাবে তারা যদি দেখত, তাহলে বেগুন, চাল বা মুড়িতে এসব ভারী ধাতু থাকার কথা নয়। 

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কৃষিতে কীটনাশক ব্যবহারের কি কোনো বিকল্প নেই? 

জাকির হোসেন: এখন পর্যন্ত কীটনাশকের অনেক বিকল্প আসছে। অনেকগুলো নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। কিন্তু কোনো একটি একক সমাধান পাওয়া যায়নি। আমরা অনেকগুলো সমাধান একত্র করে কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। তবে আমাদের জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে
‘গুড অ্যাগ্রিকালচার প্র্যাকটিস’। মানে, সঠিক নিয়মে কীটনাশক, সার ও পানির ব্যবহার। কিন্তু তা হচ্ছে না। আমরা জামালপুরের মেলান্দহে গিয়ে দেখেছি, কৃষকেরা তিন দিন পর পর জমিতে কীটনাশক ব্যবহার করছেন। কোনো সবজি বা কৃষিপণ্য মাঠ থেকে তোলার চার দিন আগে কীটনাশক প্রয়োগ বন্ধ করার নিয়ম রয়েছে। তা মানা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে কৃষকদেরও সাবধান ও সচেতন হতে হবে।