‘স্মার্ট সিটি’, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ কেন গরিবের জন্য নয়

সরকার বলছে, সবকিছুই ‘স্মার্ট’ হবে। স্মার্ট সিটি, স্মার্ট কৃষি। এই স্মার্ট মানে কি সংখ্যাগরিষ্ঠের জীবনমানের উন্নয়ন?

শহরের অনেক কিছুই এখন ডিজিটাল। যেমন বিজ্ঞাপনের জন্য লাগানো হয়েছে ডিজিটাল বিলবোর্ড। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারার মোড়ে
ছবি: আশরাফুল আলম

২০১৯ সালে মুক্তি পায় ভারতীয় ওয়েব সিরিজ লেইলালেইলা এক ভয়ংকর দুঃশাসনের কল্পকাহিনি। ছবিতে দেখানো হয় ২০৪৫ সালের এক ডিজিটাল ভারতকে। অর্থ, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা—সবকিছু কেন্দ্র থেকে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। বিপুল জমি নিয়ে তৈরি ধনী এলাকাগুলো ঘিরে রাখে উঁচু লোহার ফটক আর সিসিটিভি ক্যামেরা। ধনী এলাকা থেকে নির্গত বর্জ্যের ডিপোর ওপর গড়ে উঠেছে লাখো মানুষের অন্ধকার বস্তি। সেখানে শুধুই কারখানার আবর্জনা, কালো ধোঁয়া আর কালো পানি।

ধনীদের এলাকাগুলোয় গরিবদের ঢোকার অনুমতি নেই। ধনীদের কাজের লোকের সাপ্লাই আসে ‘লেবার ক্যাম্প’ থেকে। তাদের হাতে ডিজিটাল ‘চিপ’ লাগানো। ঝাড়ুদার, রাঁধুনি, মিস্ত্রি—কোড ঘষে নিরাপত্তাবলয় পেরিয়ে ধনী এলাকায় ঢোকে। তাদের ‘ট্র্যাক’ করা যায়। আপাতদৃষ্টে এ এক দূর ভবিষ্যতের কল্পকাহিনি।

কিন্তু আসলেও কি তাই? দ্রুতবর্ধনশীল শহরগুলোকে ‘স্মার্ট সিটি’ বানানোর যে প্রক্রিয়া, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’–এর নামে যে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা, এসবের সঙ্গে এই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির কোনো মিল নেই?

স্মার্ট সিটিতে গরিবের জায়গা

সরকার বলছে, সবকিছুই ‘স্মার্ট’ হবে। স্মার্ট সিটি, স্মার্ট কৃষি। স্মার্ট সিটি শুনলে মনে হয় ‘গ্রিন’, সৌরবিদ্যুৎ, নারীবান্ধব, প্রচুর গণপরিবহন, প্রচুর পাবলিক টয়লেট, লোকজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করবে না ইত্যাদি। কিন্তু এই স্মার্ট কি সেই স্মার্ট? এই স্মার্ট সিটির বৈশিষ্ট্য কী? এই যে ‘স্মার্ট সিটি’র নামে হাজার কোটি টাকার ডিজিটাল প্রযুক্তি, অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—এসব দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বসবাস অনুপযোগী শহরটির ঠিক কী লাভ হবে? দূর হবে ঢাকার যানজট আর জলাবদ্ধতা? বাতাসে বিষাক্ত ধাতুর পরিমাণ কমবে? ‘স্মার্ট’ প্রযুক্তির সঙ্গে শহরের লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষের ভাত, রুটি, কাপড়ের প্রতিদিনের সংগ্রামের সম্পর্ক কী? শহরকে ‘স্মার্ট’ বানানোর এই ‘মাস্টারপ্ল্যানে’ কার লাভ? স্মার্ট শহরে গরিব কি সুলভে আবাসন–সুবিধা পাবে? সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা বাড়বে? প্রতি রুটে বাসের সংখ্যা বাড়বে? বাসের ভাড়া কমবে? কল খুললে পাওয়া যাবে পরিষ্কার পানি? কলকাতার মতো মেট্রোরেলে চেপে ৫ টাকায় ৫ মাইল যাওয়া যাবে?

এই স্মার্ট মানে কি সংখ্যাগরিষ্ঠের জীবনমানের উন্নয়ন? নাকি এই স্মার্ট মানে ভিআইপি এলাকার ভদ্রলোকীকরণ? (পশ্চিমে যাকে বলা হচ্ছে ‘জেন্ট্রিফিকেশন’। মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে ‘কালো’ মানুষদের সস্তা এলাকায় আস্তে আস্তে ধনী ও ‘সাদা’ ‘জেন্টলমেনরা’ ঢুকে পড়ায় বাড়িভাড়া বাড়ছে, নয়া ধনীদের কেন্দ্র করে শপিং মল বা রেস্তোরাঁর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে এলাকায় থাকা-খাওয়ার খরচ বাড়ছে। খরচ কুলাতে না পেরে ‘কালো’রা সরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন)

একই ঘটনা ঘটছে এ শহরেও। দ্রুতগতিতে বাড়ছে ঢাকার জমির মূল্য। ‘জেন্টলমেনদের’ এই মহামূল্যবান জমিতে বস্তি থাকবে কেন? ফ্লাইওভার হবে, রিকশা হটাও। ‘বিউটিফিকেশন’ হবে, হকার সরাও।

অতঃপর স্মার্ট সিটি বাস্তবায়নের ঘোষণা এল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ঘোষণা দিলেন ‘স্মার্ট’ ঢাকায় ১০ লাখ রিকশা রাখা যাবে না, থাকবে দুই লাখ রিকশা। তা–ও সাধারণ রিকশা না, ‘ডিজিটাল রিকশা’। সিটি করপোরেশন নিজেই দুই লাখ রিকশা নামাবে। এসব রিকশায় থাকবে কিউআর কোড, অর্থাৎ রিকশা ‘ট্র্যাক’ করা যাবে (অবশ্য এই কোডওয়ালা রিকশা খাতে কত টাকার লেনদেন হবে, বাকি ৮ লাখ রিকশাচালকের কী হবে, সেটা খোলাসা করেননি মেয়র।)

পরে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপসও একটি ঘোষণা দিলেন। বললেন, দক্ষিণ ঢাকার ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করা হবে! (যেন ঢাকার ৩ লাখ হকার কোনো ক্রেতা ছাড়াই পিকনিক করতে রাস্তায় বসে!) উল্লেখ্য, সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতারা লাইনম্যানের মাধ্যমে ঢাকার হকারদের কাছ থেকে দৈনিক সংগ্রহ করে প্রায় ৬ কোটি টাকা (প্রথম আলো, ২০২২)!

হকার বা রিকশাচালক অর্থনীতির জন্য ভালো না খারাপ, এটি নির্ভর করে কে কোন ‘লেন্স’ দিয়ে শহুরে অর্থনীতিকে দেখছে তার ওপর। এই শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কারা? হকার, প্লাম্বার, গার্ড, ভ্যানওয়ালা, পণ্য পরিবহনকারী, টিভির মেকানিক, রডের মিস্ত্রি, ছুটা বুয়া, এরাই তো? শহরের চারদিকে এই কর্মী বাহিনীর সার্ভিস অপরিহার্য।

শুধু সার্ভিস নয়, রাজধানীর এই কর্মী বাহিনী সরকারকে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট দেয়। এরাই মধ্যবিত্তের জরুরি পণ্য সরবরাহের ‘লাইফলাইন’। আবার এরাই দেশীয় কলকারখানাগুলোর হাজার কোটি টাকার পণ্যের আজীবনের ক্রেতা।

ভাবুন, ঢাকা শহরের ১০ লাখ রিকশাওয়ালার ১০ লাখ সিম! ১০ লাখ রিকশার হুড, চাকা, সিট, পেইন্টিং, গ্যারেজ—সব মিলিয়ে এটি শতকোটি টাকার ইন্ডাস্ট্রি। দরজি, হকার, ছুটা বুয়া প্রতিদিন ১০ টাকার মিনিট কিনলেও মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর দৈনিক আয় কত?

দেশি কোম্পানিগুলোর ‘টার্গেট মার্কেট’ কারা? কারা কিনছে দেশিও কোম্পানির কেক, বিস্কুট, জুতা, সাইকেল? কাদের মোবাইল মিনিটের অবিশ্বাস্য যোগফলে দাঁড়িয়ে গেছে আমাদের মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো? অথচ এই সুবিশাল কর্মী বাহিনীর জন্য ন্যূনতম সুযোগ–সুবিধা দূরে থাক, এদের শহরের বাইরে বের করে দেওয়াই এই তথাকথিত স্মার্ট সিটির মূল ‘প্ল্যান’?

ভিআইপি এলাকার ‘ভদ্রলোকীকরণ’

গুলশান, বনানী বা বসুন্ধরার ‘ভদ্রলোকীকরণ’ শুরু হয়েছে বহু আগেই। আগে গ্রামীণ বাস, বনানী ট্রান্সপোর্ট, আর ৬ নম্বর বাস ছিল। এগুলো সরিয়ে দিয়ে এখন মাত্র দুটি অভিজাত কোম্পানির এসি বাস চলে। সাত বছর আগেও নতুন বাজার থেকে কাকলি পর্যন্ত (২ কিলোমিটার) ভাড়া ছিল মাত্র ৫ টাকা। এখন হয়েছে ৩০ টাকা! অথচ ২০২২ সালের সরকার–নির্ধারিত ভাড়ার হার কিলোমিটারপ্রতি ২.৪৫ টাকা! অর্থাৎ চাপিয়ে দেওয়া এসি বাসের ভাড়া প্রায় ৬ গুণ বেশি!

ছাত্ররা বলছে, তাদের এসির দরকার নেই। অথচ ছাত্রদের হাফ পাস আন্দোলনের সময়ে এক পুলিশকে বলতে শোনা গেছে, ‘ভিআইপি এলাকায় লেখাপড়া করবা আর সামান্য ৩০ টাকা দিতে পারবা না?’ অথচ ‘ভিআইপি’ এলাকাগুলোতে কি ভিআইপির ছেলেমেয়েরা পড়ে? বনানী বিদ্যানিকেতনের ৭ হাজার ছেলেমেয়েই বনানীর বাইরে থেকে আসে। বনানীর অন্তত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বনানী গুলশানের স্থানীয় নয়। অথচ ভিআইপিকরণের পাল্লায় পড়ে অফিসগামী যাত্রী আর শিক্ষার্থীদের পরিবহন খরচ বাড়ছেই।

একটা সময়ে ভিআইপি এলাকাগুলোতে ‘মুসলিম বেকারি’, ‘রাজবাড়ী স্টেশনারি’, বা ‘মায়ের দোয়া’ ভাতের হোটেলের রমরমা দিন ছিল। সস্তা খাবার, কুইক সার্ভিসের দোকানগুলো ছিল অফিসগামীদের পছন্দের জায়গা। এখন ভাতের হোটেল বা খোলাবাজারগুলো আর নেই। ছোট জায়গার ভাড়া বেড়েছে ৩ গুণ, এসেছে ‘চেইন শপ’। পাড়ার দরজির দোকানগুলো হারিয়ে গেছে, জায়গা দখল করেছে ভারতীয় ফ্যাশন হাউস।

এখনো রাজধানীর বেশ কিছু সস্তা এলাকায় মধ্যবিত্তের ফ্ল্যাটবাড়ির আশপাশেই তাদের গার্ড বা বুয়ারা ছাপরাঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু ভিআইপি এলাকার সস্তা জায়গাগুলোকে বহু আগেই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঠেলতে ঠেলতে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বহু দূরে। কর্মী বাহিনী ভ্যাট দেবেন, পণ্য আনবেন, কিন্তু ফুটপাতে বসতে পারবেন না। তাঁদের ঘর হবে অভিজাত দালানগুলো থেকে বহু দূরে। সারা দিন অভিজাত এলাকায় কায়িক পরিশ্রম দিয়ে তাঁরা ফেরত যাবেন দূরে, হেঁটে হেঁটে।

উল্লেখ্য, ভারতীয় নগরবিদেরা ইতিমধ্যেই ‘স্মার্ট সিটি’কে গরিববিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন (দেখুন, ‘স্মার্ট সিটিস মিশন’ ইজ অ্যান্টিপুওর, নন-ইনক্লুসিভ, অ্যান্ড অ্যাগেইনস্ট কনস্টিটিউশন, ২০২০)। সম্প্রতি ভারতের কংগ্রেস পার্টি অভিযোগ করেছে, ভারতের স্মার্ট সিটির সুবিশাল বাজেটের ৮০ শতাংশই খরচ হয়েছে শহরের মাত্র আড়াই শতাংশ ধনী এলাকায়।

‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ দিয়ে কী হবে?

সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ঘোষণা এসেছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া শেষ, এখন পরবর্তী টার্গেট ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’। মধ্যবিত্তের মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের চাহিদা বাড়ছে, বিকাশ, নগদ বা রকেটের মতো আর্থিক লেনদেন সেবারও বিপুল চাহিদা আছে, কিন্তু এই ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ কী জিনিস? নিম্ন আয়ের কোটি কোটি মানুষ নগদ টাকাতেই লেনদেন করে এবং ভবিষ্যতেও করবে। গরিবের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা বিকাশ অ্যাকাউন্ট থাকাই দরকার, কিন্তু ৫-১০ কোটি মানুষকে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের আওতায় আনার এই ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় কাদের এত উৎসাহ? জনগণের জন্য ন্যূনতম সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত না করে, হঠাৎ করেই এসব কেতারদুরস্ত স্মার্ট প্রকল্প নিয়ে অতি মাতামাতি করলে এর আগে–পিছে কে আছে, দেখা দরকার।

তা ছাড়া গরিবকে ‘ডিজিটালিকরণের’ এই প্রকল্পগুলো কি ‘ওপেন বিডিং’, স্বচ্ছতা, সুশাসন—এসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অনুমোদন পায়? নাকি রীতিমতো ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে পরিকল্পনা হয়? উল্লেখ্য, করোনার সময় দেশের ৭ কোটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের হিসাব প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। দেখা গেছে, ওই ৭ কোটি অ্যাকাউন্টে গড়ে টাকা আছে মাত্র ৬১০! অর্থাৎ এই দেশের ৭ কোটি মানুষের সঞ্চয় বলতে মাত্র ৬০০ টাকা!

এখন বুঝুন, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই, মধ্যবিত্তের হাতে টাকা নেই, গার্মেন্টস খাতে ক্রমাগত ছাঁটাই বাড়ছে, প্রতিবছর বেকার তরুণের সংখ্যাও বাড়ছে, শ্রমজীবী মানুষ টাকার অভাবে মাংস খাওয়া বন্ধ করেছে। আর এ রকম একটা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের স্বপ্নের প্রজেক্ট হচ্ছে ৬ কোটি গরিবের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা? তো ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’তে মাসে একবার ব্রয়লার মুরগি খাওয়ার মতো ‘ক্যাশ’ থাকবে তো গরিবের অ্যাকাউন্টে?

আর্থসামাজিক বাস্তবতা বনাম ‘স্মার্ট’ বাংলাদেশ

এসব তথাকথিত স্মার্ট প্রযুক্তি কোথায় কীভাবে প্রয়োগ হচ্ছে দেখুন। অর্থনৈতিক বাস্তবতা কী, মানুষের সংগ্রাম কী, আর ‘স্মার্ট’ প্রযুক্তি করছেটা কী?

একদিকে সার, বীজ, ডিজেলের দাম লাগামছাড়া, ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে কৃষক ফকির হয়ে যাচ্ছে। অথচ সরকার কৃষি খাতে
বিপ্লব করবে কৃষকের জন্য অ্যাপ বানিয়ে? আবহমানকালের কৃষক সফটওয়্যার, ইন্টারনেট, জিপিএস চালিয়ে বেশি বেশি ফসল উৎপাদন করবেন? ধান উৎপাদন করতে গিয়ে ফতুর হওয়া বন্ধ হবে তাতে? ফাইভ–জি চালিয়ে সার বীজের দাম কমবে?

দেশে ১০ হাজার রোগীর জন্য চিকিৎসক আছে মাত্র ৬ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ১ হাজার রোগীর জন্য হাসপাতালে ন্যূনতম ৩ দশমিক ৫টি শয্যা থাকতে হবে, আমাদের আছে মাত্র শূন্য দশমিক ৩টি! আমাদের এখন দরকার ছিল জেলায়–উপজেলায় হাসপাতাল, নার্স, আর আইসিইউ শয্যার সংখ্যা বাড়ানো। ডায়ালাইসিস আর কেমোথেরাপির খরচ কমানো। অথচ আমাদের টাকা বরাদ্দ হচ্ছে কোথায়? অ্যাপ বানিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে রোগীকে ‘কানেক্ট’ করাও, ‘জুম মিটিং’ করাও। মোট কথা, ‘স্মার্ট’ সার্ভিসের জন্য টাকাপয়সা ঢালো। এদিকে জমিজমা বিক্রি করেও হাসপাতালের খরচ মেটাতে পারে না মানুষ।

খোদ ইউনেসকোর ‘আইসিটি ফর ডেভেলপমেন্ট’ বিভাগের প্রধান টিম আনইউন ‘প্রযুক্তি দিয়ে বিপ্লব হয়ে যাবে’—এমন ধারণার কড়া সমালোচক। বরং তিনি কিছু জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ শেষ পর্যন্ত কার পকেটে যাচ্ছে? অটোমেশন যদি লক্ষ শ্রমিককে কর্মহীন করে ফেলে, অ্যাপভিত্তিক ‘প্ল্যাটফর্ম’ যদি শ্রম শোষণ করে (রাইডার অ্যাপগুলো এর উদাহরণ), প্রযুক্তি যদি ধনী–গরিবের বৈষম্য প্রকট করে তোলে, তাহলে সেটা কার ‘বিপ্লব’? শ্রমিকের বদলে রোবট আনতে কারা আগ্রহী? এসব অভিজাত প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানা কার হাতে? তারা কি ‘ওয়ার্কিং ক্লাসে’র প্রতিনিধি? নাকি ধনী ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি?

দেশে বেকারের সংখ্যা যখন ক্রমাগত বাড়ছে, ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে, তখন গরিবের জন্য কাজ তৈরি করছে একটিমাত্র খাত, সেটি আমাদের ইনফরমাল খাত (এবং কোনো ধরনের সরকারি সুবিধা ছাড়াই)। অথচ দেশের এই ৮৫ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থানের সুরক্ষা দেওয়া তো দূরে থাক, কীভাবে ৮ লাখ রিকশাওয়ালার রিকশা কেড়ে নেবে, কী করে শহর থেকে হকার তাড়াবে—এই হচ্ছে ‘স্মার্ট’ বাংলাদেশের উন্নয়নচিন্তা! তাহলে তো বলতেই হয়, গরিব মারা ‘স্মার্ট বাংলদেশ’ থেকে সাবধান।

  • মাহা মির্জা উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক